X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

সৌদি তৎপরতায় হুমকিতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদন, বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

আরশাদ আলী
১৬ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:২৫আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৩

সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস)-এর নেতৃত্বে দেশটিতে পরিচালিত কথিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের সমান্তরালে মধ্যপ্রাচ্যে ঘটে চলছে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ। নভেম্বরের শুরুতে এমবিএসের এই অভিযানের আগে-পরে এমন কিছু রাজনৈতিক ঘটনা রয়েছে, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করেছে। হুমকির মুখে পড়েছে অঞ্চলটির তেল উৎপাদন। অতীত অভিজ্ঞতায় প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রভাব পড়তে দেখা গেছে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে। তবে এবার তা হয়নি। রাজনৈতিক সংকটে যখন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য তেলের উৎপাদন কমিয়ে আনছিল, তখন রেকর্ড পরিমাণ তেল উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিভিন্ন পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ থেকে ঘটনাটিকে আন্তর্জাতিক তেল বাজারে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। এতে চাঙ্গা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি।

তেলের উৎপাদনে সৌদি আরবকে ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র

ইরাক ও সিরিয়ায় দখলকৃত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। আইএসকে হটানোর পর মধ্যপ্রাচ্যে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ হাজির হয়েছে। ইরাকে কুর্দিরা স্বাধীনতা চাইছে, আর সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিদ্রোহীরা বেশ কিছু অঞ্চল দখল করেছে। এরমধ্যে তেলসমৃদ্ধ দেইর এজ জোর অঞ্চলও রয়েছে। একইসঙ্গে তুরস্কও কুর্দিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়েছে। আইএসবিরোধী যুদ্ধের পর সিরিয়ায় অবস্থান শক্তিশালী করেছে ইরান ও রাশিয়া। লেবাননের হেজবুল্লাহকে কাজে লাগিয়ে সিরিয়ায় আইএসবিরোধী লড়াইয়ে ভূমিকা রাখে ইরান। একই সময়ে কুর্দিদের সঙ্গে তেলের চুক্তি করেছে রাশিয়া। যা ইরাকে  রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টপাল্টি প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ দেয়।

মধ্যপ্রাচ্যে যখন রাজনৈতিক সমীকরণ নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে, তখন সৌদি যুবরাজের নেতৃত্বে দেশটিতে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে চলে ব্যাপক ধরপাকড়। ১১জন প্রিন্সসহ পাঁচশতাধিক মানুষকে আটক করা হয়, বাজেয়াপ্ত করা হয় কয়েক হাজার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সর্বাধিক তেল উৎপাদনকারী দেশে এই অভিযানে দেখা দেয় নতুন সংকট। একই সময়ে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি সৌদি আরব থেকে দেওয়া টেলিভিশন ভাষণে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। মধ্যপ্রাচ্যের দীর্ঘ দিনের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান ও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নেয়। ইয়েমেন থেকে ইরান সমর্থিত শিয়া হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ লক্ষ কলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।  সৌদি আরব লেবাননের হেজবুল্লাহ ও ইরানের যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগ আনে। বাহরাইন দাবি করে তাদের প্রধান তেলের পাইপলাইনে ইরান সমর্থিত বিদ্রোহীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। বাহরাইনে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকার করে ইরান। কিন্তু সৌদি আরব নিজেদের স্থাপনা সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা জোরদার করে। এই  সংকটময় পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটায়।

মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারে রাশিয়ার প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা

গত কয়েক মাসে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রজনেফট ভারত ও মিসরে কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে বড় ধরনের চুক্তি করে রশিয়া। রজনেফট তেল কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইগর সেচিন জানান, ইরান সরকারের সঙ্গে রাশিয়ার কয়েকটি কোম্পানি ছয়টি পৃথক চুক্তি করেছে। এসব চুক্তির আওতায় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলার। এসব চুক্তির বেশিরভাগই তেল ও গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কিত।

ইরানের কর্মকর্তারা জানান, চারটি তেল ও গ্যাসক্ষেত্র ২০১৮ সালের মার্চের দিকে রুশ কোম্পানি লুকওয়েল ও গ্যাজপ্রম পেতে পারে।

এর দুই সপ্তাহ আগে রসনেফট কুর্দিস্তানের সবচেয়ে বড় তেলের পাইপলাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ১৮০ কোটি ডলারে এই নিয়ন্ত্রণ নেয় রাশিয়া। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি অবকাঠামো এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে।

রসনেফট ভূমধ্যসাগরীয় ও আফ্রিকার দেশগুলোতে নতুন চুক্তি করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে যেসব অঞ্চলের তেল ছাড়াও কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে।

কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের জ্বালানি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ অ্যামি মায়ার্স জেফ বলেন, রসনেফট ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে নিজেদের বিনিয়োগ করতে চাই। এসব চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্র প্রশ্নে এসব এলাকার সুবিধার কথা রুশ সরকারকে ভালোভাবেই তুলে ধরতে পেরেছে তারা।

সৌদি সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের পোয়াবারো

মধ্যপ্রাচ্যের সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারের জন্য নতুন সম্ভাবনা হাজির করেছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ও ব্যবসায়ীরা তেলের উৎপাদন নিয়ে শঙ্কায় থাকলেও বিপরীত চিত্র যুক্তরাষ্ট্রে। এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাকৃতিক তেল উৎপাদন রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা দেশটির অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। একই সঙ্গে তা মধ্যপ্রাচ্যের তেলের বাজারের জন্য অশনি সংকেত।

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন ছিল ৯.৬ মিলিয়ন বিপিডি। যা গত বছর তেলের উৎপাদন কমে যাওয়ার পর সর্বোচ্চ। গত বছর তেলের উৎপাদন ছিল ৮.৪ মিলিয়ন বিপিডি।

দ্য ন্যাশনাল পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য মধ্যপ্রাচ্যের জন্য দুঃসংবাদ।  দ্য ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) পূর্বাভাসে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের  তেলের উৎপাদন ২০২১ সাল নাগাদ ৫০ শতাংশ বাড়তে পারে।

তেলের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সুবিধাও পাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তেল উৎপাদনকারীরা। এখন প্রতি ব্যারেল তেলের মূল্য প্রায় ৬০ ডলার। ওপেক ও রাশিয়া দুই বছর আগে তেলের বাজারে দরপতনে উৎপাদন কমিয়ে এনেছিল। তখন থেকেই তেলের মূল্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ওপেক ও রাশিয়ার এক ধরনের যুদ্ধ চলছিল। কিন্তু তেলের বাজার চাঙ্গা হতেই যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের উৎপাদন বাড়িয়ে ওপেক ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ওপেক ও রাশিয়া তাদের উৎপাদন কমানোর চুক্তি আরও একবছর বহাল রাখতে পারে। 

 

সৌদি আরবের তেলের উৎপাদন ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল প্ল্যাটস রিগডাটার সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের তেলের ড্রিলিং রিগের সংখ্যা ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৭ সালে তৃতীয়ার্ধে ড্রিলিং রিগের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৩১টি। ফলে তেলের উৎপাদন যত বাড়বে, তত রফতানির সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। নভেম্বর মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশে পাঠানোর তেলের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২.১ মিলিয়ন বিপিডিতে পৌঁছেছে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল অ্যানালাইটিকসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের পর এই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের পেট্রোলিয়াম খাতে মাসিক বাণিজ্যঘাটতি দুই তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এখন তা ১০ বিলিয়ন ডলারে রয়েছে। ছয় বছর আগে বছরে বার্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৩২৬ বিলিয়ন ডলার। বার্ষিক হিসেবে বাণিজ্য ঘাটতি কমেছে ৮০ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারের এই সাফল্যের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা কাজ করেছে। এক তেলব্যবসায়ী বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরাক-ইরান সীমান্তে ভয়াবহ ভূমিকম্পেও মধ্যপ্রাচ্যে তেলের উৎপাদনে হয়ত প্রভাব ফেলতে পারে।

আইইএ তাদের ওয়ার্ল্ড এনার্জি আউটলুক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন আগামী আট বছর অব্যাহত থাকবে। পূর্বাভাস অনুসারে, ২০২৫ সালে সৌদি আরবের তেলের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তেল আমদানিকারক দেশ থেকে তেল রফতানিকারক দেশে পরিণত হবে। ২০২৫ সালে সবেচেয়ে বৃহত্তম এলএনজি রফতানিকারক দেশ হবে যুক্তরাষ্ট্র।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষক গ্রেগরি ব্রিউ জানান, যুক্তরাষ্ট্র তেল রফতানিকারক দেশ হলেও মধ্যপ্রাচ্য ও কানাডা থেকে আমদানি অব্যাহত রাখবে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানির ৩৬ শতাংশ সৌদি আরবের সৌদি আরামকো সরবরাহ করে। যুক্তরাষ্ট্রের তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ফলে সৌদি নির্ভরতা কমবে। সৌদি আরব বাধ্য হবে আরও কম মূল্যে যুক্তরাষ্ট্রকে তেল সরবরাহ করতে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক থেকেও তেল আমদানি করবে।

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
বিরল সূর্যগ্রহণ দেখতে নায়াগ্রা জলপ্রপাতে জড়ো হবেন ১০ লাখ দর্শনার্থী
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা