X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

যে কারণে মুখে কুলুপ এঁটেছেন মিয়ানমারের বিদেশি কূটনীতিকরা

আরশাদ আলী ও মাহাদী হাসান
১৩ অক্টোবর ২০১৭, ২২:৪৫আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:২৮

২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতা শুরু হওয়ার আগেই জাতিসংঘের পূর্বাভাস ছিল। কিন্তু সহিংসতা এড়াতে কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে প্রতিবেদনটিই চেপে যাওয়া হয়। রাখাইনে চলমান রোহিঙ্গা সংকটের আগে রুয়ান্ডা, বসনিয়া, সুদান ও সিরিয়া পরিস্থিতি দেখেছে  বিশ্ব সম্প্রদায়। এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিভিন্ন উদ্যোগের পরও মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ থামানো যায়নি। এই ব্যর্থতায় মিয়ানমারের বেসামরিক সরকার ও সেনাবাহিনীকে দায়ী করলেও নীরব থেকেছেন দেশটিতে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।

রাখাইন পরিদর্শনে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা

রাখাইনে চলমান সহিংসতায় এ পর্যন্ত ৫ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে সরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা ৩ শতাধিক বললেও বাস্তবে তা হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। এ সহিংসতায় জাতিসংঘ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতা ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে যাচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারে অবস্থান করা বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের কণ্ঠে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুর পাওয়া যাচ্ছে না।

২ অক্টোবর মিয়ানমার সরকারের তত্ত্বাবধানে সহিংসতা কবলিত রাখাইন পরিদর্শন করেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা না বললেও পরিদর্শন শেষে তারা একটি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের আহ্বান ও রাখাইনে ত্রাণকর্মীদের প্রবেশাধিকার চেয়েছেন। বিবৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, সহিংসতার জন্য তারা সন্ত্রাসীদের দায়ী করেছেন। তারা মিয়ানমারের সরকার ও সেনাবাহিনীর কোনও সমালোচনা করেননি। এমনকি রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করেননি। যা মিয়ানমার সরকারের ও সেনাবাহিনীর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি।

কূটনীতিকদের বিবৃতিতে যে অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে সেই অবস্থান রাখাইনের সহিংসতায় সংশ্লিষ্ট দেশের অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কানাডা সরকার ও মিয়ানমারে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতের অবস্থানের ভিন্নতার বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর কানাডা পরিচালক ফরিদা দেইফ বলেন, ‘বিবৃতির ভিন্ন অবস্থানে মানুষ ভাবতে পারে কানাডা দেশে খুব কঠোর ভাষায় নিন্দা করতে পারে কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্কই রাখছে। এটি খুব বিপজ্জনক বার্তা দেয়।’

রাখাইন পরিদর্শনে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা

১২ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনেই বিভিন্ন দূতাবাসের অবস্থান। কিন্তু রাখাইনে সহিংসতা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য দেশটির রাষ্ট্রীয় ‍উপদেষ্টা অং সান সু চি কিংবা সেনাবাহিনীকে সরাসরি আহ্বান জানাতে পারেন না কূটনীতিকরা। কয়েকজন কূটনীতিকের দাবি, তারা যতটকু সম্ভব চাপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নয়তো পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

মিয়ানমারের নিযুক্ত ছয়টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয় নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর পক্ষ থেকে। কিন্তু কেউই নিজেদের নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে,  জাতিগত দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েন থাকলেও মিয়ানমারকে সফল রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চি ২০১৫ সালে মিয়ানমারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ভাবা হয়েছিলো দেশটিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে যাচ্ছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব মনে হলেও সামরিক বাহিনীর ক্ষমতার কাছে তিনি দুর্বলই থেকেছেন। প্রায় ৫০ বছর ধরে শাসন করা সামরিক বাহিনী ঠিকই তাদের ক্ষমতা ধরে রেখেছে। অং সান সু চি গ্রামবাসীদের হত্যা করার নির্দেশ দেননি। এমন সিদ্ধান্ত এসেছে দেশটির সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লায়াংয়ের কাছ থেকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিকরা দাবি করেন, অং সান সু চি ব্যক্তিগতভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করলেও জনসমক্ষে বলতে পারেন না। কারণ বৌদ্ধদের মধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদ্বেষ রয়েছে। 

আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে ইয়াঙ্গুনে থাকা কূটনীতিকরাও চাপ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছেন। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পর্যবেক্ষকরা দাবি করেছেন, নোবেল বিজয়ী সু চি বিশ্বের কাছে নিন্দিত হোন- এটাই চেয়েছে দেশটির সেনা বাহিনী।
মিয়ানমারে অনেকদিন মানবাধিকার নিয়ে গবেষণা করে আসছেন ডেভিড সক্ট ম্যাথিসন। তিনি বলেন, ‘সব সমালোচনা হয় সু চির বিপক্ষে। আর এদিকে তাতমাদাও (মিয়ানমারের সেনাবাহিনী) যা খুশি করতে যাচ্ছে। আগের মতোই সেনাবাহিনী গ্রাম পুড়িয়ে দেয় ও বাড়িঘর ধ্বংস করছে।’

নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা এখানে জটিল রাজনীতির অংশ। রাজনৈতিক ক্ষত ছাড়া অর্ধশতাব্দীর সামরিক শাসন থেকে কোন দেশ বেরিয়ে আসতে পারে না। কূটনীকিরা জানান, অং সান সুচির জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার পালাবদল করার বিষয়টি হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে।

পশ্চিমা সিনিয়র এক কূটনীতিক বলেন, ‘সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে কোনও সমন্বয় নেই। তাদের সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হয় না।’ তিনি  আরও বলেন, ‘এটা আমার জন্য সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়।’

যে কারণে মুখে কুলুপ এঁটেছেন মিয়ানমারের বিদেশি কূটনীতিকরা

মিয়ানমারের দীর্ঘ সেনা শাসনের অবসান ঘটিয়ে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসায় সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পেয়েছিলেন দেশটিতে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। কিন্তু তাদের স্বপ্নভঙ্গ হতেও বেশি সময় লাগেনি। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই জাতিসংঘ মিয়ানমার বিষয়ে একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন তৈরি করে। এতে সেনাবাহিনী ও সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনে কঠোর না হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন রিচার্ড হর্সে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, পরামর্শ দেওয়া ও প্রবেশাধিকার বন্ধ রয়েছে। যা মানবাধিকার ও মানবিক পদক্ষেপকে নিম্নগামী করছে। এর ফলে সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক জটিল ও অবনতি হচ্ছে।

হর্সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ২০১৫ সালের নির্বাচনের পর কতো দ্রুত গণতন্ত্রের সুসময় শেষ হয়ে গেছে। তিনি লিখেছেন, ‘দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার আরেকটি দেশ হিসেবে মিয়ানমার যদি জাতীয়তাবাদী ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠে তাহলে আমাদের অবাক হওয়া উচিত হবে না। সঙ্গে বাড়বে জাতিগত উত্তেজনা।’

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দেশটির ক্ষমতায় থাকা সু চি কেমন ভূমিকা রাখতে পারবেন- এ বিষয়ে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক (২০০৯-১৪)  রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল (অবসর) অনুপ কুমার চাকমা বলেছেন,  “সু চি তার ভূমিকার কথা ক্ষমতায় আসার আগে একটি বক্তব্যে জানিয়েছেন। সু চি বলেছেন, ‘আমি মার্গারেট থ্যাচার নই, আমি মাদার তেরেজা নই; আমি একজন রাজনীতিক’। এর মধ্য দিয়েই সু চি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি মিয়ানমারের লৌহ মানবী নন কিংবা মানবতা ও মানুষের কল্যাণে মাদার তেরেজার মতো নিজের জীবন বিলিয়ে দেবেন না। ফলে যে কারও পক্ষে তার সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারা সহজ এবং তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা উদ্বেগের।”

কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির

মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন জানিয়ে সর্বোচ্চ চাপ দেওয়ার কথা জানিয়ে কূটনীতিকরা সন্তুষ্ট থাকলেও অনেক মানবাধিকার সংগঠন বলছে তা যথেষ্ট নয়।

নরওয়ের রিফিউজি কাউন্সিলের মহাসচিব জ্যান এগল্যান্ড বলেছেন, ‘পৃথিবীতে খুব কম স্থান আছে যেখানে আমরা যেতে পারি না। আমাদের রাখাইনে একটি অফিস আছে, কর্মী আছে, সেখানে কিছু ত্রাণও আছে। কালই ট্রাক নিয়ে সেই ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি। কিন্তু আমাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে।’ এই বাধা দেওয়াকে অবৈধ উল্লেখে করে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করা এগল্যান্ড এই পরিস্থিতিতে ধৈর্য হারিয়ে বলছেন, ‘আমি সব কূটনীতিকদের একটি বার্তা দিতে চাই। আমি মনে করি না যে এখানকার পরিস্থিতি খুব জটিল।  আমার কাছে বিষয়টি একেবারেই সহজ। যদি ত্রাণ পৌঁছানো না যায় তবে অনেকের মৃত্যু হবে।’

 

/এএ/
সম্পর্কিত
তাইওয়ানের পূর্ব উপকূলে সিরিজ ভূমিকম্প
আবারও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করলো উত্তর কোরিয়া
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
সর্বশেষ খবর
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
ঢাবির সুইমিংপুলে শিক্ষার্থী মৃত্যু: বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটি
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
‘লম্বা’ নায়িকা প্রসঙ্গে কৃতির ব্যাখ্যা
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
ভান মুন নোয়াম বমকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
কারিগরির সনদ জালিয়াতি: সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ডিবি কার্যালয়ে
সর্বাধিক পঠিত
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
রাজকুমার: নাম নিয়ে নায়িকার ক্ষোভ!
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
টাকা উড়ছে রেস্তোরাঁয়, নজর নেই এনবিআরের
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
সাবেক আইজিপি বেনজীরের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবে দুদক
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
তাপপ্রবাহ থেকে ত্বক বাঁচানোর ৮ টিপস
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ
মাতারবাড়ি ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনছে বাংলাদেশ