X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইসলাম নয়, ব্লাসফেমির জন্ম রাজনীতির গর্ভে

মাহাদী হাসান
৩০ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:১২আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০১৭, ০৮:৫৪
image

ইসলাম নয়, ব্লাসফেমির জন্ম রাজনীতির গর্ভে



ব্রিটিশ-ভারতীয় লেখক সালমান রুশদির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ১৯৮৯ সালে ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুলুল্লাহ খোমেনি তাকে হত্যার ফতোয়া জারি করেছিলেন। ব্লাসফেমির শুরুর কাল সেটা। সালমান রুশদির ওপর ইরানি নেতার ফতোয়া থেকে শুরু করে ফরাসি ম্যাগাজিন শার্লি এবদোর কার্যালয়ে সন্ত্রাসী হামলা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মুসলিম বিশ্বে ব্লাসফেমিবিরোধী কর্মকাণ্ড ক্রমাগত দৃঢ় হচ্ছে। তবে কোরআনসহ অপরাপর ইসলামী অনুশাসনে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হত্যার বিষয়টি নেই। ইতিহাসের পর্যালোচনাতেও এমন সহিংসতার অতীত নজির নেই। নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদের বিশ্লেষণ অনুযাযী, ইসলাম নয় এই ব্লাসফেমির জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক-ইসলামের সাম্প্রতিক বাস্তবতায়।
ইসলাম ও ব্লাসফেমির ইতিহাস নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অলাভজনক সংবাদমাধ্যম দ্য কনভারসেশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা হয়তো সহজেই বলে ফেলা যায় যে, ইসলাম ‘অসহিষ্ণুতায় পূর্ণ’ এবং মুসলিমরা ‘স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বিরোধী’। তাদের মাঝে ‘স্বৈরতন্ত্র ও ধর্মান্ধতা’ বিদ্যমান। কিন্তু এই ধারণা মুসলিমদের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ইসলামের অনেক শাখাকে শুধু এড়িয়েই যায় না, বরং সমস্যার আর্থ-সামাজিক সমস্যার ভিত্তিকেও এড়িয়ে যায়।
ইতিহাস
দার্শনিক তালাল আসাদ খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার পার্থক্যের উপর গুরুত্বারোপ করেন। খ্রিস্টধর্মের মতো ইসলামি ইতিহাসে ব্লাসফেমি খুঁজে বের করা অনেক কঠিন। কিন্তু এমন অনেক বিষয় আছে যেটা ব্লাসফেমির মতোই। যেমন – মুসলিমরা প্রায়শই বলেন ‘ইসাহ’। এর অনেকগুলো অর্থ রয়েছে – অপমান, ক্ষতি। কিন্তু এই শব্দ ব্যবহারের কারণে মুসলিমরা তাদের উপর হামলা করেনা।
এদিকে ইসলামি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক লেখক কোরআন ও মুহাম্মদ (স.) সহ ইসলামি বিশ্বাসের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাদের কোনও শাস্তি হয়নি। ইসলাম নিয়ে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। অনেকে উপহাসও করেছেন। উদাহরণ হিসেব আরবের দার্শনিক আবুল আল-আলা আল-মারির কথা বলা যেতে পারে। তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি আমার ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমি বলবো যে, আমি বোকা নই।’
বাগদাদে ইবনে আল-রাওয়ান্ডিও তার বইয়ের বিভিন্ন অংশে কোরআন নিয়ে সমালোচনা করেছেন। সমসাময়িক সময়ে ইরাকি লেখক ও কবি মারুফ আল-রাসাফি তার বই ‘দ্য মুহামাদিয়ান পার্সোনালিটি’তে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (স.) সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন।
বাস্তবতা হলো, ব্লাসফেমির কারণে হত্যা করা বা হামলার ঘটনা খুবই সাম্প্রতিক বিষয়। বলা যেতে পারে, রুশদির ফতোয়ার পরই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি।
রাজনৈতিক ইসলামের প্রতিষ্ঠাতারা এই ধারা শুরু করেছেন। এজন্যই বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকেই অনেক সেক্যুলার চিন্তবিদ, লেখক ও কবিরা অনেকভাবে ইসলাম বিরোধী লেখা শুরু করেন।
সামাজিক রাজনৈতিক পটভূমি
ব্লাসফেমির নামে ধর্মীয় পদক্ষেপ যতটা জনপ্রিয় হওয়ার কথা ছিল, ততটা হয়নি। বরং এটি পরিণত হয়েছে সমস্যা ও সংকটে। এটি আর এখন আধ্যাত্মিক বিষয় নেই। বরং তা ভীষণভাবে পার্থিব ও লৌকিক। সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতারাই যার নিয়ন্ত্রণক। কোনও ধর্মের বিস্তার, ক্ষয়, বা পরিবর্তন সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমির সঙ্গে জড়িত। কখনও তা সহিষ্ণু হয়, আবার কখনোবা আগ্রাসী।
সমাজ বিজ্ঞানী ব্রায়ান এস টার্নার খ্রিস্টধর্মের উদাহরণ টেনে এ পরিস্থিতির ব্যাখা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সাংবিধানিক ও সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ ও সমানাধিকারের মতবাদের প্রভাবে এখন আর সৃষ্টিকর্তাকে একনায়ক বলে মেনে নিতে পারেন না খ্রিস্টানরা। এর ফলে একসময় ঈশ্বর মনে করা যিশু খ্রিস্ট পরিণত হন তারকায়।’ পশ্চিমা সমাজে ওই সহিষ্ণুতা তৈরিতে অনেক সময় লেগেছে। এজন্য তাদের বহু ধর্মীয়, গোত্রগত ও রাজনৈতিক সংগ্রামের মুখোমুখিও হতে হয়েছে।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমরা এ বাস্তবতাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। এর অবশ্য অনেক বাস্তব কারণও রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রকৃত সিভিল সোসাইটি গঠনের সীমাবদ্ধতা এবং সর্বোপরি উপনিবেশের আগ্রাসনের ফলে এমন বাস্তবতা তৈরি করেছে। পশ্চিমা উপনিবেশিক শক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অত্যাচারী সরকারের হাতে ক্ষমতায় হস্তান্তর করেছে। জাতি-রাষ্ট্র গঠন করতে ব্যররথ হওয়ায় সেখানে পশ্চিমা মদদপুষ্ট উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সামরিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান ঘটে।
ইসলামের সুন্নিপন্থার এক কট্টর শাখা সালাফি। সম্প্রতি সালাফি মতবাদের ওপর ভর করে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। অপরাপর মতবাদ ও আন্তর্জাতিক শক্তিকে মোকাবিলা করতে বিভিন্ন সময়ে অনেক জঙ্গিগোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের মদদও পেয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় – সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবিলায় আল-কায়েদাকে সমর্থন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের ইসরায়েল-বিরোধী দেশগুলোতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) জঙ্গিদের উত্থানের বিষয়টি।
আল-‍রুমি থেকে আল-বাগদাদি
তের শতকের ইসলামি চিন্তাবিদ জালাল আদ-দ্বীন আল-রুমির কথায় অনেক মুসলিমরা অবাক হতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যাও! ভালোবাসার মানুষের শুরা পান করো, বিশ্বাসের দিক দিয়ে মুসলিম ও প্যাগনরা সমান।’ অতীতের অনেক ইসলামি চিন্তাবিদের মতো রুমির বক্তব্যও মুসলিম চিন্তাধারায় বহুত্ববাদ বা বহুমতের সহাবস্থানের সংস্কৃতি গঠনে অনেক প্রভাব রাখে। ইসলামের আরেক শাখা সূফিবাদে তার বিশেষ প্রভাব রয়েছে।
রুমির বহু সময় পর মধ্যপ্রাচ্যে আবির্ভাব ঘটে আইএসের জঙ্গিনেতা আবু বকর আল-বাগদাদির। রুমি যেখানে সম্প্রীতি, মানবতার প্রচার করতেন, দিয়েছেন ইসলামের মানবিক ব্যাখ্যা। সেখানে বাগদাদির নেতৃত্বে আইএস দেখাচ্ছে এক নৃশংস, আগ্রাসী রূপ। আর সেটাকেও তারা ইসলামের নামই দিচ্ছে। তবে সাধারণ মুসলিমরা এখনও এ আগ্রাসী জঙ্গিদের বিপক্ষে। কারণ ওই জঙ্গিদের কাছে তারা নিজেরাও নির্যাতিত।
বেশিরভাগ মুসলিমের বিশ্বাস, ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’। যেখানে মানবজাতির সবাই সমান অধিকার নিয়ে একসঙ্গে বসবাস করতে পারে। সম্প্রতি ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস ইরাকি খ্রিস্টানদের সঙ্গে এক ফোনালাপে বলেছিলেন, মুসলিমদেরকে ইসলামের প্রকৃত ও সত্য রুপ তুলে ধরতে সাহায্য করা উচিত।
/এসএ/ বিএ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা