X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

আশ্রয় শিবিরে দোদুল্যমান জীবন, ‘তবুও বেঁচে থাকা’তেই সান্ত্বনা

ফাহমিদা উর্ণি
১৩ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৩২আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪২
image

একদিকে ক্ষুধায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকা নবজাতক সন্তানকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা; আরেকদিকে আবার সেই মাকে জড়িয়ে ক্ষুধার্ত আরও তিন সন্তানের আর্তনাদ। কিন্তু নেই প্রয়োজনীয় খাবার। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে প্রায় এক মাস ধরে পালিয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা, পথের মধ্যেই সন্তানের জন্মদান আর এখন সেই নবজাতকের জন্য দুধের ব্যবস্থা না করতে পারার নতুন চিন্তা। কতক্ষণ আর শান্ত থাকবেন রোহিঙ্গা মা সোমিরা বেগম? আর সেকারণেই বোধহয় একসময় অসহ্য হয়ে সন্তানদের শান্ত করার বদলে তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন ‘কান্না থামাও’।  

সদ্যোজাত শিমুর জন্য দুধ সংগ্রহ করতে পারেননি সোমিরা
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নিপীড়নের শিকার হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে এসে এক নিরাপদ আশ্রয় পাবেন বলে আশা করেছিলেন সোমিরা। কিন্তু সেই আশা ভেস্তে গেছে। হঠাৎ করে আগমনকারী ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে সহায়তায় কী ব্যবস্থা নিতে হবে তার জন্য কারও এমনকি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-ও প্রস্তুত ছিল না। প্রচণ্ড গরম কিংবা ভারী বর্ষণ যে পরিস্থিতিই হোক না কেন বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবারকে গাঁদাগাঁদি করে একই তাঁবুর নিচে বসবাস করতে হচ্ছে।

সিঙ্গাপুরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম চ্যানেল নিউজ এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে জীবিত অবস্থায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও রোহিঙ্গারা এখন ক্ষুধা আর অসুস্থতার মুখোমুখি হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর গতি খুব ধীর। এ ইস্যুতে বড় রাজনৈতিক চাল-চিত্র নিয়ে বিশ্বনেতারা আলোচনা চালিয়ে গেলেও নাগরিকত্বের স্বীকৃতি না থাকা এসব রোহিঙ্গাদের জন্য যেন এটি আরেক ধরনের জীবন-মরণের দোলাচল। তারা জানেন না পরবর্তী ত্রাণের গাড়িটি কখন আসবে, কখন তারা পরবর্তী খাবার পাবেন কিংবা জানেন না তাদের দুর্বল হয়ে পড়া শিশুরা অন্য আরেকটা দিন দেখার জন্য বেঁচে থাকবে কিনা।

চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে সোমিরা বলেন, ‘আমরা এখনও স্থিরভাবে বসবাস শুরু করতে পারিনি। এখনও অনেক সংকট রয়েছে। আমরা যথাযথ খাবার পাচ্ছি না এবং আমরা এক মুহূর্তের জন্য বিশ্রামও নিতে পারছি না।    

সোমিরার স্বামী আনোয়ার বলেন, ‘আমরা শুধু এখানে বসে থাকি। আর কী করতে পারি আমরা?’

অনেকে আবার ত্রাণের আশায় রাস্তায় নিরন্তর ঘুরতে ফিরতে থাকেন। ত্রাণবাহী ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ত্রাণের গাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গে একরকম যুদ্ধে নেমে যান তারা। তবে শেষ পর্যন্ত লম্বা ও শক্তিশালী দেহের মানুষরাই বেশি ত্রাণ পেতে সক্ষম হন।

চ্যানেল নিউজ এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশিরা এ ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকলেও কখনও কখনও তাদের ভালো উদ্দেশ্যও বিপর্যয়ে পযর্বসিত হয়। ট্রাক থেকে ছুড়ে দেওয়া ত্রাণ নিতে গিয়ে লোকজনকে পদপিষ্ট হয়ে মারা যেতে হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইএএম) এর মুখপাত্র ক্রিস লম এর মতে, ক্যাম্পগুলো হয়ে মাত্র একটিই প্রধান সড়ক যাওয়ায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের পর আরও বেশি বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। একই কারণে বড় বড় এনজিওগুলোর জন্য সেখানে কাজ করাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ৪৩৪ মিলিয়ন ডলার সহায়তার আবেদনের পরও অস্থায়ী শিবিরগুলোতে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলোর উপস্থিতি কম উল্লেখ করে সমালোচনা চলছে। এ ব্যাপারে ক্রিস লম বলেন, ‘সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রে সময় লাগে-এর জন্য অনেক মানুষ লাগে এবং যথাযথ অবকাঠামো ও কিছু শৃঙ্খলা ছাড়া দ্রুত ওই অর্থ খরচ করাটা কঠিন।’

রোহিঙ্গা শিশু
যৌন নিপীড়নের দৃশ্যগুলো মন থেকে সরাতে পারছেন না রোহিঙ্গা নারীরা

রোহিঙ্গাদের জন্য ২০০ একর জায়গাজুড়ে নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার যা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির হবে। অনেক রোহিঙ্গা এখন চান তারা নতুন জীবনের বাস্তবতাকে আঁকড়ে ধরে সামনে পথ চলতে। কিন্তু কেউ কেউ আবার মন থেকে দুঃসহ স্মৃতি সরাতে পারছেন না। অনেকে নীরবে বয়ে চলেছেন তাদের মানসিক ও শারীরিক ট্রমা। এমনই একজন ২৫ বছর বয়সী সেতারা বেগম। নিজ গ্রামে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন তিনি। ধর্ষকরা তার স্বামীকেও তুলে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশে পৌঁছার পর সেতারা কোনও চিকিৎসা সহায়তা চাইতে যাননি। পরীক্ষা করা হবে-সেই লজ্জায় চুপ করে থেকেছেন তিনি।

রাখাইনে ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয়াবহ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে সেতারা বলেন, “তারা আমাকে বললো ‘তোমার মতো হাজার হাজার মেয়েকে আমরা হত্যা করেছি, তুমি যদি লড়াই করো তবে তোমাকেও মেরে ফেলব’ এরপর তারা আমাকে ধর্ষণ করলো এবং ছুরি দিয়ে আমার যোনীপথ কেটে দিলো। ১০ জন ছিল তারা।”

সেতারা জানান, যখনই টয়লেটে যান তখনই মনে হয় ‘সন্তান প্রসবের মতো’ বেদনা হচ্ছে।

তবে বাংলাদেশে আসার পর পরই সেতারা অস্থায়ী শিবিরে একটি ফাঁকা তাঁবু পেয়েছেন। আগে থেকে বসবাসরত রোহিঙ্গারা তার প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।

সেতারা বলেন, “রান্নার জন্য আমার কোনও হাঁড়ি ছিল না, চাল ছিল না, কিছুই ছিল না। তারপর প্রতিবেশীরা বললেন, ‘আমার হাঁড়ি ব্যবহার করো, ঘর পরিষ্কার করতে আমার ঝাড়ু নাও, ক্ষুধা লাগলে খাবার খেতে আমার বাড়িতে এসো, না খেয়ে থেকো না’। এভাবে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম এবং আমরা এখন প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভালোবাসি।”

কমিউনিটির মধ্যকার সৌহার্দ্য

আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষদের মধ্যকার এ সৌহার্দ্য পুরনো আশ্রয় শিবিরগুলোতেও দেখা গেছে, যেখানে রোহিঙ্গারা কয়েক দশক ধরে আছে। নাজির আহমেদ নামের ২৭ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে এখানে আছেন। গত আগস্টের মতোই তখনও একটি হামলা হওয়ার পর নাজিরের বাবা মা মিয়ানমার থেকে পালিয়েছিলেন। নাজির খেয়াল করলেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক শিশু তাদের বাবা মাকে হারিয়ে ফেলছে। এ জনাকীর্ণ শিবিরে নিঃসঙ্গ শিশু এবং নারীরা পাচার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। আর সেকারণে নিঃসঙ্গ শিশুদের সহায়তায় একটি নিখোঁজ ও প্রাপ্তি কেন্দ্র স্থাপন করেছেন নাজির। প্রতিদিন বাবা মাকে হারিয়ে ফেলা শিশুদের সেখোনে নিয়ে আসেন তিনি। লাউড স্পিকারে প্রাপ্তি সংবাদ ঘোষণা করেন তিনি। দিন শেষে হাতে গোনা ক’জন শিশু মা-বাবার সঙ্গে মিলিত হতে পারে। কিন্তু অনেকের বাবা মায়েরই সন্ধান মেলে না।

নাজিরের নিখোঁজ ও প্রাপ্তি কেন্দ্র
সাইদুল আমিন নামের ২৪ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নিজের জমানো টাকা এবং আগের রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করে নতুন আশ্রয়প্রার্থীদের সমুসাসহ বিভিন্ন স্ন্যাক্স বিতরণ করেন। তিনি জানান বেশিরভাগ মানুষকে তিনি তা বিনামূল্যেই দিয়ে দেন।

অন্যরাও একইরকম করে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের রান্না করে খাওয়াচ্ছেন।

চ্যানেল নিউজ এশিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটি দেশের এ ধরনের দয়া দেখানোর ক্ষেত্রেও সীমাবদ্ধতা আছে এবং শরণার্থীরা সেটা জানে। সেতারা বলেন, ‘এখন আমরা স্থানীয়দের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছি, কিন্তু চিরকাল তো আর এভাবে চলবে না।’

অসহায় রোহিঙ্গারা যখন একে অপরের সহায়
নাগরিকত্বের স্বপ্ন

বাবা মা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার পর যেসব রোহিঙ্গার জন্ম বাংলাদেশে হয়েছে, এদেশেই যারা বড় হয়েছে তাদের কাছে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া এবং নাগরিকত্ব পাওয়াটা স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই। কিন্তু যারা বিভাষিকা থেকে পালিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন তাদের কাছে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়াটা দুঃস্বপ্নের মতো। শরণার্থী শিবিরে কষ্টে দিন কাটানোর পরও তারা নিজেদের সান্ত্বনা দেন এই বলে- ‘তবুও বেঁচে তো আছি।’

 

 

/এফইউ/
সম্পর্কিত
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সমস্যা: নিরাপত্তা পরিষদে নিজের অবস্থান তুলে ধরলো বাংলাদেশ
রোহিঙ্গাদের বাসা ভাড়া দিলে নেওয়া হবে আইনি ব্যবস্থা
সর্বশেষ খবর
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্রয়োজন ৫৩৪ বিলিয়ন ডলার: পরিবেশমন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
পাট পণ্যের উন্নয়ন ও বিপণনে সমন্বিত পথনকশা প্রণয়ন করা হবে: মন্ত্রী
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়া বাসটির ফিটনেস ছিল না
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
ঢাকা ছেড়েছেন কাতারের আমির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট