X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

এখনও অপেক্ষায় হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুলের পরিবার

বাংলা ট্রিবিউন ডেস্ক
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৭:৩৫আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১০:৪৪
image

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে চালানো জঙ্গি হামলার ক্ষত এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেননি ক্ষতিগ্রস্তরা। দেশজুড়ে ভয় আর আতঙ্কের জন্ম দেওয়া ওই হামলা ও কমান্ডো অভিযানে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা, বেকারির দুই কর্মী এবং পাঁচ জঙ্গিসহ ২৯ জন। ওই ঘটনার পেরিয়েছে দুই মাস, তবুও উত্তর মেলেনি বহু প্রশ্নের। এমনকি হামলাটি কারা চালিয়েছে, তা নিয়েও মতভিন্নতা রয়েছে। হামলার পরদিন সকালে জিম্মি উদ্ধারে চালানো কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদারও নিহত হন। নিরাপত্তাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই অভিযানে ছয় জঙ্গি নিহত হয়েছে। প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, নিহত পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে সাইফুল ইসলামও রয়েছেন।

হলি আর্টিজানের শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদার

এখনও নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন তার স্ত্রী সোনিয়া আখতার, অপেক্ষা করছেন স্বামীর মরদেহ ফিরে পাওয়ার। শেফ সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের স্ত্রী সোনিয়া আখতারের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র সাংবাদিক অ্যানবারাসান এথিরাজান। সেখানে উঠে আসে এমন অনেক প্রশ্ন, এখনও যার উত্তর খুঁজে ফিরছেন তিনি।

সাধারণত প্রতি রাতে স্বামীর সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন সোনিয়া আখতার। উৎকণ্ঠা নিয়ে সাইফুল সাত মাসের গর্ভবতী স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইতেন। কিন্তু ১ জুলাই রাতে স্বামীর কোনও ফোন পাননি সোনিয়া আখতার। কিছুটা অবাক হলেও সে রাতের মতো শুয়ে পড়েন সোনিয়া।

ওই রাতে আর অন্য দশটা রাতের মতো ঘুম হয়নি তার। মধ্যরাতে কেউ একজন তাকে জানায়, তার স্বামীর কর্মস্থল হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে হামলা চালানো হয়েছে। স্বামীকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন তিনি।

মরিয়া হয়ে বারবার স্বামীর মোবাইলে কল দিতে থাকেন সোনিয়া আখতার। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোনও সাড়া নেই। অন্য কোনও বিকল্প না পেয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে টেলিভিশনের খবর দেখে রাত কাটান এ সন্তানসম্ভবা নারী।

ভয়ে কুঁকড়ে যান সোনিয়া আখতার। সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটাই দানা বাঁধে তার মধ্যে। ততক্ষণে খবর আসে, একটি কথিত ইসলামপন্থী গ্রুপ এরইমধ্যে হলি আর্টিজান বেকারিতে জিম্মি ২০ ব্যক্তিকে খুন করেছে। খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অধিকাংশই বিদেশি। এখানেই পিৎজা শেফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার স্বামী।

সকালে খবরে বলা হলো, হলি আর্টিজানের কর্মীদের অধিকাংশই নিরাপদে আছেন। রাতভর দুঃশ্চিন্তার পর এতটুকু আশার আলো। কিন্তু সে আলো নিভতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ভয়ঙ্কর খবরটি পৌঁছালো তার কাছে। রাতভর জিম্মি ঘটনার পর কমান্ডো অভিযানে হলি আর্টিজানের একমাত্র কর্মী হিসেবে নিহত হন সাইফুল ইসলাম চৌকিদার।

গুলশান হামলার সপ্তাহখানেক পর হাসপাতালে পুলিশ হেফাজতে মারা যান হলি আর্টিজানের আরেক কর্মী জাকির হোসেন শাওন। পুলিশ জানিয়েছে, তিনি ওই হামলায় আহত হয়েছিলেন। তবে শাওনের পরিবার ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি-র কাছে দাবি করেছে, তাকে নির্যাতন করা হয়েছে।

শরীয়তপুরের নিজ গ্রামে বিবিসি-র কাছ থেকে ফোন পেয়ে কাঁদতে শুরু করেন সোনিয়া আখতার। এ কান্নায় যেন সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও ভাষা নেই। ঈদের কদিন আগেই সংঘটিত হয় গুলশান হামলা। ওই ঈদে বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের। সাত এবং নয় বছর বয়সী দুই কন্যা সন্তানের জন্য ঈদের উপহারসামগ্রী কেনার পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু এর আগেই সব শেষ হয়ে গেলো। অধরাই থেকে গেলো সাইফুলের স্বপ্ন।

কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে সোনিয়া আখতার বললেন, ‘এখন কিভাবে কি হবে? তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য। দুই মেয়েকে নিয়ে আমি এখন কি করবো?’

সোনিয়ার আখতারের দুর্ভোগের কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইসলামি নিয়ম অনুযায়ী সম্মানজনকভাবে সাইফুল ইসলাম চৌকিদারকে দাফন করতে চেয়েছিল তার পরিবার। কিন্তু সাইফুলের মরদেহ হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ।

পুলিশের দাবি, রেস্টুরেন্টের শেফ সাইফুল ওই হামলার একজন সন্দেহভাজন। ফলে এ বিষয়ে অনুসন্ধানে সময়ের প্রয়োজন রয়েছে।

সোনিয়া আখতার বলেন, ‘খবরটি শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে পড়লাম। তিনি নির্দোষ। তার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই। আমাদের শুধু একটা অনুরোধ, দয়া করে তার মরদেহ হস্তান্তর করুন। আমরা তাকে দাফন করতে চাই।’

সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের মৃত্যু এখনও গুলশান হামলার এক অমীমাংসিত রহস্য।

সাইফুল ইসলামের স্ত্রী সোনিয়া আখতার ও দুই সন্তান

এটা পরিষ্কার নয় যে, কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে এবং কে তাকে হত্যা করেছে। কিভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে দাবি করা হচ্ছে সেটাও স্বচ্ছ নয়। পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই তাকে ‘নিদোর্ষ’ দাবি করা হচ্ছে। এখনও সাইফুলের বিরুদ্ধে কোনও ‘সন্দেহভাজন’ হওয়ার কোনও প্রমাণও সামনে আসেনি।

সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের সহকর্মীরা জানিয়েছেন, জঙ্গিরা যখন গুলি ও বোমা ছুড়তে ছুড়তে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে তখন প্রধান ফটকের পাশেই পিৎজা তৈরি করছিলেন সাইফুল। জিম্মি ঘটনার পর সাইফুলকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়।

বাস্তবে আসলে কি ঘটেছিল সেটা একটা রহস্য। এমনকি নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ তাকে ‘সন্দেহভাজন’ বলে উল্লেখ করলেও বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত নয়।

গুলশান হামলার কয়েকদিন পর কিছু কর্মকর্তারা জানান, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা হয়তো ভুল করে সাইফুলকে গুলি করেছে।

অন্য এক প্রতিবেদনে পুলিশের বরা দিয়ে বলা হয়েছে, গুলশান হামলার জিম্মি সাইফুলের ক্ষেত্রে তাদের ভুল হয়েছে। কিন্তু গুলশানের ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তার নিহত হওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত নয়।

পরে অবশ্য এসব খবর অস্বীকার করে কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি, সাইফুল ইসলাম চৌকিদার একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর দাবি, তারা এ হামলা পরিচালনা করেছে। আইএস-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ওয়েবসাইটে পাঁচজনের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, তারা এ হামলায় যুক্ত ছিলেন।

পরে আইএস-এর দাবি করা ওই হামলাকারীদের নাম প্রকাশ করে পুলিশ। সেখানেও ওই পাঁচজনের মধ্যে ছিলেন না সাইফুল ইসলাম চৌকিদার।

আইএস গুলশান হামলার দায় স্বীকার করলেও, এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে কর্তৃপক্ষ। তারা বলছেন, এ হামলা চালিয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত স্থানীয় জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

হলি আর্টিজানে সহকর্মীদের মধ্যেও জনপ্রিয় ছিলেন সাইফুল ইসলাম চৌকিদার। তার সহকর্মীরাও এটা বিশ্বাস করেন না যে, সাইফুল ওই হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন।

গুলশান হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি ছিলেন হলি আর্টিজানের সহকারী শেফ। তার দাবি, সাইফুল জঙ্গি ছিলেন – এমন দাবি সত্য নয়, এটা পুরোপুরি অসত্য।

মো. দেলাওয়ার হোসেন বলেন, ‘সাইফুল ছিলেন খুবই ভালো মানুষ। আমরা তার কোনও বাজে আচরণ দেখিনি। তিনি এখানে শুধু একজন শেফ ছিলেন। আমাদের মতোই রেস্টুরেন্টের একজন কর্মী। এর বাইরে কিছুই নয়।’

একজন সুখী মানুষ

হলি আর্টিজান বেকারির অন্যতম মালিক আলী আরসালান। তিনিও দরদ নিয়ে সাইফুলের শেষ সময়ের স্মৃতিচারণা করেন।

আলী আরসালান বলেন, ‘হামলা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আমি এক বন্ধুকে দেওয়ার জন্য তার কাছ থেকে কয়েকটি পিৎজা সংগ্রহ করি। সে আমাকে একজন বাড়তি লোকের প্রয়োজনীয়তার কথা জানালো।’

তিনি বলেন, এই পিৎজা শেফ ছিলেন ‘একজন সুখী মানুষ এবং কঠোর পরিশ্রমী’।

সাইফুল ইসলাম চৌকিদার

পুলিশ বলছে, সাইফুল ইসলাম চৌকিদার এখনও একজন সন্দেহভাজন। জঙ্গিদের সঙ্গে তার যোগসাজসের বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান বিবিসি-কে বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমরা এই ঘটনায় তার ভূমিকা সম্পর্কে বলতে পারবো।’ তিনি জানান, আরও ফরেনসিক পরীক্ষা এবং তদন্ত প্রতিবেদন বাকি থাকায় তারা সাইফুলের মরদেহ প্রদানে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।

মাসুদুর রহমান আরও বলেন, ‘ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন সম্পন্ন করার পর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। পরিবারের সদস্যরা যদি মৃতদেহের জন্য আবেদন করেন তাহলে আমরা সেটি বিবেচনা করবো।’

সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা কারও কাছ থেকে কোনও আর্থিক সহায়তা পাননি। কোনও উপার্জন ছাড়া তারা কিভাবে বাঁচবেন সে বিষয়টিও তাদের কাছে অনিশ্চিত। তাদের আশা, এই সন্দেহভাজনের তালিকা থেকে তার নাম মুছে ফেলা হবে। তাদের আর সন্দেহের ছায়ার মধ্যে থাকতে হবে না।

সোনিয়া আখতার বলেন, ‘আমার দুই কন্যা এখনও এত ছোট যে, তারা বুঝতে পারে না তাদের বাবার কি হয়েছে। তারা প্রতিদিন বাবার মোবাইলে কল করে কিন্তু সেটি তো এখন বন্ধ।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছোট মেয়ে এখনও মনে করে তার বাবা ঢাকাতেই আছেন এবং শিগগিরই তিনি উপহার নিয়ে বাড়ি ফিরবেন।’ সূত্র: বিবিসি।

/এমপি/এসএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া