X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঞ্চিতদের হয়ে ক্ষমতাশালীদের বিরুদ্ধে জীবনভর লড়াই করেছেন গ্যাভিন

ফাহমিদা উর্ণি
২৫ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:২০আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০১৬, ১৫:৩৩
image

ফুসফুস ক্যান্সারে ভোগার পর গত শনিবার আলোচিত গণমাধ্যম উইকিলিকসের অন্যতম পরিচালক ও সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের প্রতিষ্ঠাতা গ্যাভিন ম্যাকফাডিয়েন-এর জীবনাবসান হয়। গ্যাভিন ছিলেন একাধারে অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে উপেক্ষিত থাকা এ মানুষটি বাস্তব জীবনে কেমন ছিলেন? অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় কীইবা ভূমিকা ছিল তার? গ্যাভিন মারা যাওয়ার পর তার স্ত্রী এবং জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রতিরক্ষা ফান্ডের সদস্য সুসান বেনের পক্ষ থেকে সিআইজের প্রকাশিত এক বিবৃতিতে গ্যাভিনকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানিয়ে বলা হয়, ‘তিনি ছিলেন সাংবাদিকদের জন্য আদর্শ। সাংবাদিকতার পথে অনেক প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আজীবন নিরলস পরিশ্রম করেছেন।’ বেন আরও লেখেন, ‘সাংবাদিকের জীবন যেমন হওয়ার কথা তেমনই ছিল তার জীবন ও কর্ম। তিনি আজীবন বঞ্চিতের পক্ষে ও সুবিধাভোগীদের বিপরীতে কাজ করে গেছেন।’  গ্যাভিনকে নিয়ে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং ওয়ার্কশপ-এ একটি স্মৃতিচারণামূলক নিবন্ধ লিখেছেন চার্লস লেউয়িস। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি স্কুল অব কমিউনিকেশন-এর সাংবাদিকতার অধ্যাপক চার্লস লেউয়িস। তাছাড়া অনুসন্ধানী সংবাদ সংস্থা ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং ওয়ার্কশপ-এর প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী সম্পাদক তিনি। চার্লসের সেই স্মৃতিচারণার আলোকে গ্যাভিনের কাজ, অবদান, তার জীবনাচরণ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হল।

গ্যাভিন ম্যাকফাডিয়েন

যা নিয়ে করতেন গ্যাভিন

আইএমডিবি প্রোফাইল অনুযায়ী, গ্যাভিন একজন জ্যেষ্ঠ পরিচালক/প্রযোজক এবং তিনি ৫০টিরও বেশি অনুসন্ধানী টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কাজ করেছেন। পিবিএস ফ্রন্টলাইন, গ্রানাডা টেলিভিশনের ‘ওয়ার্ল্ড ইন অ্যাকশন’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-র ‘ফাইন কাট’, ‘প্যানোরমা’, ‘দ্য মানি প্রোগ্রাম’ ও ‘টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস’ অনুষ্ঠান এবং ব্রিটিশ চ্যানেল ফোর-এর ‘ডিসপ্যাচেস’ অনুষ্ঠানের কাজ করেছেন তিনি। শিশুশ্রম, পরিবেশগত দূষণ, রাজনৈতিক বন্দিদের ওপর নির্যাতন, ব্রিটেনের নব্য নাৎসী, নিকারাগুয়ার কন্ট্রা হত্যাকাণ্ড, যুক্তরাজ্যের শিল্প দুর্ঘটনা, চীনের সংগঠিত অপরাধ, সিআইএ-র ইতিহাস, সামুদ্রিক জলদস্যুতা, দক্ষিণ আমেরিকায় নির্বাচন জালিয়াতি, দক্ষিণ আফ্রিকার হীরার খনি এবং সংগঠিত অপরাধের সঙ্গে ফ্রাঙ্ক সিনাত্রার সংযোগ –এমন অনেক ইস্যুতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছেন গ্যাভিন।

উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু

মার্কিন নাগরিক গ্যাভিন ১৯৬০ এর দশকে উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। একইসময়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক লোয়েল বার্গম্যান ও চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেল মানও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। পরবর্তীতে মাইকেল মানের অস্কার মনোনয়ন পাওয়া ছবি ‘দ্য ইনসাইডার’-এর প্রাযুক্তিক পরামর্শদাতা ছিলেন গ্যাভিন। আর ওই ছবিতে লোয়েল বার্গম্যানের তামাক সংক্রান্ত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির সাহসিকতার কথা উঠে আসে। এইতো কয়েক বছর আগেও বার্কেলিতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্পোজিয়ামে লোয়েল, গ্যাভিন ও মানকে একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল।

লন্ডনে সিআইজে প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ

চার্লস-এর নিবন্ধে বলা হয়, ‘২০০৩ সালে লন্ডনে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (সিআইজে) প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার কাজ শুরু করেন গ্যাভিন। লন্ডনের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে ক্লাস নিতেন তিনি। সেসময় যুক্তরাজ্যে একটি অলাভজনক সংবাদ প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে তিনি আমার পরামর্শ জানতে চেয়েছিলেন। কারণ এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আইনগুলো ভিন্ন ভিন্ন।’  

চার্লস জানান, তিনিই গ্যাভিনের সঙ্গে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ স্থাপন করিয়ে দিয়েছিলেন আর সে প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে অর্থনেতিকভাবে সহায়তা করেছে। চার্লস জানান, সবসময় সিআইজে সামার স্কুল কনফারেন্সে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হতো এবং তিনি তাতে উপস্থিত হতে পেরে গর্ববোধ করতেন।

নিবন্ধে চার্লস বলেন, ‘২০০৬ সালে রাশিয়ার নির্ভীক সাংবাদিক আনা পোলিৎকবসকায়াকেও সিআইজে সামার স্কুলে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। আমাদের অল্প কিছুক্ষণের জন্য দেখা ও কথা হয়েছে। আর এর কয়েক সপ্তাহ পর মস্কোতে আনা হত্যার শিকার হন। ২০০৯ সালে সিআইজে’র আরেকটি সামার প্রোগ্রামে গ্যাভিন, সুসান (গ্যাভিনের স্ত্রী), আমার আমেরিকান বন্ধু ও সহকর্মী ডেভিড ডোনাল্ড, আরন পিলহফার এবং কিংবদন্তী ক্রীড়া সাংবাদিক অ্যান্ড্রু জেনিংস উপস্থিত ছিলেন। ১৯৯২ সালে প্রথম মস্কোতে অ্যান্ড্রু জেনিংস এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। একা একাই সসার অর্গানাইজেশন, ফিফার দুর্নীতির খবর সামনে নিয়ে এসেছিলেন।’

 

ডাটা জার্নালিজমের প্রসারে গ্যাভিনের ভূমিকা

সামার প্রোগ্রামে দেওয়া বক্তব্যে ডেভিড স্মরণ করেছিলেন ডাটা জার্নালিজম বা উপাত্তভিত্তিক সাংবাদিকতার প্রসারে গ্যাভিনের অকুণ্ঠ চেষ্টার কথা যা যুক্তরাজ্যের প্রবৃদ্ধি ও সফলতার ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। সামার স্কুলের শুরুর দিকের বছরগুলোতে ডেভিড ও আরনের দেওয়া উপাত্তভিত্তিক সাংবাদিকতার প্রশিক্ষণে গুটিকয়েক প্রশিক্ষণার্থী অংশ নিয়েছিলেন। যুক্তরাজ্যের সাংবাদিকরা তখনও সরকার ও অন্যান্য ডাটাবেজ এবং অনুসন্ধানী রিপোর্টিং-এর সংযোগ বুঝতে পারেনি। তবে তাতে গ্যাভিন হাল ছেড়ে দেননি। বছরের পর বছর ধরে ডেভিড আর আরনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ডেকে আনতেন তিনি। অবশেষে ২০০৮ সালে ডাটা ক্লাসে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যার বিস্ফোরণ হল।

চার্লসের নিবন্ধে বলা হয়, গ্যাভিন নিজে ডাটা জার্নালিস্ট ছিলেন না। কিন্তু তার দূরদর্শী চিন্তার কারণেই যে বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ডাটা জার্নারিজমের এতোটা প্রসার হয়েছে তা নিৰসন্দেহে বলা যায়।

অ্যাসাঞ্জ ও গ্যাভিন

আমুদে মানুষ ছিলেন গ্যাভিন

চার্লসের মতে, কিছু কিছু সাংবাদিক অন্যদের চেয়ে বেশি যোগাযোগমূলক হয়ে থাকেন। সবসময় আমোদ-প্রমোদের মধ্যে থাকেন। আর গ্যাভিন সেইসব মানুষদেরই একজন। এ প্রসঙ্গে গ্যাভিনের সঙ্গেকার একটি অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। চার্লস তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন এভাবে- ‘২০১১ সালে ইউক্রেনের কিয়েভে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে গ্যাভিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো খুব স্মরণীয়। আমাদের কনফারেন্স হোটেলের বেশিরভাগ জায়গাতেই উষ্ণতার ব্যবস্থা ছিল না। রাত-দিন সেখানে খুব ঠাণ্ডা ছিল। ঠাণ্ডার মাত্রা এতোটাই বেশি ছিল যে আমার ভয়ংকর রকমের ঠাণ্ডা লেগে গেল। গ্যাভিনের রুমটি যে হলওয়েতে ছিল সেখানেই আমার রুমটি ছিল। এক রাতে তিনি আমাকে এক বোতল ওয়াইন ভাগাভাগি করে খাওয়ার জন্য ডাকলেন। আমার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গল্প করলাম, হাসাহাসি করলাম। ঠাণ্ডার কথা কিছু আমি টেরই পেলাম না। এ স্মৃতি আমি কখনও ভুলব না।’     

গ্যাভিন আয়োজিত অসাধারণ এক জার্নালিজম কনফারেন্স

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে গ্যাভিন ও সিআইজে-এর উদ্যোগে যে কনফারেন্সটি আয়োজিত হয়েছিল তাকে অসাধারণ সাংবাদিক সম্মেলনগুলোর একটি বলে উল্লেক করেছেন চার্লস। ‘সিক্রেসি, সারভেইল্যান্স অ্যান্ড সেন্সরশিপ’ তথা ‘গোপনীয়তা, নজরদারি এবং সেন্সরশিপ’। চার্লস জানান, ওই সম্মেলনে ৫ শতাধিক সাংবাদিক অংশ নিয়েছিলেন। খ্যাতিমান সাংবাদিকরা সেখানে বক্তব্য রেখেছিলেন। তারা হলেন, সিমুর হার্শ, ডুনকান ক্যাম্পবেল, জেমস ব্যামফোর্ড, ডেনিয়েল এলসবার্গ, জন পিলজার, লোয়েল বার্গম্যান। জার্মানি ও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর বেশ কয়েকজন কমিউটার হ্যাকারও সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। লন্ডনে অবস্থিত ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ এবং বার্লিন থেকে লরা পয়েট্রাস ভিডিও লিংকের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন।  

চার্লসের মতে, গ্যাভিন চির অন্তরালে চলে গেলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শত শত তরুণ সাংবাদিককে তিনি জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন। তাদেরকে গ্যাভিন ও তার সহকর্মীরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন। আর সেইসব অনুসন্ধানী তরুণ সাংবাদিকের কাজের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন সবার হৃদয়ে।

/এসএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের পুরস্কার পেলেন কুবির চার শিক্ষার্থী
গরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগরমে বেড়েছে অসুখ, ধারণক্ষমতার তিন গুণ বেশি রোগী হাসপাতালে
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৯ এপ্রিল, ২০২৪)
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা ৫ টন কফি পাউডার জব্দ
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
পিএসসির সদস্য ড. প্রদীপ কুমারকে শপথ করালেন প্রধান বিচারপতি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন