সপ্তাখানেক ধরে সংগীতাঙ্গনে শুরু হয়েছে নতুন অস্থিরতা। বিষয়টি বেশ পুরনো। সংগীতে মেধাস্বত্ব আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সংগীত স্রষ্টাদের ন্যায্য রয়্যালিটি নিশ্চিত করা। গেল প্রায় পাঁচ বছর ধরে এ বিষয়ে চলছে- নানা অস্থিরতা। শিল্পী-সুরকার-গীতিকার-প্রযোজকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে পক্ষ-বিপক্ষ। সংগীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগও ছিল বেশ ক’বার। সে লক্ষ্যে গড়ে উঠেছে একাধিক সংগঠনও। অথচ কাগজে লেখা মেধাস্বত্ব আইন এবং শিল্পীদের কাঙ্খিত রয়্যালিটি- বারবার মুখ থুবড়ে পড়েছে কোনও এক ভেীতিক কারণে। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীরা অনেক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একরকম প্রতারণার শিকারও হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বামবা, এলসিএস গিল্ড, আরওয়াইএমবি নামক শিল্পী-মিউজিশিয়ানকেন্দ্রিক সংগঠনগুলোর কার্যক্রমও খুব একটা আশাব্যঞ্জক ছিলনা। অভিযোগ রয়েছে, প্রযোজকদের অন্যতম সংগঠন এমআইবি’র বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়েও। আবার সংগঠনগুলোর মধ্যেও রয়েছে স্পষ্ট মতানৈক্য। সেই সুবাদে গেল ক’বছর ধরে, বাংলাদেশের সংগীতাঙ্গন অদ্ভুত ঘোড়ার পিঠে চলছে নিরুদ্দেশে।
ঠিক এমন সময়ে আবারও সংগীতাঙ্গনে স্থিরতা আনতে এবং কপিরাইট আইন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সংগীত পরিচালক আলাউদ্দিন আলী, সাবিনা ইয়াসমিন, হামিন আহমেদ, সুজিত মোস্তফাসহ এমন আরও অনেক অগ্রজ মিলে গঠন করেছেন বিএলসিপিএস নামের একটি সংগঠন। দেশের সংগীতে কপিরাইট আইন বাস্তবায়ন ও শিল্পীদের ন্যায্য রয়্যালিটি পাইয়ে দেওয়ার নিমিত্বে এ সংগঠনটি সম্প্রতি পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে কপিরাইট রেজিস্ট্রিন অফিস হয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রনালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয় থেকেও। বিশেষ করে এই সংগঠন ও এর কার্যক্রমকে সমর্থন করে সম্প্রতি একটি বক্তব্য রাখেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি আহ্বান করেন, শিল্পীদের অনুমতি নিয়ে মোবাইল ফোনে ওয়েলকাম টিউন ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের প্রতিনিধি এবং সংগীতশিল্পী, সুরকার ও গীতিকারদের সঙ্গে বৈঠকে এ কথা জানান তিনি। তারানা হালিম ওই বৈঠকে বলেন, ‘নতুন গানের ক্ষেত্রে শিল্পী-সুরকার-গীতিকারদের সংগঠন বিএলসিপিএস (বাংলাদেশ লিরিসিস্টস কম্পোজার্স এ্যান্ড পারফরমার্স সোসাইটি) অথরিটি হিসেবে অনুমোদন দেবে।’
আসছে ভালোবাসা দিবসের অ্যালবাম ভাবনা ভুলে প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে যেন পলকেই দাবানল বনে গেল দেশীয় সংগীতাঙ্গন। প্রযোজকরা তো বটেই, দেশের অনেক শীর্ষ তারকা এবং চলতি প্রজন্মের অনেক শিল্পীরাও একা এবং জোটবদ্ধ হয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল অন্তর্জাল দুনিয়ায়- ‘কে দিল আমার গান অনুমোদনের দায়িত্ব এই সংগঠনকে?’ এর বিরুদ্ধে অনানুষ্ঠানিক বেশ কটি বৈঠকও হয়েছে শিল্পী-প্রযোজকদের। চলছে সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্থগিতের উদ্যোগও। দাবি উঠেছে, বিএলসিপিএস কার্যক্রম বন্ধ করে ‘বাংলাদেশ মিউজিক্যাল রেগুলেটরি কমিশন’ গঠনের। আর এ দাবির সঙ্গে রয়েছেন তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ, সামিনা চৌধুরী, আসিফ ইকবাল, আসিফ আকবরসহ অনেকেই। আবার প্রযোজকদের সংগঠন এমআইবি প্রতিমন্ত্রীর এমন মন্তব্য এবং বিএলসিপিএস সংগঠনের বিরুদ্ধাচরণ করে একটি বিজ্ঞাপনও প্রকাশ করেছে জাতীয় দৈনিকে।
আর এসবের বিপরীতে বৃহস্পতিবার মুখ খুললেন বিএলসিপিএস-এর প্রেসিডেন্ট তথা দেশের নন্দিত কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। তার ভাষ্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো নিচে-
গীতিকবি, সুরস্রষ্টা, কণ্ঠিশিল্পী- সর্বোপরি সংগীত শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলের অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ব্যবস্থা রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ওআইপো) দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ শিল্পের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চুক্তি প্রণয়ন করে আসছে। যেই চুক্তিসমূহের মাধ্যমে প্রতিটি দেশেই সংগীত শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় রেখে চলেছে সোচ্চার ভূমিকা।
ঐতিহাসিকভাবে সংগীতের তীর্থভূমি বাংলাদেশে এই আন্দোলনের শুরু অনেক আগে হলেও সংগীতস্রষ্টা বা গীতিকবি, সুরস্রষ্টা, কণ্ঠশিল্পীসহ সংশ্লিষ্টদের একত্রিত করে একটি সংস্থা তৈরি করতে আমাদের সময় লেগেছে অনেক বেশি। তারপরও আমরা বাংলাদেশ লিরিসিস্টস কম্পোজার্স অ্যান্ড পারফর্মারস সোসাইটি (বিএলসিপিএস) নামে একটি সংগঠন তৈরি করতে সমর্থ হই।
আমরা প্রয়োজনীয় উপাত্ত ও কাগজপত্রসহ কপিরাইট রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে সংস্কৃতিবিষয়ক মণ্ত্রনালয়ে আবেদন করার পর এপক্ষকে যথাযথভাবে লাইসেন্স প্রদান করা হয়। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, বাংলাদেশের সংগীত স্রষ্টাদের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়টির দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয় এই সংস্থাটিকে।
এই দায়িত্বের অর্থ এই নয় যে, সংস্থাটি সকল সংগীত স্রষ্টার সম্পদের মালিকানা পেয়ে গেল; বরং এই দায়িত্বের অর্থ সকল সংগীত স্রষ্টা যেকোনও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান থেকে তার সংগীত প্রকাশ এবং বিপণনে প্রকৃত ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কিনা তা পর্যবেক্ষণ করা। একই সঙ্গে যথোপযুক্ত এবং আইনগতভাবে ইন্টারনেট থেকে সংগীত ডাউনলোড ও বিক্রয় কিংবা কতবার ডাউনলোড অথবা বিক্রয় করা হচ্ছে- তা নিবিড়ভাবে মনিটর করবে বিএলসিপিএস। এছাড়া যদি কারও সৃষ্ট সংগীত পাইরেসি হয় এবং সেটি নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ও এর প্রকৃত মালিককে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্বও এই সংস্থার।
আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএলসিপিএস কারও ব্যক্তিগত সংস্থা নয়, বরং এটি সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল স্রষ্টার অধিকার আদায়ের একটি কল্যাণকর সংস্থা বা সোসাইটি। এর নেতৃত্বও নির্ধারিত প্রক্রিয়ায় পরিবর্তনশীল। নিঃসন্দেহে যেকোনও বিষয়ে শুরুটা সবসময়ই কঠিন এবং জটিল। এ কারণেই আমরা বিশেষভাবে আনন্দিত যে বাংলাদেশে এরকম একটি সোসাইটি আমরা গঠন করতে পেরেছি, যা সংস্কৃতিবিষয়ক মণ্ত্রনালয়ের অনুমোদন প্রাপ্ত হয়েছে।
বিএলসিপিএস প্রাথমিক পর্যায়ে ইতোমধ্যে বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। মাননীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী একটি নির্দেশনার মাধ্যমে এটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, এই সংগঠনই সংগীতশিল্পী ও স্রষ্টাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দাবি আদায়ে মূল দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা।
ইতোমধ্যে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, আমরা নাকি সংগীতের ক্ষেত্রে অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা করছি, যা পুরোপুরিই অপব্যাখ্যা। আসলে আমরা বিদ্যমান অরাজকতা দূর করার একটি চেষ্টা করছি মাত্র। এই বিষয়টি সংগীত স্রষ্টাদের বুঝতে, বিশ্বাস করতে হবে এবং যারা এই ‘অরাজকতা’ প্রচারের সঙ্গে জড়িত তারা কিন্তু সংগীত শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকল সংগীত স্রষ্টাদের কপিরাইট ও রয়্যালিটির বিষয়টি আজ পর্যন্ত নিশ্চিত করতে পারেননি।
উদাহরণ হিসেবে একটি বাড়ি বা গাড়ি কেনাবেচা হলে সরকারের নির্ধারিত অফিসে যেমন রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়, তেমনি সংগীতও একটি সম্পদ। এই সম্পদ মেধাগত, এটিরও রেজিষ্ট্রেশন করতে হয়, এটিরও রেজিস্ট্রেশন করার প্রয়োজন রয়েছে। এবং সেই বিষয়টি সঠিকভাবে করা হলো কিনা, প্রকৃত স্রষ্টা তার প্রাপ্য রয়্যালিটি বুঝে পেল কিনা তা দেখভাল করবার জন্য আমরা আইনগতভাবে তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকব। আশা করব তারা, বাংলাদেশে সরকারের সংশ্লিষ্ট মণ্ত্রনালয়কে হেয় প্রতিপন্ন করা থেকে বিরত থাকবেন।
/এমএম/