X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘লিটল বয়’ থেকে ড্রোন যুগ: হিরোশিমা দিবসের তাৎপর্য অনুসন্ধান

বিদেশ ডেস্ক
০৬ আগস্ট ২০১৬, ২২:২৭আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৬, ১২:২১

‘‘আমি মেঝেতে বসে থাকা পুরুষ ও নারীদের দেখলাম, তারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এদের কারও কারও পা ছিল না, কারও হাত ছিল না, কারও চক্ষুকোঠরে মণি ছিল না অথবা তাদের সারা শরীর বীভৎসভাবে দগ্ধ ছিল। আর এসব দৃশ্য দেখে বোমারু বিমানের সদস্য হিসেবে আমার কাজের কথা মনে পড়ে যায়। আর তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। কথা বলতে পারছিলাম না।’’ হিরোশিমার পারমাণবিক বোমা হামলার ২০ বছর পর হামলার গ্রাস থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের দেখে এসে কথাগুলো যিনি লিখেছেন, তিনি  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওই উত্তপ্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান ক্রু’র সদস্য। অথচ কিনা সেই মানুষটিই ১৯৬৬ সালের আগস্টে স্ত্রী রজকে সঙ্গে নিয়ে জাপানের শান্তি গ্রুপের এক নিমন্ত্রণে সেদেশে গিয়ে “হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপ” ঘুরে এসে এই অভিজ্ঞতার লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

যার কথা বলছি, তিনি হাওয়ার্ড জিন। যুদ্ধের ভয়াবহতা আর ক্ষতচিহ্নগুলোকে নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিন যোগ দিয়েছিলেন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরম নৈতিক পরিসর থেকে। হিরোশিমার প্রেরণাতে তিনি টের পান, যুদ্ধ ফ্যাসিবাদবিরোধিতার নামে হলেও তবু তা যুদ্ধই, আর সব যুদ্ধই একই  রকমের। যুদ্ধের ভালো-খারাপ হয় না।  হিরোশিমার স্মৃতিতে জিন লিখেছিলেন,  “যুদ্ধের পরিবেশ কীভাবে এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে অবিভেদ্য করতে শুরু করে, সেই শিক্ষাটা আমি আমার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে পুনর্ভাবনা এবং ইতিহাস পঠন থেকে পেয়েছিলাম।”

সাড়া জাগানো বই ‘এ পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেট’ বইয়ের রচয়িতা জিন চলে গেছেন ২০১০ সালে। তিনি আমাদের রেখে গেছেন  এমন  এক সময় আর পরিস্থিতির মুখে; যেখানে দাঁড়িয়ে ১৯৪৬ সালের সেই লিটল বয়‌খ্যাত বোমার থেকে আরও অনেক ভয়ঙ্কর সব বিস্ফোরক ও মারণাস্ত্র নিয়ে ধ্বংস-সম্ভাবনা নিয়ে! তাই জিনের কথার গুরুত্ব বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে হৃদয়ে হিরোশিমাকে অনুভব করার তাগিদ। শিকাগোভিত্তিক লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ডাস্টিন এক্স যেন সে তাগিদ থেকেই হিরোশিমার পাটাতনে সেদিনের যুদ্ধবাস্তবতাকে আজকের ড্রোন-ক্রসফায়ার-বোমা হামলার প্রেক্ষাপটে হাজির করেন। জিনের মতো করে তিনিও ফ্যাসিবাদবিরোধিতার অজুহাতকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, তিনিও পরোক্ষে যুদ্ধের কথিত নৈতিক ভিত্তিকে নাড়িয়ে দেন।
ডাস্টিন এক্স  বলতে চান,  ফ্যাসিবাদবিরোধিতা আর যুদ্ধ বন্ধ করার অজুহাত তুলে রাজনীতিক-কূটনীতিকরা হিরোশিমার দিকে যে অস্ত্র তাঁক করেছিল, তা আজও ক্রিয়াশীল। তাই উপসংহারে অস্ত্রের প্রয়োজনহীন এক বিশ্ব গড়ার কঠিন কাজকেই গন্তব্য হিসেবে হাজির করেন তিনি।  আণবিক বোমা হামলার  ৭১তম বার্ষিকীতে দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট ডাস্টিন সেই লেখা প্রকাশ করেছে  বিকল্প তথ্যমাধ্যম ট্রুথআউট ডটকম। বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য লেখাটির ভাষান্তর করেছেন
উম্মে রায়হানা। - বি.স.

আণবিক বোমার বিরোধিতা এখনও চলমান জাপানের হিরোশিমা নগরীর ঠিক কেন্দ্রস্থলেই রয়েছে একটি পার্ক। এখন যেখানে পিস পার্ক বা হিরোশিমা মেমোরিয়াল পার্কটি অবস্থিত, সেখানেই পৃথিবীর বুকে প্রথম আণবিক বোমাটি বিস্ফোরিত হয়েছিল। এখানে সমবেত হয়ে বোমায় নিহতদের স্মরণ করেন জাপানিরা, প্রার্থনা করেন শান্তির। এই পার্কে ওই সময়ের একটি ভবনের কঙ্কাল সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে, যা থেকে আণবিক বোমার ভয়াবহতা কিছুটা হলেও আঁচ করা যায়। এই ভবনটির ১ দশমিক ২ মাইল পরিধির মধ্যে প্রায় সব ভবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বোমার আঘাতে। মানব সভ্যতার সবচেয়ে ধংসাত্মক শক্তির প্রতীক হয়ে রয়েছে ওই ভবনের গোলাকার গম্বুজটি।  

এ বছর ২৭ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হিরোশিমা সফরে যান। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনও রকম ক্ষমা প্রার্থনা করেননি ওবামা। তার মতে, এই সিদ্ধান্তকে প্রশ্ন করা তার কাজ নয়। তবে পিস মেমরিয়াল পার্কের বেদীতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন ওবামা। কঙ্কালসার ভবনটির সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্যও দেন তিনি। পৃথিবীকে আনবিক বোমামুক্ত করতে এক ‘নৈতিক বিপ্লব’-এরও ডাক দেন ওবামা। 

ওবামার হিরোশিমা সফর একটি স্বতন্ত্র ঘটনা। কেননা ওবামাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি ক্ষমতাসীন থাকাকালে হিরোশিমা সফর করেছেন। বিল ক্লিনটন ও জর্জ ডব্লিউ বুশ ভিয়েতনাম সফর করেছেন, জিমি কার্টার হিরোশিমা সফর করেছেন, তবে তা প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়। ওবামার এই সফর যুক্তরাষ্ট্রের মনযোগ তেমনভাবে না পেলেও, জাপান একে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে। হাজার হাজার জাপানি যোগ দিয়েছেন, তাদের মধ্যে বোমার তেজস্ক্রিয়তার ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা বয়স্ক মানুষেরাও ছিলেন। গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে এই খবর, মানুষ টিভিতে দেখেছেন ওবামার ভাষণ। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আণবিক বোমার বিষয়টি একটি ঐতিহাসিক সত্য ছাড়া কিছুই নয়, কিন্তু জাপানের কাছে তা জাতীয় চেতনার অংশ।   

হিরোশিমায় আণবিক হামলার পর বেঁচে যাওয়াদের নিয়ে একটি চিত্র

এই পার্কে রয়েছে ‘হিরোশিমা পিস মিউজিয়াম’। ওবামার সফরের পর এই মিউজিয়ামে বিদেশি দর্শনার্থীর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছে। এক বছর আগের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি বিদেশি দর্শনার্থী এসেছেন এই মিউজিয়ামে। তাদের মধ্যে আমিও একজন। জুলাই মাসে আমি হিরোশিমায় যাই। পিস পার্ক ও পিস মিউজিয়াম ঘুরে দেখি। এর আগে কোনও মিউজিয়াম আমাকে এতখানি প্রভাবিত করতে পারেনি। এই মিউজিয়াম মুহূর্তের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর অন্ধকার গল্প মনে করিয়ে দেয়। দর্শকরা বোমার ইতিহাস, এর শারিরিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পান। যারা এখনও বেঁচে আছেন তাদের দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে পারেন এর ভয়াবহতা। বিস্ফোরণের আগের ও পরের ছবি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে ওই মিউজিয়ামে। সংরক্ষণ করে রাখা আছে পোড়া ভাঙা ছিন্নভিন্ন নানা জিনিস। এ থেকে কিছুটা হলেও ধারণা করা যায় কীভাবে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটা গোটা নগরী পরিণত হয়েছিল সমতল একটি ধ্বংসস্তুপে। 

