X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
বিপন্ন রোহিঙ্গা সম্প্রদায়

পোড়া ঘর, হারানো স্বজন আর হত্যা-ধর্ষণের গল্প বলে চলেন তারা...

বিদেশ ডেস্ক
০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:৫৬আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ২০:২৫
image

মোহসেনা বেগম ২০ বছর বয়সী রোহিঙ্গা মোহসেনা বেগম। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সহিংসতায় স্বামীকে হারিয়েছেন। নিজেও হয়েছেন ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার। হারিয়েছেন ঘর-বাড়ি। উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন মোহসেনা। শুরুতে বিজিবির বাধার মুখে পড়লেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন তিনি। মোহসেনার মতো আরেক রোহিঙ্গা ওসমান গণি। পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে নদী সাঁতরে বাংলাদেশে আসেন তিনি। মার্কিন বার্তাসংস্থা এপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোহসেনা ও গণি বর্ণনা করেছেন কিভাবে স্থানীয় আর সেনা সদস্যদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে তাদের গ্রামের বাসিন্দাদের।

এভাবেই ফেলে আসা পোড়া ঘর, ধর্ষণের দুঃসহ স্মৃতি, বীভৎস হত্যাকাণ্ড আর ছেড়ে আসা স্বজনের গল্প উঠে আসে রোহিঙ্গা সম্পদ্রায়ের মানুষের মুখ থেকে। উঠে আসে মিয়ানমার নামের এক জাতিরাষ্ট্রের সীমায় 'অনাগরিক'তার দুঃসহ যন্ত্রণার গল্প। 
মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার হওয়ার, নিজেদের চিরচেনা ঘর-বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি এবং বাংলাদেশে আসার গল্প বলেছেন মোহসেনা ও গণি। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, মোহসেনা ও গণির মতো এমন হাজারো রোহিঙ্গা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দমন-নির্যাতনের শিকার হওয়ার অভিযোগ করলেও বিপরীতে মিয়ানমার সরকার দাবি করছে এগুলো ঘটনার অতিরঞ্জন। অথচ ঘটনাস্থলে বহিরাগতদের এমনকি সাংবাদিকদেরও প্রবেশে বাধা দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। আর মোহসেনার মতো নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বলছেন, নিজেদের গ্রামে যে ভয়াবহতা দেখেছেন তা অতিরঞ্জিত করার দরকার পড়ে না।

মোহসেনা মিয়ানমারের কাইরা ফারা গ্রামের বাসিন্দা। যেদিন ঘরহারা হয়েছেন সেদিনের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে এপিকে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদেরকে ঘর-বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। নারী ও পুরুষকে আলাদা আলাদা সারিতে দাঁড় করিয়ে, হাত ভাঁজ করে মাথার পেছনে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে।’ মোহসেনা জানান, সকালের দিকে বাড়িতে বাড়িতে হানা দেয় মিয়ানমারের সেনারা। ঘর-বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এরপর গ্রামবাসীকে এক জায়গায় জড়ো হওয়ার জন্য বাধ্য করে। ওই অবস্থায় যারা ক্ষেত-খামারের দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদেরকে গুলি করা হয়। আর তখন বেশিরভাগ মানুষই ভয়ে পালানোও বন্ধ করে দেন। স্থানীয় এবং সেনা সদস্যরা মিলে ৫০ জনের মতো লোক সম্মিলিতভাবে চার গ্রামের নেতাদেরকে ভীড় থেকে টেনে নিয়ে আসে এবং তাদের গলা কেটে দেয়।
মোহসেনা বলেন, চার গ্রাম্য নেতাকে হত্যার পর গ্রামজুড়ে সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। অন্য কয়েকজন গ্রামবাসীর সঙ্গে তার ক্ষেতমজুর স্বামীকেও পিটিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহগুলোকে একটি ট্রাকে করে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও জানান মোহসেনা। তিনি জানান, হামলাকারীরা তার কোল থেকে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে যায়। এরপর তাকে ধর্ষণ করে। কিন্তু সেনা সদস্যরা সেদিকে দৃষ্টিপাতই করছিলেন না। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে আঁকড়ে ধরে পাশের পাহাড়ের দিকে ছুটে যান। সেখানে দুইদিন লুকিয়ে থাকার পর তার ভাই তাকে ৩৮ ডলার সমপরিমাণ অর্থ দেয় যেন সে টাকাগুলো দালালদের দিয়ে মোহসেনা ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবির সদস্যরা তাদেরকে আটকে দেন। আর তাতে কান্না শুরু করেন মোহসেনা। তিনি বলেন, ‘আমি তাদেরকে বললাম ওই দেশে আমাকে রক্ষা করার কেউ নেই। আমার সন্তানকে দেখুন। আমি ফিরে গেলে ও মরে যাবে।’ মোহসেনা জানান, এরপর বিজিবি সদস্যরা তাকে ছেড়ে দেন।

মোহসেনার মতো ঘরহারা আরেক রোহিঙ্গা ওসমান গণি জানান, গত ১১ নভেম্বর তার গ্রাম গৌজো বিলে হামলা হয়। নাফ নদীর কাছে দাঁড়িয়ে থাকা গণি এপির কাছে সেদিনের সেই ভয়াবহতার বর্ণনা দেন। আরবির শিক্ষক গণি বলেন, ‘তারা আসলো এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করতে লাগল। তারা আমাদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিলো। আমাদেরকে বাঁচানোর কেউ ছিল না।’

মিয়ানমারে গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
ওসমান গণি জানান, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গ্রামের কাছাকাছি একটি জায়গায় লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু তল্লাশি জোরালো হওয়ায় এবং পুরুষদের লক্ষ্য করে করে সেনা সদস্যরা আক্রমণ শুরু করায় পরিবারকে রেখেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। গণি বলেন, ‘তাদেরকে ফেলে আসা ছাড়া আমার অন্য কোনও উপায় ছিল না। আমি নদীর তীরে এলাম এবং সাঁতার কাটতে শুরু করলাম।’ তিনি জানান কয়েকদিন পর তার পরিবারও বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়।

‘তারা (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) আমাদের ওপর দমন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং বিমান থেকে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। লোকজনকে আমার বাড়ির সামনে হত্যা করা হয়েছে। মেয়েদেরকে ধাওয়া করেছে এবং গুলি করে মেরেছে। তারা অনেক মানুষকে পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাড়ির সামনে তাদের পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি ভিডিও করেছি। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না, পুড়ে যাওয়া দেহ?’  

এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসমান গণি যখন পালিয়ে আসছিলেন তখন পথে যতগুলো রোহিঙ্গা গ্রাম পেয়েছেন সেগুলোর নৃশংসতার চিত্র ভিডিওতে ধারণ করেছেন। সেখানে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে কিছু পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এপি জানায়, দেহাবশেষগুলো বাচ্চাদের বলে মনে হয়েছে। কয়েকটি ভিডিওতে গণির কণ্ঠস্বর শোনা গেলেও ভিডিওর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে এপি।

ওসমান গণি
মিয়ানমারে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাস করে। কিন্তু, সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা তাদেরকে দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকার তো করেই না বরং এসব রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করে থাকে। এ বছর অক্টোবর মাসের ৯ তারিখে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এলাকায় সন্ত্রাসীদের সমন্বিত হামলায় ৯ পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর তার দায় চাপানো হয় রোহিঙ্গাদের ওপর। আর তখন থেকেই শুরু হয় সেনাবাহিনীর দমন প্রক্রিয়া। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের দাবি, এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে 'ক্লিয়ারেন্স অপারেশন' চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইসলামি চরমপন্থা দমনে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন তারা। আর তা এমন কঠোর প্রক্রিয়ায় চালানো হচ্ছে যে সেখানে কোনও বহিরাগত এমনকি সংবাদমাধ্যমকেও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। অবশ্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিক কফি আনানকে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি যাচাইয়ে গঠিত একটি তদন্ত কমিশনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কফি আনান।  

রাখাইন রাজ্যে এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টির পরেও চলমান দমন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি অস্বীকার করে দায় এড়াতে চাইছে দেশটির সরকার। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের বাড়িঘর পোড়াচ্ছে বলেও দাবি করছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষ। এমনকি শান্তিতে নোবেলজয়ী মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিও অভিযোগ করেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের চলমান অস্থিরতার নেতিবাচক দিকই কেবল দেখছে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘পুলিশের আউটপোস্টে হামলার সত্যতা এড়িয়ে কেবল যদি পরিস্থিতির নেতিবাচক দিকের প্রতিই সবাই মনোযোগ দেন তবে তা কাজে আসবে না। সবাই যদি সংকটকে শনাক্ত করতে পারে এবং সেগুলো অতিরঞ্জিত না করে সমাধানের ব্যাপারে বেশি উদ্যোগী হয় তাহলে তা কাজে আসবে। তবে মোহসেনার মতো নির্যাতিত রোহিঙ্গারা বলছেন, বাস্তবে যা ঘটছে তা এতটাই ভয়াবহ যে অতিরঞ্জিত করার দরকার পড়ে না।

পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, গত মাসে ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ১৯৭০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে বসবাস করা অনথিভুক্ত ৫ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে তারাও যুক্ত হয়েছেন। কক্সবাজার জেলায় ৩৩ হাজারের মতো নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা বসবাস করেন। এপির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদেরকে স্বাগত না জানালেও, মিয়ানমারের তুলনায় এ দেশকে নিরাপদ আশ্রয় বলে মনে করা হয়।  

/এফইউ/

সম্পর্কিত
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
টাঙ্গাইল শাড়িসহ ১৪ পণ্যকে জিআই স্বীকৃতি
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
১৮ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন বিসমাহ মারুফ 
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে পিতার মৃত্যুদণ্ড
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতার শঙ্কা সিইসির
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না