ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস কাতার ও মিসরের প্রস্তাবিত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েল বলছে, চুক্তির শর্তগুলোতে তাদের দাবি মানা হয়নি। সোমবারের এই অগ্রগতির পর মঙ্গলবার রাফাহ শহরে ‘সীমিত আকারের’ হামলা করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। তবে সমঝোতার জন্য আলোচনা অব্যাহত রেখেছে দেশটি। এমন অবস্থায় অনিশ্চয়তায় ঝুলে আছে যুদ্ধবিরতির ভাগ্য।
সোমবার রাতে এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে হামাস বলেছে, কাতারি ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি হওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছেন গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়েহ। পরে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, চুক্তির শর্তগুলোতে ইসরায়েলের দাবি পূরণ হয়নি। কিন্তু চুক্তিতে পৌঁছাতে আলোচনার জন্য তারা কায়রোতে একটি প্রতিনিধিদল পাঠাবে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের প্রতিনিধিদল মঙ্গলবার কায়রো সফর করবে। সেখানে হামাস ও ইসরায়েলের পরোক্ষ আলোচনা পুনরায় শুরু হবে।
এক বিবৃতিতে নেতানিয়াহুর কার্যালয় বলেছে, ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা রাফাহতে অভিযান চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, রাফাহতে বোমাবর্ষণ করে যুদ্ধবিরতির চুক্তিকে জটিলতায় ফেলছেন নেতানিয়াহু।
কী আছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, হামাস যে প্রস্তাবে রাজি হয়েছে, তা মিসরীয় প্রস্তাবের একটি নমনীয় সংস্করণ। এতে এমন শর্ত রয়েছে, যেগুলো ইসরায়েল মেনে নেবে না।
হামাসের রাজি হওয়া চুক্তির বিষয়ে অবগত অপর এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেছেন, ২৭ এপ্রিল জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে কয়েক ধাপের যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব ইসরায়েল দিয়েছিল, সেটিতেই ছোটখাটো পরিবর্তন আনা সংস্করণে রাজি হয়েছে হামাস। মূল শর্তে এই পরিবর্তন কোনও প্রভাব ফেলবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বলেছেন, হামাসের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা করবে ওয়াশিংটন। একটি চুক্তি হওয়া সম্ভব।
যদি কোনও চুক্তি হয় তাহলে নভেম্বরে সপ্তাহব্যাপী বিরতির পর প্রথম যুদ্ধবিরতি হবে তা। ওই সময় হামাস প্রায় অর্ধেক জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছিল। তারপর থেকে যুদ্ধবিরতির সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সংঘাতের স্থায়ী অবসানের বিনিময়ে আরও জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার অবস্থানে হামাস এত দিন অনড় ছিল। ইসরায়েলও বলে আসছিল তারা শুধু অস্থায়ী বিরতি নিয়ে আলোচনা করবে, যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে নয়।
হামাসের এক কর্মকর্তা ও হানিয়েহর উপদেষ্টা তাহের আল-ননো রয়টার্সকে বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তাদের গাজা পুনর্গঠনের উদ্যোগ, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের নিজেদের বাড়িতে ফেরত আসা এবং ইসরায়েলি কারাগার থেকে ফিলিস্তিনি কারাবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার শর্ত রয়েছে।
হামাসের উপপ্রধান খলিল আল-হায়া আল-জাজিরাকে বলেছেন, প্রস্তাবে তিন ধাপের যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে, প্রতিটি ধাপ হবে ছয় সপ্তাহ দীর্ঘ। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করবে ইসরায়েল।
কঠিন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহু
যুক্তরাষ্ট্রের একজন সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত ডেনিস রস বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেছেন, যেকোনও যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে রাজি হওয়ার ক্ষেত্রে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন।
ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভির উভয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যদি প্রস্তাবিত চুক্তি মেনে নেয় তাহলে তারা সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন।
ডেনিস রস বলেছেন, হামাস যা বলছে তা সঠিক হলে চুক্তির শর্তগুলো নেতানিয়াহুর প্রস্তাবের কাছাকাছি। ফলে এটি প্রত্যাখ্যান করা তার জন্য সহজ হবে না। আর নেতানিয়াহু যদি প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে সরকারের আরও মন্ত্রীরা তাকে ছেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
তিনি বলেছেন, এতে হয়তো সরকারের পতন হবে না, কিন্তু অনেক ঘটনার সূত্রপাত ঘটবে। আমি মনে করি এতে সরকার ঝুঁকিতে পড়বে। একপর্যায়ে নেতানিয়াহুকে বেনগভিরের বদলে বাইডেনকে বেছে নিতে হবে, স্মট্রিচের বদলে জিম্মিদের বেছে নিতে হবে।
সব জিম্মির মুক্তি চায় ইসরায়েল
নেতানিয়াহুর ক্ষমতাসীন লিকুদ পার্টির সাবেক ইসরায়েলি এমপি মাইকেল ক্লেইনার বলেছেন, হামাস যদি সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে একটি চুক্তিতে রাজি হওয়ার বিষয়ে সত্যিকার অর্থে আগ্রহী হয় তাহলে ইসরায়েল হয়তো চুক্তি করবে।
তিনি বলেছেন, সব জিম্মিকে ফেরত আনার আগ পর্যন্ত ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে নিজেকে বিজয়ী দাবি করতে পারবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখছেন নতুন যুদ্ধবিরতির চুক্তিতে রাজি হতে হামাস কতটা ‘সিরিয়াস’। রাফাহতে যে সামরিক কর্মকাণ্ড চলছে সেগুলোর গতি বাড়বে না। এগুলো প্রস্তুতিমূলক, সর্বাত্মক যুদ্ধ নয়।
‘খুব ঘোলাটে পরিস্থিতি’
আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি বিষয়ক থিংক ট্যাংক ট্যাথাম হাউজের মতে, গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি নিয়ে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি খুব ঘোলাটে। প্রতিষ্ঠানটির এক অ্যাসোসিয়েট ফেলো ড. লিনা খাতিব বিবিসি ফাইভকে বলেছেন, ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবার ও গাজার মানুষেরা যে অবস্থায় রয়েছে তা আমি শুধু কল্পনা করতে পারি।
তিনি বলেছেন, মিসর, কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করেছে। কায়রোতে আলোচকদের যে পাঠাচ্ছে ইসরায়েল তা নেতানিয়াহুর জন্য ইতিবাচক। তবে সম্মত হওয়ার বিষয়টি অস্পষ্ট।
ড. লিনা খাতিব বলেছেন, অনিশ্চিত খবরে জানা যাচ্ছে হামাস দীর্ঘমেয়াদে শত্রুতাপূর্ণ কর্মকাণ্ডের অবসান চায়। অজ্ঞাত ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাদের এ কথা সঠিক হলে তা পরিস্থিতির পাল্টানোর জন্য যুগান্তকারী। কারণ এর অর্থ হলো হামাস শুধু রাজনৈতিক ভূমিকা রাখার কথা মেনে নিচ্ছে। আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে।
তিনি বলেছেন, নিজেদের দাবিতে হামাসকে রাজি করাতে গোষ্ঠীটির ওপর চাপ বাড়াতে চায় ইসরায়েল। দুর্ভাগ্যবশত, এমন দৃশ্যপটে বেসামরিকরা সবসময় দুর্ভোগের শিকার হন। রাফাহতে হামলা সম্প্রসারণ না করতে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়াতে পারে।
নেতানিয়াহুর ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া
মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে নতুন অনিশ্চয়তার মধ্যে রাফাহ ক্রসিং দখল করেছে ইসরায়েলি সেনারা। এর মাধ্যমে নেতানিয়াহু একটি ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া খেলছেন। আন্তর্জাতিক মিত্রদের সতর্ক বার্তা অগ্রাহ্য করে তিনি শহরটিতে অভিযান পরিচালনায় অটল। অনেক ইসরায়েলি এই পদক্ষেপকে তার রাজনৈতিক রক্ষাকবচ মনে করছেন।
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, হামাসের বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার দাবি করতে রাফাহতে অভিযান পরিচালনা নেতানিয়াহুর জন্য প্রয়োজনীয়। যতই অবাস্তব মনে হোক, নেতানিয়াহু হামাসকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এতে কট্টরপন্থিদের সমর্থন তিনি পাবেন এবং জোট সরকার তাকে ক্ষমতায় রাখবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, রাফাহ ও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া নিয়ে নেতানিয়াহুর মন্তব্যের কারণে হামাস নিজেদের অবস্থান কঠোর করেছে। একই সময়ে রবিবার হামাসের রকেট হামলায় চার ইসরায়েলি সেনা নিহতের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে তারা এখনও সামরিকভাবে ইসরায়েলকে আঘাতে সক্ষম।
এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সোমবার নেতানিয়াহুর কার্যালয় একটি বিবৃতি জারি করেছে। নেতানিয়াহু চুক্তিকে জটিলতায় ফেলছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা একেবারে মিথ্যা ও জনগণকে বোকা বানানোর চেষ্টা বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, পরিস্থিতি একেবারে উল্টো। হামাস নিজেদের দাবি থেকে এক ইঞ্চিও সরেনি, এমনটি কোনও ইসরায়েলি সরকার মেনে নিতে পারে না।
সোমবার সন্ধ্যায় হামাস চুক্তিতে রাজি হওয়ার কথা ঘোষণা দেওয়ার পর অনেক ইসরায়েলি বিশ্লেষক দেশটির সেনাবাহিনীর রাফাহতে উদ্যোগকে কৃতিত্ব দিয়েছেন। তবে এই উদ্যোগ নিয়ে ভিন্নমত তুলে ধরারও সুযোগ রয়েছে। সোমবারের ‘সীমিত আকারের অস্থায়ীভাবে সরে যাওয়ার’ নির্দেশ ইঙ্গিত দিচ্ছে পুরো শহরে অভিযান আসন্ন নয়।
এতে হামাসের শেষ চার ব্যাটালিয়নকে নির্মূল করতে ইসরায়েলের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তারা বলে আসছিল, এই যোদ্ধারা রাফাহতে রয়েছে এবং তাদের পরাজিত করতে হবে।
নিউ ইয়র্কে দায়িত্ব পালন করা সাবেক ইসরায়েলি কনসাল জেনারেল অ্যালন পিঙ্কাস বলেছেন, সাত মাসের যুদ্ধের পর নেতানিয়াহুর সামনে আর কোনও বিকল্প নেই। হামাস সাদা পতাকা তুলে ধরবে না। এরপরও নেতানিয়াহু রাফাহকে এক ধরনের স্ট্যালিনগ্রাদে পরিণত করেছেন।
সূত্র: রয়টার্স, আল জাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস ও বিবিসি