X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

এরদোয়ানের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতেই তুরস্কের গণভোট?

শাহেরীন আরাফাত
১৬ এপ্রিল ২০১৭, ২০:৫৪আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৩২
image

এরদোয়ানের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতেই তুরস্কের গণভোট? তুরস্কে অনুষ্ঠিত গণভোটটি বিশ্ব ইতিহাসের এক নজিরবিহীন গণভোট। একজন প্রেসিডেন্ট যেন আরও একযুগ ক্ষমতায় থাকতে পারেন, জনতার কাছে তার পক্ষে ‘হ্যা’ ভোট চাইছেন রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের  প্রশাসন। ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হলে অগাধ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী হবেন প্রেসিডেন্ট। সেই সঙ্গে এ নতুন ব্যবস্থায় আগামী ১২ বছরের জন্য এরদোয়ানই থাকবেন প্রেসিডেন্টের পদে। এই গণভোটকে তাই রাজনীতি বিশ্লেষকরা এরদোয়ানের ক্ষমতা পোক্ত করার পথ হিসেবেই দেখছেন।

রবিবার তুরস্কের পূর্বাঞ্চলের স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। অন্যান্য এলাকায় শুরু হয় সকাল ৮টায়। ভোটগ্রহণ চলবে যথাক্রমে বিকাল ৪টা ও ৫টা পর্যন্ত।ম গণভোটের পক্ষে বেশি ভোট পড়লে নতুন সংবিধান অনুমোদন পাবে। এর ফলে তুরস্কের পার্লামেন্ট ব্যবস্থা পরিবর্তিত হবে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী শাসন কাঠামোতে। আজ এক লাখ ৬৭ হাজার ভোটকেন্দ্রে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ভোটার দেশের ভবিষ্যত নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করছেন। তুরস্কের স্থানীয় সময় রাতেই গণভোটের ফলাফল পাওয়া যাবে বলে জানা গেছে।

সংবিধান পরিবর্তন করার পক্ষে রায় আসলে, তথা গণভোটে ‘হ্যা’ জিতলে এরদোয়ানের ক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে। তিনি নিজের ইচ্ছায় বিচারপতিদের নিয়োগ দিতে ও তাদের পদচ্যুত করতে পারবেন। সেই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদও তার মর্জির বাইরে যেতে পারবে না। ১৯২৩ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর সাংবিধানিকভাবে কোনও একক ব্যক্তির হাতে এমন ক্ষমতা এর আগে আসেনি।

নতুন প্রস্তাবিত সংবিধান অনুসারে, প্রেসিডেন্ট শাসিত সরকারে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাজ করতে একাধিক ভাইস-প্রেসিডেন্টের নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। প্রেসিডেন্ট একাই জরুরি অবস্থা জারি করতে পারবেন, পার্লামেন্ট ভেঙে দিতে পারবেন। পার্লামেন্ট আর মন্ত্রীদের ব্যাপারে তদন্ত করতে পারবে না। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভোটে পার্লামেন্ট সদস্যরা প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবেন।

প্রেসিডেন্টের বিচারের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন লাগবে। পার্লামেন্ট সদস্যের সংখ্যা ৫৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬০০ করা হবে। প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন একই দিনে হবে। প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩ নভেম্বর ২০১৯। 

এরদোয়ানের সমর্থকদের মতে, এর ফলে তুরস্ক আরও ‘গতিশীল ও আধুনিক’ হবে। তবে এরদোয়ানের বিরোধীদের আশঙ্কা, এর মধ্য দিয়ে এরদোয়ান আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন। ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হলে এরদোয়ান ২০২৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার ম্যান্ডেট পেয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে, ‘না’ ভোট জয়ী হলে বহাল থাকবে বর্তমান পার্লামেন্ট শাসিত সাংবিধানিক ব্যবস্থা।

উল্লেখ্য, ২০১০ সালে এমনই এক গণভোটে সংবিধান পরিবর্তন করে প্রেসিডেন্টকে কিছু নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও পার্লামেন্টের বাইরে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশের কোনও সুযোগ ছিল না। ওই সংশোধনীর পর ২০১৪ সালে প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আসেন এরদোয়ান। আর এবারের গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হলে গোটা পার্লামেন্ট ব্যবস্থাই প্রেসিডেন্টের অধীনে চলে যাবে।

সংবিধান সংশোধনের পক্ষে রয়েছে এরদোয়ানের দল জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (একেপি) এবং তুর্কি কট্টর ডানপন্থি দল ন্যাশনালিস্ট অ্যাকশন পার্টি (এমএইচপি)। গণভোট আয়োজনে সংসদে একেপিকে প্রয়োজনীয় সমর্থন দিয়েছে এমএইচপি।

তবে এই দলটির অনেকেই আবার সংবিধান সংশোধনকে সমর্থন করছেন না। বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ সংসদ সদস্যরা। ‘না’ ভোটের পক্ষে লড়ে যাচ্ছেন তারা। ‘হ্যাঁ’ ভোটের পক্ষে একাই কাজ করতে হচ্ছে একেপিকে। বর্তমানে দেশটির সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী চারটি দলের মধ্যে সবচে ছোট দল এমএইচপি।

এরদোয়ান বলেছেন, ‘এসব পরিবর্তনের ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দ্রুততর হবে।’ ইস্তাম্বুলে কয়েক লাখ মানুষের এক সমাবেশে তিনি আরও বলেন, ‘এই গণভোট খুবই জরুরি; কারণ, মাত্র ১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে যাতে আর কেউ তুরস্কের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে না পারে। আমার শাসনামলে বিনিয়োগ বেড়েছে, আট লেনের ইয়াভুজ সুলতান সেলিম সেতু তৈরি করেছি। এগুলো তুরস্কের উন্নয়নের বহিঃপ্রকাশ। এটি ধরে রাখতে সংবিধানের সংশোধন দরকার।’

তবে এরদোয়ানের বিরোধী পক্ষ বলেছেন, এর মাধ্যমে তিনি স্বৈরশাসন কায়েম হবে, গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজবে। তাদের অভিযোগ, এর মাধ্যমে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা বাড়বে। আর তা আধুনিক তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মুস্তফা কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিকে দুর্বল ও অকার্যকর করে দিচ্ছে। বিরোধীদল এইচডিপির দাবি, এই গণভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছেন এরদোয়ান। দলটির এক কর্মী এমরাহ পোলাত বলেন, ‘অদেখা কোনও ক্ষমতা আর উন্নয়নের দিবাস্বপ্ন দেখাচ্ছেন এরদোয়ান।’ এরদোয়ানের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তিনি তুরস্কের ধর্মনিরপেক্ষ ব্যবস্থা নিঃশেষ করে দেবেন বলেও অভিযোগ বিরোধীদের।

রিপাবলিকান পিপল’স পার্টি (সিএইচপি) সতর্ক করেছে, ‘হ্যাঁ’ ভোট দেশকে বিপজ্জনক করে তুলবে। দলটির নেতা কামাল কিলিচদারুগলু বলেন, ‘আমরা আট কোটি মানুষকে একটা বাসে তুলে দিচ্ছি। আমরা জানি না, এটি কোথায় যাচ্ছে। ওই আট কোটি মানুষকে আমরা যে বাসে তুলে দিচ্ছি, সেটাতে কোনও ব্রেক নেই।’

তুর্কি জনগণ ‘হ্যাঁ’ ভোট দিলে সরকারের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ অবস্থা থেকেই মুক্তি মিলবে। গত কয়েক বছরে এরদোয়ান সে পথেই এগিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের কন্টেম্পরারি টার্কিশ স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ইসরা ওজিরেক। ‘হ্যাঁ’ ভোট জয়ী হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘পার্লামেন্ট পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়বে। এরদোয়ানের নীতিতে আনুষ্ঠানিক সীল মারার কাজটাই কেবল বাকি থাকবে। সেখানে কোনও প্রধানমন্ত্রী থাকবেন না। সব ক্ষমতা থাকবে এরদোয়ানের হাতে।’  

এরদোয়ান এর আগে তুরস্ককে ১৩ বছর শাসন করেছেন। ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন। আর ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরদোয়ান সম্পর্কে ওজিরেক আরও বলেন, ‘এরদোয়ানের এক ক্যারিশমেটিক চরিত্র রয়েছে। যারা তাকে ভালোবাসেন, তারা তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন। আবার যারা তাকে ঘৃণা করেন, তাদের ঘৃণাটাও তীব্র। উভয় ক্ষেত্রেই অনুভূতিটা তীক্ষ্ণ।’ 

গত বছর অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর বিশিষ্ট অস্ট্রেলীয় সাংবাদিক ড্যারিল ম্যাককান বলেছিলেন, ‘অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু তাতে গণতন্ত্র জেতেনি।’ ওই বছর জুলাইয়ে ড্যারিল বলেছিলেন, ‘অভ্যুত্থানকারীরা সম্ভবত অনিচ্ছাকৃতভাবেই প্রজাতন্ত্রের পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে এরদোয়ানকে শক্তিশালী করছেন। এর মাধ্যমে এরদোয়ানের কথিত ইসলামি প্রজাতন্ত্র কায়েমের পথটাই সুগম হয়েছে।’

প্রসঙ্গত, গত বছর ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তুর্কি সেনাবাহিনীর একাংশ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশের শাসনভার নেওয়ার দাবি করে, যা দেশটির টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। মধ্যরাতে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে তুরস্কের ডানপন্থী সরকার উচ্ছেদের দাবি করে দেশটির সেনাবাহিনীর একাংশ।  কারফিউর বিরোধিতা করে এরদোয়ানের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে এলে সংঘর্ষ শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর সব অংশের সমর্থন না থাকায় এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের তৎপরতায় জনগণ রাস্তায় নেমে এলে বিদ্রোহী সেনাদের উদ্যোগ ভেস্তে যায়।

এখন পর্যন্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষকে কারাবন্দি করা হয়েছে। এক লাখেরও বেশি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত ও বরখাস্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সেনা, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাসহ বেসামরিক প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাংবাদিকও রয়েছেন। অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমের অন্তত ১৫০টি সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয় ওই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর।

সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান।

/বিএ/

সম্পর্কিত
ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন বাহিনীর ওপর ড্রোন ও রকেট হামলা
নয় বছরে প্রথম ওমরাহ, ইরানি দলের সৌদি আরব যাত্রা
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানে অন্তত ১৫ ফিলিস্তিনি নিহত
সর্বশেষ খবর
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে পুলিশ: ডিএমপি কমিশনার
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
চাই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষার বাজেট
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
লিঙ্গবৈচিত্র্য ও পুরুষতন্ত্রের মেনে নেওয়া-না নেওয়া
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
তীব্র গরমে কৃষিশ্রমিকের সংকট চরমে
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে দুদকের কমিটি
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা
অতিরিক্ত সচিব হলেন ১২৭ কর্মকর্তা