X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
পর্ব-১

জেরেমি করবিন এবং এক পুরনো ‘সুইসাইড নোট’

আরশাদ আলী
০৭ জুন ২০১৭, ২৩:৩৩আপডেট : ০৮ জুন ২০১৭, ০৬:০৪

জেরেমি করবিন যেন এক যাদুবাস্তবতা। কল্পনায় দেখি, সাইকেলে নিরন্তর তিনি ছুটছেন জনমানুষের কাছে। তার হাতে ইতিহাসের কথিত সেই দীর্ঘতম সুইসাইড নোট! করবিন যেন সবাইকে বলে চলেছেন, সুইসাইড নোট নয়, এ হলো এক পুনরুত্থানের দলিল! কোন সুইসাইড নোটের কথা বলছি, তা নিয়ে বলতে চাইলে ফিরতে হবে বিশ শতকের সত্তর দশকে। করবিনের উত্থানের আগ পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের আমরা যে লেবার পার্টিকে দেখেছি, তা ৭০ দশকে জনমানুষের কথা বলতো। গণতন্ত্র বলতে দলের ভেতরে-বাইরে শ্রমিক শ্রেণির নীতি প্রণয়ন আর সিদ্ধান্ত গ্রহণ বুঝত তারা। ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ওই রাজনৈতিক দর্শনকে বিস্তৃত করে দীর্ঘ এক রাজনৈতিক ইশতেহার প্রকাশ করে তারা। তবে নির্বাচনে পরাজয়ের পর ওই ইশতেহারই ‘ইতিহাসের দীর্ঘতম সুইসাইড নোট’ আখ্যা পায়।

কনজারভেটিভ প্রধানমন্ত্রী হন মার্গারেট থ্যাচারের উত্থানের পর গণতন্ত্রবিরোধী নব্য উদারবাদের যে দর্শনের উত্থানে সেদিন লেবার দলের পলিসিকে আত্মঘাতী মনে করা হয়েছিল, ইতিহাস প্রত্যাবর্তনের এক পরিক্রমা শেষে আজ তার অন্তসারশূন্যতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বৈষম্যকে আরও জোরালো করে, মানুষকে স্রেফ ক্রেতাবিক্রেতায় পর্যবসিত করে ক্লান্ত-অবসন্ন হওয়া ওই অর্থ-দর্শন আজ বিশ্বব্যাপী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আজ তাই দেশে দেশে মুক্তবাজার বিরোধিতার রাজনীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশ্রয় করেছে পুরনো রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদকে। বিদ্বেষ আর বিভক্তিকে উপজীব্য করে ক্ষমতা আধিপত্যের বাসনা পূরণ করছেন ক্ষমতাশালীরা। এমনকী মুক্তবাজারের অন্যতম জন্মভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও নব্য উদারবাদ পরাজিত হয়েছে। পুরনো সংরক্ষণশীলতার কথা প্রচার করেই ক্ষমতায় এসেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। লেবার রাজনীতি যখন কনজারভেটিভদের মতো করে নব্য উদারবাদকে উপজীব্য করে বছরের পর বছর ধরে অভিজাততন্ত্র জারি রেখেছে, তখন করবিন এক বিদ্রোহের জমিন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার উত্থান যেন এক অনন্য বিরুদ্ধবাদের গল্পগাঁথা। এই প্রতিবেদনের দুইটি পর্বে সেই বিদ্রোহী করবিনের উত্থানের গল্প বলা হয়েছে। আজ পড়ুন প্রথম পর্ব। [বাধন অধিকারী, ডেস্ক-ইন চার্জ]

জেরেমি করবিন ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর পশ্চিমা গণতন্ত্রে প্রচলিত শাসনকাঠামোর বিরোধিতা নতুন প্রপঞ্চে পরিণত হয়। এ ধারার পতাকা হাতেই ব্রিটিশ রাজনীতিতে জেরেমি করবিনের বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল ২০১৫ সালে। ব্রিটিশ রাজনীতির প্রধানতম দল লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হন জেরেমি করবিন। প্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে করবিন দলের কোনও নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে বা দল গঠিত সরকারের কোনও পদে ছিলেন না। করবিনের রাজনীতির মূল বিষয় ছিলো বিদেশে যুদ্ধে ব্রিটেনের জড়িয়ে পড়া এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ।

লেবার পার্টির মূলধারার রাজনীতিতে করবিনকে বহিরাগত বলা চলে। বহিরাগত হয়েও ব্রিটিশ ইতিহাস; বিশেষ করে লেবার পার্টির ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। এ জন্যই হয়তো নেতা হিসেবে তার আবির্ভাব অনেক সহকর্মী সহজে মেনে নিতে পারেননি। বামপন্থী করবিন কথা বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল গণতন্ত্রের। যে গণতন্ত্রে দলের নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহনে শ্রমিকদের ভূমিকা থাকে। করবিন বিরোধিতা করেন দলে বিত্তশালী শ্রেণির একাধিপত্যকে। রাজনৈতিক এই দর্শন থেকে লেবার পার্টি ১৯৭০-র দশকে সরে যায়। ওই সময় ১৯৭৯ সালে মার্গারেট থ্যাচারের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টির কাছে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা ছাড়ে লেবার পার্টি। নির্বাচনের আগে লেবার পার্টি বামপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং আপাত দৃষ্টিতে একটি সমাজতান্ত্রিক ইশতেহার প্রকাশ করে। অনেকেই এটাকে ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ সুইসাইড নোট হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। এরপর পর ১৯৮৩ সালের ৯ জুন আধুনিক সময়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাচনি পরাজয়ের সম্মুখীন হয় লেবার পার্টি।

১৯৮৩ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির যেসব এমপি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন করবিন ছিলেন তাদের একজন। ওই সময় তার বয়স ছিল ৩৪ বছর। আরেক নতুন এমপি ছিলেন টনি ব্লেয়ার। করবিনের চেয়ে ব্লেয়ারের বয়স ছিল চার বছর কম। ১৯৮০ ও ১৯৯০-র দশকে টনি ব্লেয়ার ছিলেন লেবার পার্টির বাম ঘরানার নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস ও চতুর্থ ধারার পক্ষে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন লেবার পার্টির বাম অংশটি। চতুর্থ ধারাটিতে শিল্পের গণমালিকানার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে দলের নেতৃত্বে আসার পর নতুন লেবার- গড়ে তোলার ঘোষণা দেন টনি ব্লেয়ার। এ সময় দলটি অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর ও মুক্তবাণিজ্যের পক্ষে অবস্থান নেয়। লেবার পরিণত হয় বিল ক্লিনটনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মধ্যপন্থীতে। ১৯৯৭ সালে আঠারো বছরের মধ্যে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে টনি ব্লেয়ারের লেবার পাটি।

করবিনসহ লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক এমপিদের কয়েকজন তখন ক্যাম্পেইন গ্রুপ বলে পরিচিত। লেবার পার্টির এই বদলে যাওয়ার বিরোধিতা করতেন। টানা ক্ষমতায় থাকা ১৩ বছরের মধ্যে ১০ বছর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন টনি ব্লেয়ার। এই সময়ে করবিন দলের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ৪২৮বার ভোট দিয়েছেন। যা যে কোনও লেবার এমপির চেয়ে বেশি। কিন্তু পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় করবিন ও তার মিত্রদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। তাদেরকে গোনায় ধরা হতো না বলে উল্লেখ করেছিলেন টনি ব্লেয়ারের এক সিনিয়র উপদেষ্টা।

২০১৫ সালের ব্রিটিশ নির্বাচনে কনজারভেটিভদের কাছে লেবার পার্টির ভরাডুবির পর এড মিলিব্যান্ড দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন দলীয় প্রধান হওয়ার লড়াইয়ে নেমেছিলেন করবিন। দলের ধনীক শ্রেণি বা এমপিদের অল্প কয়েকজনের সমর্থন পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তার শক্তি ছিল লেবার পার্টির তৃণমূলের কর্মীরা। এসব কর্মীদের ভোটেই বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়েছিলেন তিনি। সাম্প্রতিক ইতিহাসে এতো বড় ব্যবধানে কোনও নেতা জয়ী হয়ে দলের শীর্ষ পদ পাননি।

জেরেমি করবিন

লেবার পার্টির দায়িত্ব নেওয়ার পর দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নির্বাচনে লড়তে হচ্ছে করবিনকে। দায়িত্ব নেওয়ার বছরের মাথায় তাকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ সামলে যখন দলকে পুনর্গঠিত করতে চলেছিলেন তখনই তাকে আগাম নির্বাচনের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে। ৮ জুনের নির্বাচন নিয়ে শুরুর দিকে জনমত জরিপে বিপুল পরিমাণে এগিয়ে ছিলো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ পার্টি। কিন্তু যতই নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে করবিনের লেবার পার্টি ব্যবধান কমিয়ে আনছে। ফলে শুরুতে যারা মনে করেছিলেন এবারও লেবার পার্টির ভরাডুবি হতে যাচ্ছে তারা কিছুটা নড়েচড়ে বসছেন। আর এটা সম্ভব হয়েছে করবিনের নেতৃত্বের কারণেই। এমনটাই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

স্যালফোর্ড ও একলস-র ব্রিটিশ এমপি রেবেকা লং-বেইলি মনে করেন, দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ব্রিটিশ রাজনীতিকে বদলে দিয়েছেন করবিন। তিনি মনে করেন, নতুন ধরনের গণমুখী রাজনীতির সূচনা করতে যাচ্ছে করবিনের লেবার পার্টি। করবিন নেতৃত্ব নেওয়ার পর দলের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৫ লাখের বেশি। যা বাম ঘরানা মধ্যপন্থী দল হিসেবে ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে দলটিকে।

লেবার প্রধান হিসেবে করবিনের এ সাফল্যে মূলে রয়েছে তার রাজনৈতিক দর্শন ও তৃণমূলের সংশ্লিষ্টতা। করবিনের সাফল্য অনুধাবন করতে করবিন নেতৃত্ব নেওয়ার আগে ও পরে লেবার পার্টির অবস্থা কেমন ছিল তা পাশাপাশি বিবেচনা করা দরকার।

/এমপি/

সম্পর্কিত
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
রুশ গুপ্তচর সন্দেহে জার্মানিতে গ্রেফতার ২
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
সর্বশেষ খবর
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা বিলে ভোট আজ
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
ড্রোন হামলার কথা অস্বীকার করলো ইরান, তদন্ত চলছে
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা