এক সময় গান গেয়ে তরুণদের মনে ঝড় তুলেছেন। এরপর হঠাৎ করেই ঘোষণা দিলেন আর গান গাইবেন না। শুরু করলেন ব্যবসা। সফল হলেন তাতেও। তবুও থেমে যাননি। শুরু করেন ইসলামি সংগীত গাওয়া। একই সঙ্গে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা দিয়ে নিজেকে পরিণত করেন ইসলামি বক্তায়। জনপ্রিয়তা পান এখানেও। হয়ে যান পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় উপস্থাপকে। ফলে তার একাধিক পরিচয়। একজন সফল শিল্পী হিসেবেই ভাবতে পছন্দ করেন পাকিস্তানের মানুষেরা। গান গাওয়ার জন্য এক সময় যারা বিরোধিতা করতেন তারাও পরে জুনায়েদের ইসলামি বক্তব্য শুনতে টিভি পর্দায় চোখ রাখতেন। ফলে সংগীত জগৎ থেকে শুরু করে ধর্মীয় জগতে তিনি ছিলেন সমান জনপ্রিয়। তিনি পাকিস্তানের শিল্পী জুনায়েদ জামশেদ।
পপ তারকা থেকে ইসলামি বক্তা হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটা জুনায়েদ জামশেদের জন্য সহজ কাজ ছিল না। পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমগুলোতে তাকে নিয়ে সমালোচনা ও পূজা দুটোই হয়েছে। এখন নিশ্চিতভাবেই এসব থেমে যাবে। ৫২ বছরের জুনায়েদ জামশেদ আর বেঁচে নেই। বুধবার চিত্রল থেকে ইসলামাবাদ ফেরার পথে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছে।
স্ত্রী নায়হা জুনায়েদকে নিয়ে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের পিকে-৬৬১ ফ্লাইটে ইসলামাবাদ ফিরছিলেন জুনায়েদ। বিমানটিতে জুনায়েদ দম্পতিসহ যাত্রী ছিলেন মোট ৪৭ জন। অ্যাবোটাবাদের হাভেলিয়াতে অবতরণের নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট পূর্বে বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ে। জুনায়েদের মৃত্যুর খবরে পাকিস্তানসহ বিশ্বজুড়ে তার অগণতি ভক্তের মনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
পপ তারকা হিসেবে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টেনে ব্যবসায় নেমেও সফল হন জুনায়েদ। পাকিস্তানি ক্রিকেট তারকা ওয়াসিম আকরামকে শ্রদ্ধা জানাতে তার নামেই পারফিউম তৈরি করেছিলেন জুনায়েদ। তিনি নিজেকে ইসলামি বক্তায় পরিণত করেন। মানুষের কাছে ইসলামের সত্যিকার আদর্শ ও শিক্ষা তুলে ধরতেন। পাকিস্তানি টেলিভিশনগুলোতে রমজানের সময় তিনিই সবচেয়ে সফল উপস্থাপক।
জন্ম ১৯৬৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। লাহোর প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন জুনায়েদ। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে স্বল্প মেয়াদে বেসামরিক ঠিকাদার হিসেবে কাজ করেন। জুনায়েদ আলোচনায় আসেন ১৯৮৩ সালে। ওই সময় তিনি রোহাইল হায়াতের পপ সংগীত ব্যান্ড ভাইটাল সাইনস-এ যোগ দেন। বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়ে নিজের নাম প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। তার গাওয়া জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে রয়েছে, ‘দিল দিল পাকিস্তান’, ‘সওলি সালোনি’, ‘ইয়ে শাম’, ‘এইতবার’, ‘তুম দূর থা’, ‘কেহ দো জো বি’ ও ‘না তু আয়েগি’।
১৯৯৪ সালে জুনায়েদের প্রথম একক অ্যালবাম ‘জুনায়েদ অব ভাইটাল সাইনস’ মুক্তি পায়। যা দ্রুতই জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ১৯৯৯ সালে ‘উস রাহ পার’ এবং ২০০২ সালে ‘দিল কি বাত’ মুক্তি পায়। ২০০৪ সালে ভক্তদের অবাক করে সংগীত জীবন সমাপ্তির ঘোষণা দেন। পরে ২০০৫ সালে ইসলামি সংগীতের অ্যালবাম ‘জালওয়া-এ-জানান’ প্রকাশ করেন। এছাড়া ২০০৬ সালে ‘মেহবুব-এ-ইয়াজদান’, ২০০৮-এ ‘বদর-উদ-দুজা’ ও ২০০৯ ‘বাদি-উজ-জামান’ নামে ইসলামি সংগীতের অ্যালবাম প্রকাশ করেন জুনায়েদ।
জুনায়েদের মৃত্যুতে সংগীত জগৎ ও ইসলামি ভাবনার মানুষদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। গায়ক ফকির মেহমুদ দ্য ন্যাশনকে বলেন, ‘জুনায়েদ যা করেছেন সব সময় মন থেকেই করেছেন। তিনি সেই মানুষ যিনি পাকিস্তানে পপ গানের ভিত্তি গড়েছেন। তার অবদানের কথা দীর্ঘদিন মনে রাখবে সবাই।’
মেহমুদ আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা তিনি তার ব্যক্তিত্বকে মানবতার কল্যাণের জন্য কাজে লাগিয়েছেন, জন কল্যাণমূলক অনেক কাজ করেছেন। ছিলেন সোজা কথার মানুষ। কাউকে নিয়ে আড়ালে কথা বলতে তাকে শুনিনি কখনও।’
‘কল দ্য ব্যান্ড’-র মূল গায়ক জুনায়েদ খান বলেন, ‘জুনায়েদ জামশেদসহ ৪৭ জন বিমানযাত্রীর মৃত্যু দুঃখজনক। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নেওয়া উচিত। এ মর্মান্তিক ঘটনার যৌক্তিক কারণ ব্যাখ্যা করা উচিত কর্তৃপক্ষের। জুনায়েদের অবদান কোনওভাবেই ভুলে যাওয়া হবে না। তিনি ছিলেন খুব ভালো একজন শিল্পী ও মানুষ।’
সংগীতজ্ঞ উজায়ের উলতাফ টুইটারে লিখেছেন, ‘আমাদের প্রজন্মের কণ্ঠকে হারালাম আমরা’। ডিজাইনার নমি আনসারি লিখেছেন, ‘জুনায়েদের মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান ঘটলো’।
অভিনেত্রী মাহিরা খান, জুনুন ব্যান্ডের সালমান আহমদ, সংগীত শিল্পী কুরাতুলাইন বালুচ, ক্রিকেটার শোয়েব আখতার, অভিনেতা আলি জাফরসহ অনেকেই জুনায়েদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন।সূত্র: দ্য নেশন, ডন।
/এএ/