পিস পার্কে হেঁটে বেড়ানোর সময় ওবামার বক্তব্যের কিছু কিছু কথা মনে পড়ল। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘আমরা এখানে কেন এসেছি? হিরোশিমায়?’ নিজেই দিয়েছিলেন এর উত্তর, ‘একটি ভয়ংকর শক্তির বিষয় বিবেচনা করতে, যা খুব বেশি আগের কথাও নয়।’     

তিনি আরও বলেন, আমরা যদি জোর করেও বোমা ফেলার মুহূর্তটি ভাবতে পারি, বিভ্রান্ত শিশুদের মনের মধ্যে জেগে ওঠা ভীতিটুকু অনুভব করার চেষ্টা করি, তাহলে একটি নীরব কান্না শুনতে পাব। মনে করতে পারব, কত কত নিরপরাধ মানুষ এই যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। এর আগে যে সব যুদ্ধ হয়েছে তাতে যেমন, ভবিষ্যতে যেসব যুদ্ধ হবে তাতেও তেমনি নিরপরাধ মানুষরাই প্রাণ হারাবেন।    

‘লিটল বয়’ থেকে ড্রোন যুগ: হিরোশিমা দিবসের তাৎপর্য অনুসন্ধান

আনবিক বোমা

এনোলা গে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে হিরোশিমার ওপর পৃথিবীর প্রথম আণবিক বোমাটি ফেলেন। একটি আলোর ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে ধুলোয় পরিণত হয় মানুষ আর ঘরবাড়ি। ‘লিটল বয়’ নামের ওই বোমার প্রথম আঘাতেই একসঙ্গে প্রাণ হারান হাজার হাজার মানুষ। আরও হাজার হাজার মানুষ মারা যান বোমার তেজস্ক্রিয়তায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। সর্বমোট ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান ওই হামলায়।

এর তিনদিন পর নাগাসাকির আকাশ মাশরুমের মতো একধরনের মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে যায় দ্বিতীয় বোমাটি ফেলার কারণে। আবারও মুহূর্তের মধ্যে প্রাণ হারান হাজার হাজার মানুষ। আরও অনেকে আহত ও আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘায়িত যন্ত্রণাময় মৃত্যু বরণ করেন। বোমা হামলার পরের পাঁচ বছর পর্যন্ত জাপানে অব্যাহত মৃত্যুর মড়ক লেগে থাকে। ওই পাঁচ বছরে মারা যান আরও আড়াই লাখ মানুষ।   

বোমার আগে ও পরে তোলা ছবিগুলোর বেশিরভাগই সাদাকালো, যা থেকে মনে হয় ঘটনাটি অনেক আগের। সত্যিকার অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। হলোকাস্ট, ফ্যাসিবাদ ও পার্ল হারবার আক্রমণ মাত্র এক প্রজন্ম আগে ঘটেছে। এর প্রভাব এখনও তীব্রভাবে জাজ্বল্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধের একটি। এতে ৬০ মিলিয়নেরও  বেশি মানুষ প্রাণ হারান, সাধারণ নাগরিক ও সেনাবাহিনীর মধ্যে পার্থক্য বিলীন হয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি সেনাকে যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়, শত শত নগরী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয় ও আণবিক বোমা ফেলা হয়।  

পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় আণবিক বোমা ফেলাকে বৈধতা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় অনেক সময়। এতে জাপানের আক্রমণ প্রতিহত করা গিয়েছে ও হাজার হাজার জাপানি এবং আমেরিকানের প্রাণরক্ষা হয়েছে বলেও দাবি করা হয়। কিন্তু আণবিক বোমায় যে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি হয়েছে, তাতে এ কথা প্রমাণ হয় না। জাপান শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণই করত। বোমা হয়তো যুদ্ধ বন্ধ করেছে, কিন্তু যেহেতু জাপান আগে থেকেই দুর্বল পক্ষ ছিল, অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন এই শক্তি প্রদর্শন ছিলো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি একটি ইঙ্গিতমাত্র; যা থেকে শুরু হয় স্নায়ুযুদ্ধ।

অনেকে এমনও দাবি করেন, ফ্যাসিবাদ ধ্বংস করার জন্য বোমা হামলার প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু আমেরিকায় বিদ্যমান বর্ণবাদ এ ধারণাকে সমর্থন করে না। আজকের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন ও জাতিতে জাতিতে বৈষম্য ওই সময়েরই ধারাবাহিকতা। আজকের যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদয় হওয়া থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে ধারণা করা যায়। যদি অ্যাডলফ হিটলার বোমা ফেলতেন তাহলে একে ফ্যাসিবাদের হাতিয়ার বলা হতো। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র এই বোমা ফেলেছে, কাজেই একে বলা হচ্ছে প্রাণরক্ষার নিমিত্ত। প্রাণরক্ষার জন্য মানুষ মারার ধারণা অত্যন্ত স্ববিরোধী। এর ভিত্তিই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বময়তা।    

এই নৈতিক ও ঐতিহাসিক বিতর্ক আজও চলমান রয়েছে। তবে আমাদের এই বাহাসে অনেক সময়ই নিহত ও আক্রান্ত মানুষদের কথা ওঠে আসে না। প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ এখনও বেঁচে আছেন, যাদের শরীরে ও মনে বোমার প্রভাব এখনও ক্রিয়াশীল। আমাদের উচিত হিবাকুশাদের (বোমার অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা এই নামে পরিচিত) দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি বিবেচনা করা। আমাদের উচিত হিরোশিমার ৭১তম বার্ষিকীতে হিবাকুশাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।  

প্রতি বছর ৬ আগস্ট হিরোশিমা দিবস পালন করা হয়। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই তা পালিত হয়ে আসছে, কেবল ১৯৫০ সালটি বাদ দিয়ে। এই দিনে হিরশিমার মেয়র একটি শান্তির ঘোষণা পাঠ করেন। পুরো নগরী এক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। আণবিক বোমামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য নীরবতা পালন করেন হিরোশিমাসহ পুরো জাপানের মানুষ। আমাদেরও উচিত এই অঙ্গীকারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। শুধু বার্ষিকীর দিন নয়, বরং রোজকার চর্চার মধ্যে একে নিয়ে আসা প্রয়োজন। কারণ আজকের ড্রোন হামলা আণবিক বোমার মতোই।

  গোপনে ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র

ড্রোন হামলা

হিরোশিমায় যে কারণ দেখিয়ে আণবিক বোমা হামলা হয়েছিলো, আজকের দুনিয়ায় সন্দেহভাজন জঙ্গিদের মারতে একই যুক্তিতে ড্রোন হামলা চালানো হচ্ছে। জাপানি ও আমেরিকানদের বাঁচাতে যেমন আণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিলো, তেমনভাবেই জঙ্গি দমন করতে ড্রোন হামলা করা হয়। ড্রোন হামলায় কোনও মানুষ প্রয়োজন হয় না। মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের পাঠানো যায় না, এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিগুলোতেই ড্রোন ব্যবহৃত হয়।  

হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে অন্তত ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এর কারণ, মানুষ ও সভ্যতাকে ধ্বংস করার লক্ষ্যেই এই হামলা চালানো হয়েছিলো। ড্রোন নির্দিষ্টভাবে জঙ্গিদের লক্ষ্য করেই নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু এতে নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারান না এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই। ড্রোনের আঘাতে প্রাণ হারানো মানুষের সংখ্যা আণবিক বোমা হামলায় মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যার সঙ্গে তুলনা করার কোনও সুযোগ নেই। তার কারণ ড্রোন হামলা হয় গোপন প্রকল্পের অংশ হিসেবে।  

গ্লেন গ্রিনওয়ালড, লরা পোয়েট এবং জেরেমি শিল ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’ নামের একটি তদন্তকারী অনলাইন নিউজ আউটলেট প্রতিষ্ঠা করেন ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে। ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’ মার্কিন সেনাবাহিনীর ড্রোন প্রকল্পের বিস্তারিত দলিল প্রকাশ করে। ‘দ্য ড্রোন পেপারস’ নামে পরিচিত ওই দলিল বেনামি গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে প্রকাশ করা হয়। ওই দলিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন প্রকল্প সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কীভাবে ড্রোন অনুমোদন করেছেন তা জানা যায় অসমর্থিত সূত্রে। ড্রোনে কাদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়, কারা মারা যায় সে সম্পর্কে স্পষ্টভাবে কিছুই জানা যায় না। ফলে যারা নিহত হন তারা সত্যিই সন্ত্রাসবাদী কিনা তাও অস্বচ্ছ রয়ে যায়।    

‘ড্রোন পেপারস’ প্রকাশিত হওয়ার ৯ মাস পর ২০১৬ সালের ১ জুলাই হোয়াইট হাউজ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, ২০০৯ সাল থেকে ৪৭৩টি ড্রোন হামলায় অন্তত ৬৪ থেকে ১১৬ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রতিবেদনগুলোতে যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তাতে এই সংখ্যাটি আরও বেশি। 

প্রেসিডেন্ট ওবামার দাবি মতে, ড্রোন প্রকল্প সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের স্পষ্ট ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়া। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা কঠিন, ড্রোন হামলা যে সব স্থানে ঘটে তার সবই যুদ্ধক্ষেত্র নয়। পুরো বিষয়টিই গোপন রাখা হয়। কংগ্রেস এর কিছুটা জানলেও জনগণের থেকে আড়ালেই রাখা হয় এই প্রকল্প। ওবামার কৃতিত্ব এটুকুই যে, তিনি প্রকাশ্যে এ নিয়ে কথা বলেন। যদিও ২০১৩ সালের মে মাসে হোয়াইট হাউজ থেকে ড্রোন পরিচালনার নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সমালোচকরা মনে করেন তা অনুসরণ করা তো হচ্ছেই না বরং প্রশাসন এর অপব্যবহার করবে।   

ড্রোনের মতোই সব রকম বিমান হামলাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত। জাপানে আণবিক বোমা ফেলার ছয় মাস আগে জার্মানিতে বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের যৌথ বাহিনী। এতে কত মানুষ মারা গিয়েছিলো তা স্পষ্ট করে জানা না গেলেও সংখ্যাটি ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজারের মধ্যে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। যে কোনও সেনা হামলা, বিশেষত অনেক ওপর থেকে ফেলা বোমাই মানবতার জন্য হুমকিস্বরূপ। 

শুধু বোমাই নয়, আজকের পৃথিবীতে শত শত মানুষ ক্রসফায়ারে মরে যাচ্ছে। এদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলেও চলবে না আমাদের। কুন্দুজ ও আফগানিস্তানে কর্মরত ‘ডক্টরস উইদাউথ বর্ডার’ নামের একটি সংস্থা পরিচালিত হাসপাতালের ওপর বোমা ফেলা হলে ৪২ জন রোগীর মৃত্যু হয়। অথচ ওই হাসপাতালটি আন্তর্জাতিক আইন দিয়ে সুরক্ষিত থাকার কথা ছিলো। অনেকেই এই হামলাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কয়েক সপ্তাহ তদন্তের পর প্রেসিডেন্ট ওবামার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করা হয় ও নিহতদের পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।  

 

আণবিক বোমামুক্ত পৃথিবী

মানুষ সাধারণভাবে মনে করে হিরোশিমায় আণবিক বোমা যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। রাজনীতিবিদ, নেতা ও কূটনীতিকরা আমাদের এমনটাই বুঝিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অস্ত্রগুলো এখনও অস্তিত্বশীল। মানবতা এখনও ঝুঁকি ও হুমকির মধ্যেই রয়েছে। 

পারমাণবিক বোমামুক্ত পৃথিবী তৈরি করতে হলে কী কী করতে হবে তার একটি তালিকা তৈরি করা যেতে পারে। যাদের পারমাণবিক অস্ত্র নেই তারা অস্ত্র তৈরি করবে না বা কিনবে না, জঙ্গিদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র পৌঁছাতে দেওয়া যাবে না, বিভিন্ন পর্যায়ের চুক্তি ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে যা কঠিন তা হচ্ছে, এ জন্য নৈতিক ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সবচেয়ে কঠিন হচ্ছে এমন একটি শান্তিপূর্ণ পৃথিবী সৃষ্টি করা যেখানে কেউই আণবিক বোমার প্রয়োজন বোধ করবে না।  

 

ডাস্টিন এক্স যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক একজন লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট। তিনি মূলত শান্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে লেখালেখি করেন।

/এএ/বিএ/

সম্পর্কিত
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা