X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

এএজিসি দিয়ে চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডকে টেক্কা দিতে চায় ভারত-জাপান

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
০৯ নভেম্বর ২০১৭, ০২:১৭আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০১৭, ০৩:১৭

এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর (ছবি- সংগৃহীত) নিরাপদ নতুন বাজার ও রফতানি বৃদ্ধির দৌড়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পুরনো ঔপনিবেশিক পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে পারে চীন ও ভারত। নতুন সহস্রাব্দে তারা অপেক্ষাকৃত কম এলাকায় নতুন বাণিজ্য রুট খুলেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনাগুলোর সঙ্গে অতীত ঔপনিবেশিক পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) বা ভারত-জাপানের এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর (এএজিসি) প্রকল্পের মতো নতুন বৈশ্বিক অবকাঠামো উদ্যোগ বহুমুখী। এক্ষেত্রে নৌপথের চেয়ে সড়ক পথের ওপর বেশি নির্ভর করা হয়। এসব প্রকল্প স্পন্সর বা পৃষ্ঠপোষক দেশগুলোকে তাৎক্ষণিক মুনাফা এনে দেয় না। তার বদলে এখানে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সুবিধা আসবে। সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হচ্ছে— অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য প্রক্রিয়ার মধ্যে দুর্বল অংশীদারদের কাছ থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা তছনছ করা এখানে মুখ্য উদ্দেশ্য নয়।
ভারত-জাপানের এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোরে জাপান অন্তত ২০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই প্রকল্পে ভারতীয় বিনিয়োগের ঘোষণা এখনও আসেনি। দিল্লিভিত্তিক বিশ্লেষকদের ধারণা, ভারত প্রাথমিকভাবে ৪০ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে। তবে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের জন্য চীনের বরাদ্দ করা বিনিয়োগের পরিমাণ এর চেয়ে ঢের বেশি। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০টি দেশকে যুক্ত করতে চায় বেইজিং। এর পেছনে ব্যয় হবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার। যাই হোক, এই অর্থ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ব্যয় হবে।
ভারত-জাপানের এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর (এএজিসি) প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার। দিল্লির কূটনীতিক মহলও এটা স্বীকার করছে, এএজিসি প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণ ও এর প্রভাবের বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে চীন। এ প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়টি তারা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখছে।
চীনের এমন উদ্বেগ বিবেচনায় ভারতীয় থিংক ট্যাংক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দু’টি প্রকল্প প্রতিযোগিতামূলক নয়। তারা বলছেন, চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প মূলত অর্থনৈতিক লেনদেন এবং দীর্ঘ দূরত্বে পণ্য সরবরাহের ওপর জোর দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন হাইওয়ে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি অর্থনৈতিক গণ্ডিতে পরিণত হবে। সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে এটি একটি পরিচিত বিষয়। রাস্তাঘাট তৈরির সুবিধা হিসেবে সংলগ্ন এলাকায় গ্যারেজ, হোটেল, অফিস, সেবা প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ ইউনিট, পর্যটন ও হাউজিংসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত হয়। স্থায়ী চাকরির একটি প্রজন্ম নিশ্চিত হয়ে যায়।
এছাড়া, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের ক্ষেত্রে চীনের মূল ভাবনার জায়গা হলো চীনকে উৎপাদন কেন্দ্রের মধ্যে রেখে নতুন নতুন দেশের সঙ্গে সরাসরি সড়কপথে যোগাযোগ তৈরি করা। এটা চীনের উৎপাদন ও রফতানি সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্যই করা হচ্ছে, যে সক্ষমতা বর্তমানে গড় মানে পৌঁছাচ্ছে না।
দিল্লির বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যদিকে এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোরের লক্ষ্য খানিকটা ভিন্ন। জাপানও চীনের মতো নিজেদের রফতানি বাড়ানোর জন্য মুখিয়ে রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তাদের নীতি চীনের চেয়ে আলাদা। চীন যেখানে বিদেশের বাজারে স্থানীয় উৎপাদনকারীদের প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে দিয়ে বাজার দখলে রাখতে চায় এবং সাশ্রয়ে পণ্য সরবরাহের জন্য নিম্নমানের পণ্যও বাজারজাত করে থাকে; জাপান ঠিক এই নীতিতে বিশ্বাস করে না।
চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প (ছবি- ব্লুমবার্গ-দ্য স্ট্রেইট টাইমস) রফতানির সম্ভাব্যতা বিচারে এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর জাপানকেও রফতানি বাড়াতে সহায়তা করবে। এ ক্ষেত্রে জাপানের রফতানি পণ্যের তালিকায় থাকবে আইটি সফটওয়্যার থেকে ভোগ্য পণ্য এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি থেকে বিভিন্ন ধরনের গ্যাজেটের মতো হাই-এন্ড পণ্য। জাপানে উৎপাদিত পণ্য মানেই উন্নততর প্রযুক্তি ও উন্নতমান। এর ফলে পরিমাণে পণ্যের রফতানি কম হলেও এ থেকে জাপানের আয় বেশি হওয়াটা নিশ্চিত হবে।
এর বাইরে, প্রযুক্তিগত সহায়তায় অংশীদারিত্ব ও দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগে হাতে নেওয়া প্রকল্পের ওপর জোর জাপান জোর দিতে চায় বলে জানিয়েছে জাপান সরকারের বিভিন্ন সূত্র। এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোরে সড়কপথের যোগাযোগ ছাড়াও যেসব দেশের ওপর দিয়ে এই রাস্তা যাবে সেসব দেশে বিশেষায়িত শিল্পের হাব গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে।
এই বার্তা ইঙ্গিতপূর্ণ হলেও এটা স্পষ্ট, ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডের মতো এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোর কেবলই এর প্রধান পৃষ্ঠপোষককে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে না। বরং এই করিডোরটি চীনের রফতানি বাণিজ্যের প্রতি কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ, যেটি বেইজিংও খুব ভালো করেই জানে। চীন এখন বলছে, স্পষ্টতই ভারত ও জাপান তাদের কাছ থেকেই আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের রুট তৈরির ধারণাটি চুরি করে নিয়েছে।
এদিকে, আন্তর্জাতিক এসব রুটের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিযোগিতার জায়গাটি হবে নিঃসন্দেহে চীন ও জাপানের পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপে নিয়ে। তবে ভারতও এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের পণ্যসম্ভার নিয়ে হাজির হওয়ার সুযোগটি পাচ্ছে। এটা বেইজিংয়ের জন্য সুখকর নয়। তারপরও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে খোলাখুলিভাবে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন এবং পশ্চিমা বিশ্বের আরোপ করা বিভিন্ন বাণিজ্য বাধা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন, তখন কেবল অবন্ধুত্বসুলভ প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডোরের বিরোধিতা করা চীনের জন্য কঠিন।
কলকাতার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এশিয়া আফ্রিকা গ্রোথ করিডরের জন্য চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কেরও নতুন বোঝাপড়া দরকার। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গেও এর জন্য সমন্বয় প্রয়োজন। মিয়ানমার ও শ্রীলংকার মতো দেশে চীন কর্তৃপক্ষের জনপ্রিয়তা আগের থেকে কমে গেছে। এসব দেশে চীন বিভিন্ন খাতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। তবে সংশ্লিষ্ট সরকার ও দেশগুলোর জনগণের অভিজ্ঞতা এখন তাদের বিরুদ্ধে, যা স্থানীয়দের মধ্যে বিতর্কও তৈরি করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিপাক্ষিক তিক্ত বিতর্কের সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ হলো মিটস্টোন ও হাম্বানটোটায় ইরাবতী নদীতে চীনের বাঁধের একটি প্রকল্প। এর মধ্যে প্রথম স্থানটিতে প্রকল্প বাতিল করে দ্বিতীয় স্থানে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এর বাইরে মিয়ানমার ও শ্রীলংকায় চীনের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও রয়েছে নানামুখী বিতর্ক। এসব প্রকল্পের লাভ সবসময়ই কেন চীনের পক্ষে যায়, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন এসব দেশের মানুষ। পরিবেশের ক্ষতি, স্থানীয়দের কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণের সুযোগ কমে যাওয়া, প্রযুক্তির স্থানান্তরে ঘাটতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে এসব দেশে রয়েছে অসন্তোষ।
এমনকি, পাকিস্তানেও এমন প্রশ্ন রয়েছে যে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরটি (সিপিইসি) পাকিস্তানকে চীনের অধীনস্ত উপনিবেশে পরিণত করে ফেলবে কিনা। দুই দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার বিশাল ঘাটতি, বিপুল নিরাপত্তা খরচ ও পাকিস্তানের ঘাড়ে বিশাল অঙ্কের ঋণের (বর্তমানে আনুমানিক ৫২ বিলিয়ন ডলার) কারণেই এই প্রশ্নটি তুলছেন পাকিস্তানিরা।
এদিক থেকে ভারত এখন পর্যন্ত চীনের কূটনৈতিক সম্প্রসারণের নীতিকে ধারণ করার কৌশল বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। চীনের ওয়ান বেল্প ওয়ান রোডের অংশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশ-চায়না-ইন্ডিয়া-মিয়ানমার (বিসিআইএম) উদ্যোগে সহায়তা করছে ভারত। বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বিবিআইএন ট্রাফিক চুক্তিও করেছে ভারত।
এছাড়া, সিপিইসি বয়কট করার মাধ্যমে ভারত এটাও নিশ্চিত করেছে যে, কেবল পাকিস্তান থেকে যেন চীনকে বিনিয়োগের টাকা তুলতে কষ্ট করতে হয়। তাছাড়া, এর মাধ্যমে পাকিস্তানকেও ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রাক্কলিত অর্থের চেয়ে অনেক বেশি খরচ করতে হবে। রাশিয়া ও ইরানও সিপিইসি করিডোর ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় নিলে এসব দেশ বিশ্ব রফতানি বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার করে না।

/এমপি/টিআর/
সম্পর্কিত
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
সর্বশেষ খবর
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
বাড়তি ফসল মিষ্টিকুমড়ায় কৃষকের মুখে হাসি
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ধাক্কা মেরে ফেলে চাপা দিলো কাভার্ডভ্যান, মোটরসাইকেলচালক নিহত
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!