X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতে আট মুসলিম ছাত্রনেতার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনায় তীব্র বিতর্ক

শাহেরীন আরাফাত
০১ নভেম্বর ২০১৬, ০৪:৪৫আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৬, ০৫:২৭
image

ভারতের মধ্যপ্রদেশে আট মুসলিম ছাত্রনেতা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন বলে দাবি পুলিশের। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ভোপাল কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এক কারারক্ষীকে হত্যার পর তারা পালিয়ে যান। তবে রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশের ভাষ্য ভিন্ন হওয়ায় ওই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। বিতর্ক রয়েছে উচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা একটি কারাগার থেকে বন্দিরা কোনও হাতিয়ার ছাড়াই কেমন করে পালালেন? পুরো প্রক্রিয়াকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে মন্তব্য করে এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলীয় নেতারা।

এখানেই নিহত হন ওই আট ছাত্রনেতা

পুলিশ কর্তৃপক্ষের দাবি, রবিবার গভীর রাতে ভোপাল কেন্দ্রীয় কারাগারের এক কারারক্ষীকে মেরে ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ছাত্রসংগঠন স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (এসআইএমআই – সিমি)-র আট সদস্য পালিয়ে যান। সেদিনই পলাতক ছাত্রনেতাদের খোঁজ দিতে পাঁচ লাখ রুপি পুরস্কারও ঘোষণা করা হয় রাজ্য সরকারের তরফে।

সোমবার সকালে ভোপালের অদূরে মালিখেড়া নামক একটি স্থানে পুলিশ ও এন্টি-টেরোরিজম স্কোয়াড (এটিএস)-এর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ওই কারাবন্দিরা নিহত হন বলে পুলিশ দাবি করে।

রাজ্য পুলিশের আইজি যোগেশ চৌধুরী জানান, ‘আমরা ওই আট জনের খোঁজ পেয়ে সেখানে গেলেই তারা আমাদের ওপর গুলি বর্ষণ করে। এরপর পুলিশের তরফে পাল্টা গুলি চালালে তারা নিহত হন।’

পুলিশের ভাষ্যমতে, রবিবার রাত ২টা থেকে ৩টার দিকে জেলের এক নিরাপত্তারক্ষীকে কাঁটাচামচ দিয়ে গলা কেটে খুন করে ওই আট ছাত্রনেতা। জেলের লম্বা দেওয়ালে চাদর দিয়ে দড়ি টাঙিয়ে পালায় তারা।

তবে পুলিশ ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বলে দাবি করলেও মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি-র রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুপেন্দ্র সিং বলেছেন, ‘ওই আটজন কাঁটাচামচ দিয়েই পুলিশকে হামলা করেছিলেন। তখন পুলিশের গুলিতে তারা নিহত হন।’ 

ভারতে আট মুসলিম ছাত্রনেতার ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনায় তীব্র বিতর্ক

ওই ঘটনার পর ঘটনাস্থলের একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। যেখানে নিহতদের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর তাদের খুব কাছ থেকে গুলি করছেন এক পুলিশ সদস্য। কিন্তু তাদের কাছে কোনও অস্ত্র দেখা যায়নি। এক পুলিশ (এটিএস) সদস্যকে দেখা যায়, এক মরদেহের প্যান্টের পকেট থেকে ছুরির মতো কিছু একটা বের করতে। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই সেখানে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র দেখা যায়নি।

কাঁটাচামচ দিয়ে একজন কারারক্ষীর গলা কাটা এবং উচ্চ নিরাপত্তার কারাগার থেকে পালানোর পর আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে কাঁটাচামচ দিয়ে হামলা চালানো বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের ঘটনা এবং ওই ভিডিও প্রকাশের পর ওই  ঘটনায় সন্দেহ পোষণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন। বিরোধী দলগুলোও একে প্রশ্নবিদ্ধ করে তপদন্ত দাবি করেছে।

মধ্যপ্রদেশের বিরোধী দল অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম)-এর নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ‘রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পুলিশকর্মকর্তাদের বক্তব্যের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, ওই বিচারাধীন ব্যক্তিরা কাঁটাচামচ দিয়ে হামলা চালিয়েছেন। যদি কাঁটাচামচই তাদের হাতিয়ার হয়ে থাকে, তাহলে মধ্যপ্রদেশের এটিএস সহজেই তাদের ধরাশায়ী করতে পারতো। কারণ তাদের কাছে সেই মানের অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। তারা ওই ব্যক্তিদের সহজেই গ্রেফতার করতে পারতেন। কিন্তু কারারক্ষীকে হত্যা করে কারাগার ভেঙে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের হাতিয়ার কেবল ওই চামচ, যা যে কোনও সাধারণ মানুষের কাছেই থাকে। এই তত্ত্ব অবিশ্বাস্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘আরও অবাক করা বিষয় হলো, ওই বিচারাধীন ব্যক্তিরা ভালো কাপড়-চোপড় পরা ছিলেন, ভালো ঘড়ি এবং জুতোও ছিল। এসব তো কারাগারে বিচারাধীন ব্যক্তিকে দেওয়া হয় না।’  

নিহত আট ছাত্রনেতা

রাজ্যের বিরোধী দল কংগ্রেসও এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে। জ্যেষ্ঠ কংগ্রেস নেতা কমল নাথ বলেন, ‘সিমি সদস্যরা এমনেক কারাগার থেকে পালালো, যা উচ্চ নিরাপত্তার কারাগার। আর এর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তারা গুলিতে নিহত হলেন। এখন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না। এখানে কোনও প্রমাণও নেই। আমি এই ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’  

মধ্যপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা দিগ্বিজয় সিং টুইটারে প্রশ্ন তুলেন, সিমি সদস্যরা পালিয়েছেন, নাকি এমনটা সাজানো হয়েছে।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ও আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালও কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি টুইটারে বলেন, ‘এটা খুবই সাংঘাতিক বিষয়। আমরা সুপ্রিম কোর্টের অধীনে এর তদন্ত চাই।’

তবে বিজেপি-র কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা এসব দাবি ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। কংগ্রেসের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি এবং দিগ্বিজয় সিং-এর ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এর বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করার তীব্র সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুব্রমনিয়াম স্বামী। তিনি বলেছেন, ‘দ্বিতীয় বিয়ে করে দিগ্বিজয় সিং-এর মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কখন যে তিনি বলবেন, ওই কারারক্ষীকে আরএসএস মেরেছে।’  

‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ছাত্রনেতারা হলেন – মেহবুব গুড্ডু ওরফে মল্লিক, মোহাম্মদ খালিদ আহমদ, আমজাদ খান, মুজিব শেখ, মোহাম্মদ আকিল খিলজি, জাকির হোসেন সাদিক, মোহাম্মদ সালিক সাল্লু এবং আবদুল মজিদ।

তাদের মধ্যে মেহবুব, আমজাদ ও জাকির তিন বছর আগে অন্য একটি জেল থেকেও পালিয়েছিলেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। ২০১৩ সালেও মধ্যপ্রদেশের খান্ডওয়ারা কারাগার থেকে পালানোর ঘটনায় জড়িত ছিল সিমি-র ওই তিন সদস্য। সেসময় কারাগারের বাথরুমের দেওয়াল টপকে পালায় বন্দিরা।

এখানেই নিহত হন ওই আট ছাত্রনেতা

মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভুপেন্দ্র সিং কারাগারের ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার কথা স্বীকার করে জানান, ‘এই ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। জেলের ভেতরে থাকা বন্দিদের নিরাপত্তা খতিয়ে দেখতে কয়েকটি দল কাজ করছে।’

এই ঘটনায় তিন নিরাপত্তা রক্ষীকে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কারাগারের সুপারইনটেন্ডেন্ট অখিলেশ তোমারকেও  সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বন্দি পালানোর ঘটনার বিস্তারিত তথ্য রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।

পুলিশের সূত্রমতে, পলাতক আট সদস্যই ২০০৮ সালে আমেদাবাদ সিরিয়াল বোমা বিস্ফোরণ মামলা এবং দুই বছর আগে পুনে, করিমনগর ও চেন্নাইয়ের বিস্ফোরণেও জড়িত ছিল।

১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্র সংগঠন এসআইএমআই বা সিমি। এই সংগঠনটির বিরুদ্ধে নাশকতায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে ২০০১ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার। তবে এখনও পর্যন্ত ওই সংগঠনটির কোনও সহিংস কর্মকণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। 

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।

/এসএ/

সম্পর্কিত
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
ভারতের মণিপুরে হয়রানির শিকার হয়েছে সাংবাদিক-সংখ্যালঘুরা: যুক্তরাষ্ট্র
ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী নিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
সর্বশেষ খবর
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলেন তিন বিচারপতি
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
চুরি করা গরুসহ ট্রাক থামিয়ে পালিয়ে যায় চোরেরা, আগুন ধরিয়ে দিলো জনতা
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
বাংলাদেশ সফরের জিম্বাবুয়ে দলে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের ছেলে
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে  ইসরায়েল?
রাফাহ শহরে আবারও অভিযান চালাবে ইসরায়েল?
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা