X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারের ‘মিথ্যা’ প্রতিশ্রুতিতে ‘বিভীষিকার চিহ্ন’ দেখছে রোহিঙ্গারা

মাহাদী হাসান
০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:১৩আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৯:৩৫
image

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার নব্বই দশকের যে চুক্তিকে উপজীব্য করতে চাইছে, তাতে একটুও ভরসা দেখছেন না শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা। অতীতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে রাখাইনে ফিরে গিয়েছিলেন, দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বারের মতো আসা এমন রোহিঙ্গারা সেখানে ফিরে যাওয়ার কথা শুনলেই অতীত স্মৃতিতে ‘বিভীষিকার চিহ্ন’ দেখছেন। জাতিগত নিধনযজ্ঞ আর মানবতাবিরোধী অপরাধের দুঃস্বপ্ন নিয়ে পুড়ে যাওয়া গ্রামে ফিরে কী করবেন, এমন প্রশ্ন অনেকের মনে। আবার যে চুক্তিকে উপজীব্য করে মিয়ানমার তাদের ফেরত নেওয়ার কথা জানিয়েছে, তাতে যাচাইবাছাইয়ের ক্ষেত্রে বৈধ প্রমাণপত্র হাজিরের শর্ত আছে। পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ফেলে স্রেফ জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন: বৈধ-অবৈধ পরের প্রশ্ন; কাগজপত্র কোথায় পাবে তারা? কেবল রোহিঙ্গারা নয়, এরইমধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নীতিতে নিজেদের আস্থাহীনতার কথা জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকট

৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার) বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠক শেষে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টার দফতর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়: ১৯৯২ সালের যৌথ ঘোষণার ভিত্তিতেই রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হবে। এই যৌথ ঘোষণা অনুসারে যেসব রোহিঙ্গা মিয়ানমার ফিরতে চায়, তাদের যাচাইকরণ বিষয়ে পদক্ষেপ চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে মিয়ানমার সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ৯২ এর ঘোষণা অনুযায়ী প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছামূলক। আর যাচাইবাছাইয়ের সমস্ত কর্তৃত্ব থাকবে মিয়ানমারের হাতে।

চুক্তির বড় অংশ জুড়ে ছিল জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার এই শরণার্থী কমিশনের প্রতিনিধিদের সহায়তা করবে আর মিয়ানমার সময় ও সুযোগ অনুযায়ী শরণার্থী কমিশনের সহায়তা নেবে। তবে এই চুক্তি অনুযায়ী জাতিসংঘ শরণার্থী কমিশন কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। এছাড়া এই চুক্তির আরেকটি ব্যর্থতা হলো, এর মাধ্যম সব শরণার্থীদের ফিরে যাওয়াও নিশ্চিত করা যায়নি। এবার মধ্যবর্তী ভূমিকায় কেউ নেই। এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে যুক্ত করতে চাইলেও বাংলাদেশ তাতে সমর্থ হয়নি। তাই ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারছেন না শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জাও হিতায় রয়টার্সকে বলেন, ‘যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে আমাদের একটি নীতি আছে, আমরা সেটাই অনুসরণ করবো।’ মিয়ানমারের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী একটি হাসপাতালের কাগজ থাকলেও বাসিন্দা হিসেবে গণ্য করার সুযোগ থাকবে। তবে এটা নির্ধারণ করার ক্ষমতা শুধুই মিয়ানমারের। বাংলাদেশ কোনও মতামত দিতে পারবে না।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা মনে করছেন, এই প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘এটা অনেক দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। আমরা বলেছি যে, অনেক রোহিঙ্গাদেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। তাই বিষয়টা আরও শিথিল করা উচিত। কিন্তু তারা জানিয়েছে, কাদের যাচাই বাছাই প্রক্রিয়ায় নেওয়া হবে সেটা তারাই নির্ধারণ করবে।’ 

আব্দুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন. ‘সবকিছু পুড়ে গেছে, মানুষও পুড়ে গেছে। সেখাসে কিভাবে থাকবো।’ এই সমস্যার শুরু যখন মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। রোহিঙ্গাদের বাঙালি বলে দূরে ঠেলে দিয়েছে সবাই।

২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে গত অক্টোবর থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার এবং আশির দশক থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত  আরও প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। সবমিলে প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গা আছে বাংলাদেশে। এদের মধ্যে কারও কারও মিয়ানমারে থাকার বৈধ প্রমাণপত্র আছে। তবে বৈধ কাগজপত্র থাকলেও অনেক শরণার্থী ফিরতে চাইছেন না। তারা জানান পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়া না হলে আবার তাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চলতে পারে। আমিনা খাতুন নামে ৬০ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী ফেরার কথা শুনে হেসে ফেলেন। তিনি বলেন, ‘ওখানে ফিরে গেলেও আবার আমাদের বাংলাদেশে ফিরে আসতে হবে।’

আমেনা জানান এই নিয়ে তৃতীয়বার বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন তিনি। এর আগে ১৯৭৮ সালে একবার সামরিক বাহিনীর অভিযানে থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। পরের বছর ফিরে গেলেও আবার ১৯৯১ সালে ফিরে আসতে হয়। এবার তিনবছর থেকে ১৯৯৪ সালে ফিরে যান মিয়ানমারে। সাম্প্রতিক এই রোহিঙ্গা ঢলে আবারও পালিয়ে বাধ্য হন তিনি। আর ফিরে যেতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমি আর ফিরে যেতে চাই না। যতবারই তারা ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ততবারই নিয়ে গিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে। আর আবার বিভীষিকার মুখোমুখি হয়েছি আমরা।’

ইয়াকুব আলী (৪৫) নামের এক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলেন, ‘তাদের কোনোভাবেই বিশ্বাস করা যায় না। আমাদের তাড়িয়ে তারা আমাদের সকল জায়গা জমি দখল করে নিয়েছে। যদি আমরা সেখানে ফিরেও যাই, তাহলে আবার ফিরে আসার জন্যই যাব। যদি তারা আমাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়, তাহলে হয়তো আমরা যাব। এর আগেও মানুষ এভাবে গিয়েছে কিন্তু আবার নির্যাতিত হয়ে তারা ফিরে এসেছে।’

রাখাইনের জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার যে নীতি অবলম্বনের কথা জানিয়েছে, তাতে আস্থা নেই মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালেরও। সংস্থাটি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবার আগে সহিংসতা বন্ধ করার শর্ত দিয়েছে। অ্যামনেস্টির প্রস্তাব অনুযায়ী প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছামূলক, মর্যাদাপূর্ণ ও নিরাপদ। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যাচাই বাছাইয়ের জন্য কাগজপত্র চাওয়াকেও অযৌক্তিক আখ্যা দিয়েছে তারা। প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ওই সংস্থা।

/বিএ/
সম্পর্কিত
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে সিরিজ ভূমিকম্প
আবারও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলো উত্তর কোরিয়া
সর্বশেষ খবর
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
ব্যাংক ডাকাতি রোধে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে
রাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
কাতারের আমিরের সফররাজনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে ঢাকা ও দোহার মধ্যে
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
পুড়ছে সড়ক, তবু অবিরাম কাজ তাদের
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
ঘুষ মামলায় আদালতের আদেশ লঙ্ঘন, ট্রাম্পের শাস্তি চান প্রসিকিউটররা
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট