X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনার ভারত সফর, প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

আশিষ বিশ্বাস, কলকাতা
২৪ মার্চ ২০১৭, ১৯:০০আপডেট : ২৭ মার্চ ২০১৭, ১৯:৪৮

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশেই উত্তেজনা বিরাজ করছে। দুই দেশের জন্য কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সফরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অনেক প্রত্যাশা। সামনের এপ্রিলেই দিল্লি সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর।

দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ইতিহাস দেখলে বোঝা যাবে, প্রত্যাশা থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে এই আলোচনার সফলতা নির্ভর করছে ভারতের ওপরই। প্রত্যাশার বোঝা অবশ্য দুই দেশের ওপরেই রয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে। বাংলাদেশ বরাবরই এ চুক্তি নিয়ে দিল্লিকে চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অমতের কারণে বিষয়টি নিয়ে এগোতে পারছে না দিল্লি সরকার।  

মমতা বলেছেন, তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে পশ্চিমবঙ্গের ছয়টি জেলা পানিশূন্যতায় ভুগবে। ফলে বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা থাকা সত্ত্বেও তিনি এ বিষয়ে কিছু করতে পারবেন না।

সিকিমে পানিবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পশ্চিমবঙ্গে নদীর স্রোত অনেক কম। এজন্য সিকিম সরকার, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সিকিমের কারণে নদীর স্রোত দুর্বল নয়। কারণ এই্ প্রকল্পে নদীর স্রোত খুব বেশি ব্যবহার করা হয় না। আর পাহাড়ের ঢাল থেকে পড়ার কারণে নদীর স্রোত দুর্বল হওয়ার আশঙ্কাও কম।

অন্যদিকে পশ্চিবঙ্গের গজলডোবায় একটি বাঁধ দেওয়া হয়েছে; যেখানে তিস্তা থেকে পানি সংগ্রহ করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হয। এ কারণেও পানির স্রোত কমে যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পানি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে সভাপতি করে একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করেছে। তবে তার ফল কখনোই সামনে আসেনি।

আগের আলোচনা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ যেখানে ৫০ হাজার কিউসেক পানির জন্য আবেদন করেছিলো; সেখানে ২৫ হাজার কিউসেক পানি দিতেও অপরাগতা প্রকাশ করে কলকাতা। কিন্তু এ বিষয়ে কখনোই খুব বেশি কিছু জানা যায়নি।

শেখ হাসিনার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার পরও মমতা বন্দোপাধ্যায়ের এমন অবস্থান ও তথ্যগত অভাবের কারণে এবার প্রত্যাশাও বেশি। তিস্তা চুক্তি আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারে। কারণ বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো প্রায়ই এটা নিয়ে অভিযোগ তোলে।

এখন দিল্লির অনুকূলে যা রয়েছে তা হচ্ছে মমতা বন্দোপাধ্যায় ও তার দল তৃণমূল কংগ্রেসের মুখোমুখি অবস্থান। এর আগে ক্ষমতাসীন কংগ্রেস মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মমতার ঢাকা সফর বাতিল নিয়েও কিছু বলতে পারেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।

বর্তমানে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এমন অবস্থানে নেই। বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্ক কখনোই খুব ভালো ছিল না। আর এখন এটা মোদি ও মমতার ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলে গেছে।

কলকাতায় বসবাস করা বাংলাদেশি নাগরিকরা এজন্য প্রশ্ন করেন, মমতা কি সমর্থন দেবেন? তবে শেখ হাসিনার সফরের আগে এমন কিছুই বলা যাচ্ছে না।

এখনও পানি বণ্টন চুক্তিতে রাজি নন মমতা। সম্প্রতি এক টিভি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, তিনি এখনও তার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। কারণ তিনি পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করতে চান না। তিনি অভিযোগ করেন, ভারতের অন্যান্য রাজ্য শেখ হাসিনার সফর নিয়ে জানলেও তাকে এই বিষয়ে কেউ অবগত করেনি।

এখন যদি মমতা তার অবস্থানে অটল থাকেন তবে মোদি কি তাকে ছাপিয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন? সাংবিধানিকভাবে তা সম্ভব। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে এই চুক্তির জন্য মোদি এমন কিছু করবেন কিনা সেটাই প্রশ্ন! ভারতের সবচেয়ে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশীর সঙ্গে এই চুক্তি করলেও কলকাতায় সেটা রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে নিশ্চিত।

কয়েক দশক পর কলকাতায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে শুরু করেছে বিজেপি। তাই মোদির সিদ্ধান্ত তৃণমূল কংগ্রেস কিভাবে নেবে সেটাও দেখার বিষয়।

যতদূর জানা গেছে, তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহূর্তে ১৫ হাজার কোটি রুপির একটি দুর্নীতি মামলা লড়ছে। খুব শিগগিরই ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি রুপি ঋণে পড়তে পারে দলটি। ফলে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান এখন যথেষ্টই দুর্বল।

বিজেপির আইন বিষয়ক সদস্য শতনু সিনহা বলেন, ‘উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, গোয়া ও মনিপুরে বিজেপির জয়েও মমতার বিজেপি বিরোধীতা কমেনি। তিনি পশ্চিমঙ্গে বিজেপির সমর্থন বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন। এই মুহূর্তে তার দলের ভালোর জন্য যে কোনও কিছু করবেন তিনি। দুর্নীতির মামলার সময় ৩ দিন থেকে ১ মাস বাড়ানোতে খুবই খুশি হয়েছেন তিনি। কারণ রাজনীতিতে এক মাস অনেক লম্বা সময়। এই সময়ে তারা দিল্লিতে বিজেপি নেতাদের সঙ্গে বসতে পারবেন। সিনহা অবশ্য মমতার এমন অবস্থানের কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত নন।

তিস্তার বিষয়টি বাদ দিলে, শেখ হাসিনার এই সফর খুবই উৎসাহব্যাঞ্জক। গত দশকে বেশ কিছু প্রকল্পে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। লাভবান হয়েছে দুই দেশই। দুই দেশের মাঝে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।

ভারতে ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। আমদানিও করে প্রচুর। তবে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী কিছু মানুষের দাবি এতে করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

তাদের দাবি, অন্যান্য দেশের সঙ্গেও এমন সম্পর্ক তৈরি করা উচিত ঢাকার। বিশেষ করে চীন। কারণ ভারতের মতো একমাত্র চীনই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এতো বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তবে চীন তাদের প্রযুক্তি থেকে শুরু করে কোনও কিছুতে এতো সহায়তা করে না। এক্ষেত্রে ভালো উদাহরণ হতে পারে মিয়ানমার।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ফল অনেক ভালো ছিল। ভারতের কাছ থেকে সুবিধাজনক চুক্তিতে দীর্ঘমেয়াদে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বাংলাদেশের রেলওয়ে, বন্দর, বিদ্যুৎসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে দিল্লি। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ভারত।

সন্ত্রাস মোকাবেলায় দুই দেশের মাঝে সামরিক সহায়তা আদান-প্রদান বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলছে যৌথ প্রশিক্ষণ ও কার্যক্রম। ভারত তাদের সামরিক শক্তি দ্রুত এগিয়ে নিতে চাইলেও বাংলাদেশ কিছুটা ধীরে অগ্রসর হতে চায়। এই সময় দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসা সীমান্ত চুক্তিতেও জয় পেয়েছে বাংলাদেশ।

অন্যদিকে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশও অনেক সমর্থন দিয়েছে। উলফা, এনডিএফবি-এর মতো বিদ্রোহী সংগঠনগুলোকে আটকে দিয়ে দিল্লিকে সহায়তা করেছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মৌলবাদী গোষ্ঠী হুজি, জেএমবি এবং হরকাতুল আনসারের মতো সংগঠনকে মোকাবেলা করেছে বাংলাদেশ-ভারত। এ সময়ে সীমান্তে পারস্পরিক সহযোগিতা ছিল দুই দেশের।

সম্প্রতি বাংলাদেশ,ভারত, ভুটান ও নেপালের মাঝেও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে যেখানে পণ্য ও মানুষের চলাচল সহজ হবে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর দুই দেশের মাঝে এমন পদক্ষেপ এটাই প্রথম।

বাংলাদেশি নদী ও সড়কপথে ত্রিপুরায় খাবার ও প্রযুক্তিগত সহায়তা সরবরাহ করেছে ভারত। বাংলাদেশ পণ্য পাঠিয়েছে দিল্লি ও কলকাতায়। ১৬ কোটি মানুষের বাংলাদেশি অর্থনীতি ও ভারতের ১২০ কোটি মানুষের ভারতীয় অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবেই পারস্পরিক সম্পর্কে লাভবান হবে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাও তখন অর্জন সহজ হবে।

বড় দেশ হওয়ার কারণে ভারতের বেশকিছু দায়িত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ যেন কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই বিষয়টি চলতি সফরের আলোচনায় মাথায় রাখা জরুরি।

/এমএইচ/এমপি/

সম্পর্কিত
পশ্চিমবঙ্গে প্রথম দফার ভোট শেষেই বিজয় মিছিল
লোকসভা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ভোটের হার ৬০ শতাংশ, সর্বোচ্চ পশ্চিমবঙ্গে
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া