আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে বৃহস্পতিবার শীর্ষস্থানে ছিল ইরাকের ধ্বংসপ্রাপ্ত নূরি মসজিদ সংক্রান্ত খবরটি। কেন একটি মসজিদকে ঘিরে এতো আলোচনা? উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, সুপ্রাচীন ওই মসজিদের রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস। বহু জনশ্রুতিও রয়েছে ওই মসজিদকে ঘিরে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা পরিদর্শন করেছিলেন মসজিদটি। তুর্কি শাসক নূর আল-দিন মাহমুদ জং ১১ শতকে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৪ সালের জুনে আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদি এই মসজিদে বসে খিলাফত ঘোষণা করেন।
২১ জুন ২০১৭ বুধবার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে এক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদটি। ইরাকি বাহিনীর পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য আইএসকে দায়ী করা হচ্ছে। তাদের দাবি, সরকারি সেনারা মসজিদটির প্রায় ৫০ মিটারের মধ্যে চলে গেলে এটি গুঁড়িয়ে দেয় জঙ্গিরা। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবদি বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে জঙ্গিরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরাজয়ই স্বীকার করে নিলো। তবে আইএসের দাবি, মার্কিন বিমান বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে মসজিদটি। ছবিতে দেখা গেছে, মসজিদ এবং এর মিনারের একটা বড় অংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। অথচ আল নূরি মসজিদ-এর হেলানো মিনার ছিল মসুলের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপত্যগুলোর একটি।
আল নূরি মসজিদ-এর নামকরণ হয়েছিল মসুল ও আলেপ্পোর একজন তুর্কি শাসকের নামে। নূর আল-দিন মাহমুদ জং নামের এই ব্যক্তি তার মৃত্যুর দুই বছর আগে ১১৭২ সালে মসজিদটি তৈরির নির্দেশ দেন। নূর আল-দিন মাহমুদ জং নামের এই শাসক খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে মুসলিম বাহিনীকে সংগঠিত ও একত্রিত করেন। মূলত খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েই তিনি জনসম্মুখে এসেছিলেন।
২৮ বছর ধরে শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন নূর আল-দিন মাহমুদ জং। ওই সময়ে তিনি বর্তমান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক নগরীর নিয়ন্ত্রণ নেন। শিয়াদের বিরুদ্ধে সুন্নি মুসলিমদের চেতনাকে জয়ী করায় জিহাদিরা তাকে ব্যাপক সম্মান করতো।
মজবুত ইটের গাঁথুনি দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করা হয়েছিল মসজিদটির মিনারে। এখানে ইরানি স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখা গিয়েছিল। এছাড়া ছোট একটি সাদা গম্বুজ মসজিদের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছিল আরও বহুগুণ। প্রথম যখন মিনারটি তৈরির কাজ সম্পন্ন হয় তখন এর উচ্চতা ছিল ১৫০ ফুট। ১৪ শতকে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা মসুলের এই মসজিদটি পরিদর্শন করেন। ওই সময়েও ইবনে বতুতা মিনারটি হেলানো অবস্থায় দেখেছিলেন। তবে মিনারটি এভাবে হেলে পড়ার প্রকৃত কারণ কখনও পুরোপুরি জানা যায়নি।
একটা জনশ্রুতি রয়েছে যে, মসজিদটির হেলানো মিনার প্রকৃতপক্ষে কিছুটা ঝুঁকে পড়ে মহানবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সালাম করছে। তবে ইসলামে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে সিজদা দেওয়ার অনুমতি নেই বলে অনেকে এটা নাকচ করে দিয়েছেন। আবার অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, উত্তর-পশ্চিমের বাতাস তথা প্রাকৃতিক কারণে মসজিদের মিনারটি হেলে পড়েছে।
ইতোপূর্বে ইরান-ইরাক যুদ্ধেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মসুলের আল নূরি মসজিদ। ওই যুদ্ধে মসুলে ছোঁড়া বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় মসজিদ ভবনটি। এতে মসজিদের মিনারের ভিতের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অনেক ভূগর্ভস্থ পাইপ ভেঙ্গে যায়। ফলে মসজিদের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে।
২০১২ সালে ঐতিহ্যের আধার এই মসজিদ সম্পর্কে নিজেদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো। এতে বলা হয়, খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা মিনারটি ৮ দশমিক ৩ ফুট পর্যন্ত হেলে রয়েছে। ফলে যে কোনও সময় এটি ধসে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। পরে ২০১৪ সালের ২ জুন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এটি সংস্কারেরও প্রস্তাব দেয় ইউনেসকো। ওই প্রস্তাবের সপ্তাহখানেক পরই মসুলে শুরু হয় জঙ্গিদের তাণ্ডব নৃত্য।
২০১৪ সালের ১২ জুন আল নূরি মসজিদ-এর ইমাম মোহাম্মদ আল-মানসুরি-কে হত্যা করে জঙ্গিরা। তার অপরাধ ছিল, তিনি আইএসে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।
ওই বছরের জুনের শেষদিকে মসজিদটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএসের কথিত খিলাফতের ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে সিরিয়া ও ইরাকের অংশবিশেষ পর্যন্ত তাদের তাণ্ডব বিস্তৃতি লাভ করে। দুই দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার দখল নিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে আইএস। তবে মসুলের মতোই ইরাক এবং সিরিয়া দুই দেশেই ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে এই জঙ্গি সংগঠনটি।
/বিএ/