X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় কাস্ত্রো ছিলেন ইস্পাত কঠিন

বিদেশ ডেস্ক
২৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:৪৮আপডেট : ২৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:৫১

ফিদেল কাস্ত্রো মুখে দাড়ি, পরনে জলপাই রঙয়ের সামরিক পোশাক, ঠোঁটে ধরা চুরুট আর নামের প্রথম অংশ ফিদেল দিয়েই বিশ্বজুড়ে পরিচিত তিনি। বিশ্বজুড়ে তাকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া,  প্রশংসাকারীদের বিপরীতে সমালোচনাকারীদেরও সংখ্যা কম না। তবে সবার কাছেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ এবং ইতিহাসের জন্মদাতা। ১৯৭২ সালে যখন কাস্ত্রোর হৃদরোগ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একটি ইস্পাতের হৃদয় রয়েছে’। পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবেলায় সত্যি সত্যি কাস্ত্রো তার ইস্পাতকঠিন হৃদয়ের প্রমাণ দিয়েছেন। হার মানেননি কখনও।

কাস্ত্রোর জীবনের ইতিহাস একভাবে গত শতাব্দিরই ইতিহাস বলা যায়। বিপ্লবী আন্দোলন, স্নায়ুযুদ্ধ, পূর্ব-পশ্চিম দ্বন্দ্ব, উত্তর-দক্ষিণ দ্বন্দ্ব কিংবা সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পূঁজিবাদের দ্বন্দ্ব ছিলো কাস্ত্রোর শাসনামালে। এসব কিছুতেই জড়িয়ে ছিলেন তিনি কিংবা মোকাবেলা করতে হয়েছে।

ফিদেল কাস্ত্রো

যুক্তরাষ্ট্রকে আমৃত্যু অগ্রাহ্য করেছেন কাস্ত্রো

গেরিলা বিপ্লবী ও বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে ওঠা ফিদেল কাস্ত্রো পুঁজিবাদী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের থাবার মধ্যে থেকেও ছোট রাষ্ট্র কিউবাকে ইতিহাসের স্বর্ণশিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমৃত্যু অগ্রাহ্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে।

এক সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন রাজনীতি থেকে কখনও অবসর নেবেন না। তবে মানুষের শরীর আর মনতো সব সময় এক সঙ্গে চলে না। ফলে একসময় শরীরের কাছে হার মানতে হয় বিপ্লবী মানসিকতার এ মানুষকে। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে জরুরি ভিত্তিতে অন্ত্রে অস্ত্রোপচারের পর ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে সাময়িক ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তিনি। এরপর ২০০৮ সালে পুরোপুরি ক্ষমতা থেকে অবসর নেন।

১৯৫৯ সালে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কিউবায় মার্কিন সমর্থিত একনায়ক বাতিস্ততাকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বিশ শতকের কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন ফিদেল ক্যাস্ট্রো। একইসঙ্গে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমৃত্যু বৈরি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ আর একের পর এক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই কাস্ত্রো ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেননি বিপ্লবী এ রাষ্ট্রনায়ক।

স্নায়ুযুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদের জয়জয়াকারের মধ্যেও সমাজতান্ত্রিক কিউবাকে টিকিয়ে রেখে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রবাদ পুরুষ হিসেবে পরিচিতি পান।

যদিও রাউল ক্যাস্ট্রোর শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার বৈরি সম্পর্কের অবসান ঘটতে থাকে। ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাভানার সম্পর্কের ক্রমেই উন্নতি ঘটে। এরপর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়ে তিনি বিশ্বকে অবাক করে দেন।

ফিদেল কাস্ত্রো

৬৩৮ বার কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র

কাস্ত্রোর ৯০ বছরের দীর্ঘ জীবনে ৬৩৮ বার তাকে হত্যার চেষ্টা করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এসব গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালিয়েছিল। কিউবার ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকেই কাস্ত্রো চেষ্টা করে আসছিলো সিআইএ। 

১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যেই কাস্ত্রোকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। সিআইএ, মার্কিন প্রতিরক্ষাবাহিনী ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাস্ত্রো হত্যা করতে বিভিন্ন সময় চেষ্টা চালায়।  সর্বশেষ হত্যাচেষ্টাটি করা হয় ২০০০ সালে। কাস্ত্রোকে হত্যায় মার্কিন চেষ্টা নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মিত হয়েছে। তাতে কাস্ত্রোকে হত্যার যে বিভিন্ন উপায় ও পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেগুলো তুলে ধরা হয়।

কাস্ত্রো

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতায় লাতিন রাষ্ট্রের বন্ধু

ক্ষমতা গ্রহণের পর দৃঢ়হাতে শাসন করেছেন কাস্ত্রো। বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে কখনও দ্বিধান্বিত হননি। বেশিরভাগ বিরোধিতাকারীদের কারাগারে পাঠিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার মুখে তাকে দেশ চালাতে হয়েছে। মোকাবেলা করতে হয়েছে মুক্ত বাণিজ্যের মতো জাতীয় স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপের।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতাকারী লাতিন দেশগুলোকে সহযোগিতার ওই অঞ্চলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন কাস্ত্রো। এমনকি বিশ্বের যে কোনও দেশের তুলনায় কিউবার সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠাও তাকে মহান করে তুলেছে। স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপক উন্নতি ও শিক্ষার হার বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিউবা ছিলো বিশ্বের কাছে অনন্য উদাহরণ। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছে কাস্ত্রোর কিউবা।

শুধু চিকিৎসক নয়, বিভিন্ন দেশে বিপ্লবীদের সহযোগিতায়ও হাত বাড়িয়েছেন তিনি। অ্যাঙ্গোলা ও ইথিওপিয়াতে সেনা পাঠিয়েছেন তিনি। নিজ মহাদেশে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবে ছিলো তার অবদান। যুক্তরাষ্ট্রে রিগ্যান শাসনামলে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে সেন্ট্রাল আমেরিকা দখলের চেষ্টা করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।  গ্রেনাডার বিপ্লবীদের কিউবার সহযোগিতার মুখে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ণদখল অভিযান পরিচালনা করে।

অমর হয়ে থাকবেন মানুষের হৃদয়ে

কিউবায় এ বিপ্লবী নেতার নামে নেই কোনও সড়ক। সম্মান জানাতে নেই কোনও ভাস্কর্য। কারণ ফিদেল কাস্ত্রোর এগুলোর কিছুই প্রয়োজন পড়ে না। তার কাজ ও নেতৃত্বের স্বীকৃতি তিনি পাচ্ছেন কিউবার অগ্রগতি দিয়ে, তার জীবন-যাপন দিয়ে।

কিউবার ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করছে বিনামূল্যে। পরিবারগুলো রেশনে পাচ্ছে টয়লেট পেপার, অবসরপ্রাপ্তরা পাচ্ছেন বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা, পত্রিকাগুলোর পাতা ভর্তি থাকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণায়। আর এসব কিছুর পেছনেই এক ব্যক্তির অবদান: ফিদেল কাস্ত্রো। ফলে কিউবায় কাস্ত্রোকে সম্মান জানাতে কিংবা পরিচিত করাতে কোনও বিশেষ কিছু করতে হয় না।

ফিদেল কাস্ত্রো

ইতিহাসবিদেরা কাস্ত্রোকে নিয়ে দশকের পর দশক হয়ত তর্ক করে যাবেন। কিউবায় বিপ্লবের সফলতা ও ব্যর্থতা পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরবে। সম্প্রতি কিউবার যুক্তরাষ্ট্র নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার তাতে রসদ জোগাবে। তবুও কাস্ত্রো শাসনাধীন প্রায় অর্ধ শতাব্দির কিউবা ফিদেলিজমো বা ফিদেলবাদ হিসেবেই পরিচিত থাকবে।

কিউবার সর্বোচ্চা নেতা ছিলেন কাজ পাগল। যিনি ক্যারিবিয় ছোট্ট দ্বীপকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরীক্ষাগার বানিয়ে বিশ্বকে উৎসাহিত করেছেন।  দ্য কিউবা ওয়ার্স বইয়ের লেখক ও মার্কিন চিন্তাবিদ ড্যান এরিকসন বলেন, ১৯৫৯ সালে ফিদেল যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন কেউ ভাবতেই পারেনি তিনি পুরো কিউবার সমাজকে পরিবর্তন করতে পারবেন বলে। লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্ব বিবেচনা করে সেখানে পাল্টা বৈশ্বিক ধারা সূচনা করবেন কাস্ত্রো এটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু কাস্ত্রো তা করে দেখিয়েছেন।

সবমিলিয়ে গত শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতায় পরিণত হন কাস্ত্রো। এমনকি মৃত্যুর পূর্বে ও রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার পরও তিনি হয়ে ওঠেন আরও বেশি ঐতিহাসিক। যদিও কাস্ত্রো বেঁচে থাকতেই অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছিল।  শুধু পাল্টাননি তিনি। সোভিয়েত রাশিয়াসহ সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর পতন হওয়ার পরও ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রতীক। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, রাশিয়া টুডে, বিবিসি।

/এএ/

সম্পর্কিত
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দেওয়া ব্যক্তির মৃত্যু
ট্রাম্পের বিচার চলাকালে আদালতের বাইরে গায়ে আগুন দিলেন এক ব্যক্তি
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা