X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়েমেন-লেবাননকে ইরানবিরোধী ‘ছায়াযুদ্ধের নাট্যমঞ্চ’ বানিয়েছে সৌদি আরব

বাধন অধিকারী ও ফাহমিদা উর্ণি
১০ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:২০আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪০

বাদশাহ সালমান ও যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ছবি ১৯৭৯ সালে ইরানে সংঘটিত ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই দেশটিকে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পরিসরে শক্ত প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে আসছে সৌদি আরব। সুন্নি মুসলিমপন্থী সৌদি আরবের আশঙ্কা, শিয়াপন্থী ইরান তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। ইরাকযুদ্ধ ও আরব বসন্তের সুযোগ নিয়ে বাড়াতে পারে অঞ্চলগত প্রভাব। বাগদাদ, দামেস্ক, সানা ও বৈরুতের ধারাবাহিকতায় তেহরান মধ্যপ্রাচ্যের বাদবাকি দেশগুলোকে নিজেদের কব্জায় নিতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে সৌদি আরবের।  এই বাস্তবতায় মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করার লড়াইয়ে নেমেছে তারা। দেশের অভ্যন্তরে দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ের নামে আর ইরানঘনিষ্ঠ  ইয়েমেন-লেবাননের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ তুলে তেহরানবিরোধী ছায়াযুদ্ধ শুরু করেছে সৌদি আরব। 

জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, ইয়েমেন আর লেবাননকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার লড়াই নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রা পেতে পারে। আর মার্কিন সাময়িকী আটলান্টিকের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী বলা যায়, সাম্প্রতিক সৌদি তৎপরতা লেবানন আর ইয়েমেনকে ইরানবিরোধী ছায়াযুদ্ধের নাট্যমঞ্চে রূপান্তরিত করেছে।

সম্প্রতি সৌদি আরবে  যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কথিত দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান চলাকালেই ইয়েমেন থেকে রিয়াদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সংঘটিত হয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ঘটনাটি মোহাম্মদ বিন সালমান ও সৌদি নেতৃত্বের জন্য ভীতিকর আর হুথি বিদ্রোহী ও তাদের পৃষ্ঠপোষক ইরানের জন্য উচ্ছ্বাসের। সোমবার সৌদি সংবাদমাধ্যম আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানানো হয়, যে এই ঘটনাকে সৌদি আরব যুদ্ধ ঘোষণা বলে বিবেচনা করছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবায়ের বলেন, ‘ইরানের যেকোনও যুদ্ধ আচরণকে জবাব দেওয়ার অধিকার রাখে সৌদি রাজপরিবার। আমরা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে কোনও ছাড় দেবো না।’ ‘এক্ট অব ওয়ার’ শিরোনামের ওইসংবাদে আরও বলা হয়, সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট এই ঘটনাকে ‘ইরানি শাসনের সামরিক আগ্রাসন’ বলে অভিহিত করেছে। 

ইরান-সৌদি আরব

মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কৌশলগত কারণে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা এমন একটি জটিল প্রক্রিয়ায় পড়ে গেছে, যেখান থেকে তারা বের হতে পারছে না। ইয়েমেনি প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদিকে নিয়েও বিপাকে রয়েছে সৌদি জোট। এর ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এটাই ইঙ্গিত করে যে সৌদি জোট লড়াইয়ে হার মানছে। তবে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান পরিস্থিতি পাল্টে দিতে চান। যারাই তার সঙ্গে দেখা করেছেন সবাইকে বারবারই কঠোর পদক্ষেপের কথা বলেছেন তিনি। ইরান ও তার সহযোগী দেশগুলোর বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে চান তিনি।

সম্প্রতি জীবননাশের আশঙ্কা জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি। সৌদি আরব থেকে সরাসরি টেলিভিশন সম্প্রচারে পদত্যাগের ঘোষণা দেন তিনি। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল জুবেইর দাবি করেছেন, হারিরি ইচ্ছে করলে যেকোনও সময়ে সৌদি আরব ছেড়ে চলে যেতে পারেন। তবে লেবাননের সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ এ দাবি উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন, সৌদি আরবের চাপেই পদত্যাগ করেছেন সাদ হারিরি। হারিরি যে বিবৃতিটা পড়েছেন সেটাও সৌদির লিখে দেওয়া বলে দাবি করেন তিনি।

৯ নভেম্বর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো উত্তেজনাপূর্ণ বাস্তবতার খবর দিয়েছে।  যুদ্ধ সতর্কতা না দেওয়া হলেও লেবানন থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের সরে যেতে বলেছে সৌদি আর আমিরাত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই চলে এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে।

মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আলি আব্দুল্লাহ সালেহর পতনমুখী শাসনাধীন ইয়েমেনকে সুবিধাপ্রাপ্তির স্থান হিসেবে বিবেচনা করতো ইরান। দেশটি ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদেরকে যে সাংগঠনিক সহায়তা ও তহবিল সরবরাহ করতো তা নিছক কৌশল। পরবর্তীতে সালেহ ক্ষমতা হারান। তবে তিনি হুথিদের সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্ট হাদির (সৌদি আরবে গৃহবন্দী আছেন) বিরুদ্ধে জোট গঠন করেন। এদিকে ইয়েমেনে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার নামে ইরান-সমর্থিত হুথিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়ে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। তবে  সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়েও হুথিদেরকে জায়গা থেকে সরাতে পারেনি সৌদি বিমান বাহিনী। তবে ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের বন্দর শহর এডেনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাহিনী সফলতা পেলেও ইয়েমেন ভূখণ্ডকে আশ্রয়স্থল বিবেচনাকারী আল-কায়েদার মতো সংগঠনগুলোর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় এ বাহিনীকে। সেদিক থেকে বলা যায়, ইয়েমেনে সৌদি আরববিরোধী অবস্থান দেখিয়ে এবং হুথিদের সমর্থন জানিয়ে ইরান যে সফলতা পেয়েছে তার জন্য দেশটিকে কোনও ব্যয় করতে হয়নি। একেবারেই নিখরচায় চলে এসেছে সাফল্য।

সৌদি-ইরান উত্তেজনার প্রতীকি ছবি

সিএনএন বলেছে, সিরিয়া ও ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস যখন তার সব ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পতনের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখন লেবাননকে ঘিরে সৌদি রাজতন্ত্র ও ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরানের মধ্যকার দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব আবার উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এক্ষেত্রে লেবানন এমন একটি দেশ, যার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর জন্য তেহরান ও রিয়াদ একে অপরকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।

সংবাদমাধ্যম নিউজ উইককে উপসাগরীয় বিষয়ক সংস্থার পরিচালক আলি আল-আহমেদ বলেন, "দুই দেশের মধ্যে বাড়তে পারে উত্তেজনা। ইয়েমেনে সৌদি জোটের বোমা হামলা আর  এর বিপরীতে ইরান কর্তৃক হুথি বিদ্রোহীদের প্রযুক্তি ও অস্ত্র সহায়তা দেওয়া শুরু হওয়ার পর থেকে সেই সম্ভাব্য উত্তেজনা একটি স্বতঃপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে উঠেছে। ,"

সৌদির উপসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক (গাল্ফ অ্যাফেয়ার্স) মন্ত্রী থামের আল-সাবহান আল আরাবিয়া টেলিভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘লেবাননের সরকারকে সৌদি আরবের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণাকারী সরকার হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’

ক্ষমতায় থাকার এক বছরে হারিরি প্রশাসন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় হারিরির নেতৃত্বাধীন প্রশাসনকে দায়ী করে সাবহান।

ইয়েমেনের শনিবারের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রচেষ্টার জবাব খুব দ্রুত দিয়েছে সৌদি আরব। তার ওপর, পরদিন নাটকীয়ভাবে দেশটি ঘোষণা দিয়েছে ইয়েমেনের সঙ্গে স্থল, নৌ ও আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়ার। রিয়াদ ৪০ জন হুথি বিদ্রোহীর নামেও ছবি প্রকাশ করেছে এবং বলা হয়েছে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ সংঘটনের অপরাধে তাদেরকে খোঁজা হচ্ছে। তাদেরকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছে। এরমধ্যে হুথি নেতা আব্দুলমালিক বাদের আল হুথির জন্য ৩০ মিলিয়ন ডলার, তার শীর্ষ ১০ সহযোগীর জন্য ২০ মিলিয়ন ডলার, পরবর্তী পর্যায়ের সহযোগীদের জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়।

কেউ কেউ অবাক হচ্ছেন কেন সৌদি আরবকে এ ধরনের প্রণোদনা বা পুরস্কার ঘোষণার জন্য এতো দীর্ঘ সময় নিতে হলো? ইয়েমেন এমন একটি দেশ যেখানে এমনকি আনুগত্য স্বীকারের জন্যও মূল্য দিতে হয়। ইয়েমেনকে একটি কম গুরুত্বপূর্ণ, দরিদ্র প্রান্তিক দেশ হিসেবে না দেখে হাউস অব সৌদের প্রিন্সরা দেশটিকে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর বলেই মনে করেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দাদা ইবনে সৌদ মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ইয়েমেনের হুমকি নিয়ে হুঁশিয়ার করেছিলেন। দ্য আটলান্টিকের বিশ্লেষণে বলা হয়, ইরানের সঙ্গে যতদিন আঞ্চলিক প্রক্সি যুদ্ধ চলবে ততোদিন ইয়েমেন ওই যুদ্ধের নাট্যমঞ্চ হিসেবে এবং মোহাম্মদ বিন সালমানের আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।

/এফইউ/বিএ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!