X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের জয়

ফাহমিদা উর্ণি ও শাহেরীন আরাফাত
১১ নভেম্বর ২০১৬, ০৪:৩৪আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ০৪:৪৬
image

শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের জয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বুথফেরত জরিপগুলো বিশ্লেষণ করে স্পষ্ট দেখা গেছে, রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের নেপথ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ শ্বেতাঙ্গ ভোট। নারী-পুরুষ-তরুণ-বয়স্ক-শিক্ষিত-অশিক্ষিত নানান শ্রেণী-পেশা ও লিঙ্গের শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা তাকে ভোট দিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। জরিপের তথ্য ও বিশ্লেষকদের মন্তব্য থেকে ট্রাম্পের বিজয়কে তাই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের কারও কারও মত,  এই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য নিরঙ্কুশ হওয়ার পেছনের কারণটা অর্থনৈতিক। বিগত দশকগুলোতে মার্কিন সমাজের অভ্যন্তরে যে অর্থনৈতিক সঙ্কট, সেখানকার মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জীবনে যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক বাস্তবতা; বিশ্লেষকদের মতে সেটাকেই ব্যবহার করতে সমর্থ হয়েছিলেন ট্রাম্প।
শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী শ্রেণীর এই করুণ অবস্থার জন্য ট্রাম্প তার প্রচারণার সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী, মুসলিম সম্প্রদায়, এলজিবিটি কর্মী, আর কৃষ্ণাঙ্গদের তিনি বারবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শ্বেতাঙ্গদের দুর্ভোগের কারণ হিসেবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। আর তাই ডেমোক্র্যাটদের ওপর ক্ষোভ বেড়েছে শ্বেতাঙ্গদের। যেহেতু অভিবাসী, মুসলিম সম্প্রদায়, এলজিবিটি কর্মী, আর কৃষ্ণাঙ্গদের পক্ষে ডেমোক্র্যাটদের  অবস্খন মুুখে অন্তত ইতিবাচক, তাই হিলারিকে শত্রু ভাবতে শুরু করেন শ্বেতাঙ্গরা। । প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য। খোদ হিলারির সঙ্গে মনোনয়ন লড়াইয়ে নামা ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স তাই বলেন, ‘প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম, প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন মার্কিন মধ্যশ্রেণি।’

বুথ ফেরত জরিপের তথ্য অনুযায়ী, কেবল কর্মজীবী শ্বেতাঙ্গ ভোটার কিংবা শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা যে ট্রাম্পকে বেশি ভোট দিয়েছেন এমন নয়; বরং সামষ্টিকভাবেই শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের বিপুল সমর্থন পেয়েছেন তিনি। আর সেকারণে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও জিতে যান ট্রাম্প।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা জয় পেয়েছিলেন এমন বেশ কিছু শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের এলাকায় এবার ট্রাম্প জয় পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মোট ভোটারদের ৭০ শতাংশই শ্বেতাঙ্গ। এডিসন রিসার্সের বুথ ফেরত জরিপ অনুযায়ী, ৫৮ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ভোটার ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। আর হিলারি ক্লিনটনকে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৩৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ। অন্যদিকে মাত্র ৩০ শতাংশ অশ্বেতাঙ্গ ভোটারের মধ্যে হিলারি পেয়েছেন ৭৪ শতাংশ ভোট আর ট্রাম্প পেয়েছেন ২১ শতাংশ ভোট।

ট্রাম্প কর্মজীবী শ্বেতাঙ্গদের ভোট বেশি পেলেও ব্যাপারটা এমন নয় যে তিনি শ্বেতাঙ্গ শিক্ষার্থীদের ভোট কম পেয়েছেন। জরিপে দেখা গেছে, শ্বেতাঙ্গ কলেজ গ্র্যাজুয়েটদের প্রায় অর্ধেক অর্থাৎ ৪৯ শতাংশ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন। অশিক্ষিতদের ভালোবাসেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। আর তাতে তার প্রতি কলেজ ডিগ্রি নেই এমন শ্বেতাঙ্গদের সমর্থন অনেক বেশি দেখা গেছে। কলেজ ডিগ্রি থাকা শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের চেয়ে কলেজ ডিগ্রি না থাকা শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন অনেক বেশি পেয়েছেন তিনি। ১৯৭২ সাল থেকে রিপাবলিকানদের প্রতি কলেজ ডিগ্রি না থাকাদের এতটা সমর্থন দেখা যায়নি। কলেজ ডিগ্রি নেই এমন ৬৭ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ ভোটার ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন। আর হিলারিকে সমর্থন দিয়েছেন মাত্র ২৮ শতাংশ।

 ১১ বছর আগে দেওয়া একটি নারীবিদ্বেষী বক্তব্য গত ৭ অক্টোবর ফাঁস হওয়ার পর তুমুল সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন ট্রাম্প। এরপর একে একে তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ সামনে আসার পর নারীরা ট্রাম্পকে ভোট কম দেবেন বলে বিভিন্ন জরিপে আভাস দেওয়া হচ্ছিলো। বিশ্লেষকদের অনেকেও তেমনটাই ধারণা করেছিলেন। তবে সেইসব ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে বুথ ফেরত জরিপে। দেখা গেছে, শ্বেতাঙ্গ নারীদের ৫৩ শতাংশ ট্রাম্পকে এবং ৪৩ শতাংশ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করা শ্বেতাঙ্গ নারীদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ ট্রাম্পের জন্য ভোট দিয়েছেন। আর কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করেননি এমন ৬২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ নারী ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের জয়

 যুক্তরাষ্ট্রের ভোটারদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। শ্বেতাঙ্গ পুরুষ ভোটারদের মধ্যে ৬৩ শতাংশই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন বলে উঠে এসেছে জরিপে। আর শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের মধ্যে ৩১ শতাংশের ভোট পেয়েছেন হিলারি। শ্বেতাঙ্গ তরুণদের মধ্যেও ট্রাম্পকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে। ১৮-২৯ বছর বয়সী ৪৮ শতাংশ তরুণ ট্রাম্পকে আর ৪৩ শতাংশ হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ ফলাফল থেকে যা দেখা যায়, এক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের ডেমোগ্রাফিক উপকরণ কাজ করেছে। এ ব্যাপারে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির আন্তঃগোষ্ঠীগত সংঘাত বিষয়ক গবেষক জে ভান বাভেল বলেন, ‘নির্বাচন থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং বেশ কয়েকজন সমাজ মনস্তত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য এ নির্বাচনের মূল চালিকাশক্তি।’

বুথফেরত জরিপে দেখা গেছে, ট্রাম্পকে যারা ভোট দিয়েছেন বা সমর্থন করেন তারা অপেক্ষাকৃত ধনী। ট্রাম্পের সমর্থকদের বছরে গড় আয় ৭২ হাজার ডলার যা মধ্যম আয় ৫৬ হাজার ডলারের চেয়ে অনেক বেশি। হিলারি ক্লিনটন নারী, হিস্পানিক ও আফ্রিকান আমেরিকানদের ভোট বেশি পেলেও তা আশানুরূপ ভালো ছিল না। ২০১২ সালে বারাক ওবামার তুলনায় এবার হিলারি গুরুত্বপূর্ণ ভোটার গোষ্ঠীকে কম টানতে পেরেছেন।

ট্রাম্পকে নারীরা কম ভোট দেবেন এবং হিলারি বিপুল সংখ্যক নারীর সমর্থন পাবেন বলে ধারণা করা হলেও তা হয়নি। ৫৪ শতাংশ নারী হিলারিকে ভোট দিলেও তা ২০১২ সালে ওবামার পাওয়া নারীভোটের তুলনায় বেশি ছিল না। ২০১২ সালে ৫৫ শতাংশ নারী ওবামাকে ভোট দিয়েছিলেন। অথচ হিলারি আরও বেশি ভোট পাবেন বলে মনে করা হচ্ছিলো। ওবামার তরুণ ভোটারদের যতটা টানতে পেরেছিলেন এবার হিলারি তাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটারদের মধ্যে মাত্র ৫৫ শতাংশ হিলারিকে সমর্থন দিয়েছেন। অথছ ২০১২ সালে ৩০ বছরের কম বয়সী ৬০ শতাংশের ভোট পেয়েছিলেন ওবামা।

ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘জনগণ অধিক সময় ধরে শ্রম দিয়ে খুবই অল্প মজুরি পান। সেই সঙ্গে স্বল্প মজুরির জন্য বিনিয়োগ যাচ্ছে চীনের মতো দেশগুলোতে। আর এতে জাতীয় অর্থনীতি ব্যাহত হচ্ছে। ধনীরা আরও ধনী হচ্ছেন। আর সাধারণ মানুষ সন্তানদের কলেজেও পড়াতে পারছেন না।’ আর এসব কারণেই বিক্ষুব্ধ মার্কিনিরা পরিবর্তনের আশায় ট্রাম্পকে সমর্থন দিয়েছেন বলে স্যান্ডার্স মনে করেন।

আট বছরের ওবামা প্রশাসনের সময়ে অর্থনৈতিক বৈষম্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বেড়েছে। অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ মার্টিন ওলফ ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ লিখেছেন, ‘আর্থিক সংকট কেটে গেলেও তার দাগ থেকে যায়। আর তা আর্থিক, তাত্ত্বিক এবং নীতি-নির্ধারকদের পুরো ব্যবস্থার সামর্থ সম্পর্কে সন্দেহপ্রবণ করে তুলে। আর বিনিয়োগ কমে আসলে, তা সার্বিকভাবে অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলে।’

ওই একই লেখায় তিনি আরও উল্লেখ করেন, ‘২০১৪-১৫ সালে মার্কিন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫.২ শতাংশ। প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ছিল এর চেয়েও কম। ২০০০ সালে আর্থিক সংকটকালে প্রবৃদ্ধি যা ছিল, এবার তার থেকেও ছিল কম। এর ফলে মানুষের মধ্যে ভ্রান্তি তৈরি হওয়া স্বাভাবিক।’

সূত্র: ভক্স. দ্য টেলিগ্রাফ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ভাইস.কম

/বিএ/


 



সম্পর্কিত
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: ম্যাক্রোঁ
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
মহাকাশে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধে জাতিসংঘের ভোটে রাশিয়ার ভেটো
সর্বশেষ খবর
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা