গাজা উপত্যকার রাফাহ শহরে সামরিক অভিযান নিয়ে ইসরায়েলে ও আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। হামাসকে নির্মূল করতে রাফাহতে অভিযান চালাতে অটল তিনি। যা ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর হাতে থাকা জিম্মিদের মুক্তিকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
গাজায় হামাসের হাতে আটক থাকা ১৩০ জনের বেশি জিম্মিকে ফিরিয়ে আনতে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে বিক্ষোভ হচ্ছে। এমন বিক্ষোভ দেশটিতে নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির দাবি জানাচ্ছে।
একই সময়ে অপর একটি পক্ষ সরকার ও সেনাবাহিনীকে রাফাহতে সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য চাপ দিচ্ছে। রাফাহ শহরে হামাসের শেষ চারটি ব্যাটালিয়ন রয়েছে বলে দাবি করে আসছে ইসরায়েল। চলতি সপ্তাহে রাফাহতে বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি সেনারা।
ইসরায়েলি সেনাদের পরিবারগুলোর প্রতিনিধিত্বকারী একটি গোষ্ঠীর মুখপাত্র মিরিট হফম্যান বলেছেন, আমরা সরকার ও সেনাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি রাফাহতে অভিযান পরিচালনার জন্য। আমরা চাই হামাস শর্তহীনভাবে আত্মসমর্পণ করুক।
তিনি বলেছেন, আমরা মনে করি মধ্যপ্রাচ্যে এভাবেই দরকষাকষি হয়।
নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভাতেও ছোট আকারের বিভাজন রয়েছে। মধ্যপন্থি মন্ত্রীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। দেশটি ইসরায়েলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ও অস্ত্র সরবরাহকারী। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী কট্টরপন্থিরা গাজা উপত্যকা থেকে হামাসকে নির্মূলে অনড়।
মিসর ও কাতারের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নিয়ে নেতানিয়াহুকে নতুন জটিলতায় ফেলেছে হামাস। এতে জিম্মি মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি ও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব রয়েছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা সেই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা অভিযোগ করেছেন, হামাস চুক্তির শর্ত পাল্টাচ্ছে। কিন্তু তারা আলোচনা ও ধারাবাহিক কূটনৈতিক উদ্যোগ থেকে সরে আসেনি। বুধবার নেতানিয়াহুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-র প্রধান বিল বার্নসের।
আন্তর্জাতিকভাবে গাজায় ইসরায়েলি অভিযানের প্রতিবাদে বিক্ষোভ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রায় সাত মাসের এই যুদ্ধে ৩৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
জনমত জরিপে দেখা গেছে, চলমান যুদ্ধ নিয়ে ইসরায়েলিদের মধ্যে বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে।
জেরুজালেমের বাসিন্দা এলিশেভা লিয়েবলার (৫২) বলেছেন, আমি বুঝতে পারছি হামাসকে পরাজিত করতে রাফাহতে অভিযান জরুরি। কিন্তু তা পরেও করা যাবে, জিম্মিরা অপেক্ষা করার মতো অবস্থায় নেই। প্রতিটি মুহূর্ত তাদের জীবনের জন্য বিপজ্জনক।
আপাতত নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভার কোনও ফাটল দৃশ্যমান হয়নি। যুদ্ধবিরতির জন্য হামাসের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি না করতে কট্টরপন্থিদের বিরোধিতার মুখে রয়েছেন তিনি। এছাড়া মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ইসরায়েলের একটি অস্ত্রের চালান আটকে দিয়েছে। যা রাফাহতে ইসরায়েলি অভিযানের বিরোধিতার ইঙ্গিত হতে পারে।
বুধবার চ্যানেল ১৩ প্রকাশিত একটি জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ৫৬ শতাংশ মনে করেন নেতানিয়াহুর প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো তার নিজের রাজনৈতিকভাবে ঠিকে থাকা। মাত্রা ৩০ শতাংশ মনে করেন তিনি জিম্মিদের মুক্ত করতে কাজ করছেন।
ইসরায়েল ডেমোক্র্যাসি ইনস্টিটিউটের অপর এক জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকের বেশি জনগণ মনে করেন হামাসের অবশিষ্ট শক্তি ধ্বংস করার পরিবর্তে জিম্মিদের মুক্ত করতে একটি চুক্তি সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
কিন্তু জুইশ পিপল’স পলিসি ইনস্টিটিউটের পৃথক জরিপে দেখা গেছে, ৬১ শতাংশ উত্তরদাতা মনে করে সেনাবাহিনীকে যেকোনও পরিস্থিতিতে রাফাহতে অভিযান পরিচালনা করা উচিত।
চ্যানেল ১৩ এর জরিপে ৪১ শতাংশ চুক্তি মেনে নেওয়ার পক্ষে ও ৪৪ শতাংশ বিরুদ্ধে বলে উঠে এসেছে।
জেরুজালেমের আরেক ইসরায়েলি ডেভিড তাউব বলেছেন, আমি হামাসকে বিশ্বাস করি না। একমাত্র সমাধান হলো রাফাহ দখল করা। তখন হয়ত, আমাদের আশা, আমাদের প্রার্থনা, জিম্মিরা আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে।
এই মুহূর্তে নেতানিয়াহু কট্টরপন্থি দুই জাতীয়তাবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর নির্ভর করছেন। তারা হলেন অর্থমন্ত্রী বেজালাল স্মট্রিচ ও নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভির। উভয়েই যেকোনও সমঝোতার ইঙ্গিত প্রত্যাখ্যান করেছেন।
এই দুই নেতা একাধিকবার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য ও সাবেক জেনারেল বেনি গান্তজের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। গান্তজ ও অপর এক সাবেক সেনাপ্রধান গাদি আইজেন কট হামাসের চিরশত্রু। কিন্তু দুজনেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি নিয়ে উদ্বিগ্ন।
ক্রমবর্ধমান হতাশাগ্রস্ত জিম্মিদের পরিবারগুলো সীমাহীন অনিশ্চয়তায় হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। অন্য যেকোনও কিছু বিবেচনার চেয়ে তারা নিজেদের স্বজনদের নিরাপদে ফিরে আসাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
২২ বছর বয়সী জিম্মি ওমর ওয়েঙ্কার্টের মা নিভা ওয়েঙ্কার্ট বলেছেন, ইসরায়েলি নেতাদের ওপর আস্থা রাখা ছাড়া তার আর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু জিম্মিদের মুক্ত করতে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তার কথায়, জিম্মিরা এখনও গাজায় রয়েছে। সামরিক তৎপরতা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি খুব খারাপ। আমি ওমরকে ফেরত চাই।