X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘রোহিঙ্গা কূটনীতি’র পরীক্ষায় পোপ কি সফল হবেন?

বাধন অধিকারী
২৭ নভেম্বর ২০১৭, ২১:৩৮আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪০

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি পোপ ফ্রান্সিসের দৃষ্টিভঙ্গি ইতিবাচক ও সমবেদনামূলক। তবে মিয়ানমারে নামার আগে ও পরে বিপন্ন ওই জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে কোনও রকম মন্তব্য না করার হুমকি পেয়েছেন তিনি। পরিচয়গত স্বীকৃতির প্রশ্নে রোহিঙ্গাদের নাম উচ্চারণ করতে মিয়ানমারের ডি-ফ্যাক্টো সরকার ও বৌদ্ধবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে তাকে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মিয়ানমারে এক কঠিন কূটনৈতিক পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন ক্যাথলিক ইতিহাসের আালোচিত এই পোপ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই কূটনৈতিক পরীক্ষায় তিনি কেবল রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন না তুলে মিয়ানমারের সমস্ত নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে সরব হবেন।

কার্টুনচিত্রটি প্রকাশ করেছে ম্যানিলা বুলেটিন।

এ বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালানো শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা ও ধর্ষণ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে ছয় লাখেরও বেশি  রোহিঙ্গা। এই ধারা এখনও অব্যাহত আছে। জাতিসংঘ এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে উল্লেখ করেছে। তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে সেনাবাহিনী। দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্ট অং সান সু চি’ও তাদের নিয়ে ইতিবাচক কোনও মন্তব্য করেননি। লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস বলছে,  পোপ ফ্রান্সিসের এই সফর মূলত কূটনৈতিক হলেও এই বাস্তবতায় এটি হবে তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।এক প্রতিবেদনে ওই মার্কিন সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শব্দ উচ্চারণে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চি এবং দেশটির সেনাবাহিনীর আপত্তি থাকায় কার্ডিনাল চার্লস মং বো পোপকে তা উচ্চারণ করতে মানা করেছেন।

 

আগেই পোপ রোহিঙ্গাদের আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে সরব অবস্থান নিয়েছিলেন। এ বছরের আগস্টে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহতায় তাদের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। বলেছিলেন, ঈশ্বরের কাছে আমরা সবাই প্রার্থনা করি তিনি যেন তাদের সুরক্ষিত রাখেন। তাদের সাহায্যে বাকিদের এগিয়ে আসতে বলেন―যারা তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে পারবে। মানবিক আবেদন জানাতে গিয়ে চলতি বছরেই দুই দুইবার রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেছেন পোপ ফ্রান্সিস। সফরের আগের দিন এক ভিডিও বার্তায় পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, এমন সম্মান ও উৎসাহের জায়গা থেকে আমি দেশটি সফর করতে চাই যেখানে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রতি পারস্পরিক মেলবন্ধন ও সহযোগিতার প্রচেষ্টা বিদ্যমান থাকবে।

পোপের সফরসূচিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একটি বৈঠক। মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গেও তার বৈঠকের কথা রয়েছে। এবিসি নিউজের এক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পোপ ফ্রান্সিস এমন বিপরীতমুখী অবস্থানের দুই গোষ্ঠীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কেবল সমন্বয়ের পথ নিতে। তিনি পরিস্থিতিকে বুঝে নেওয়ার যে অঙ্গীকার করেছেন তার যথার্থতা প্রমাণেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পোপের এই অঙ্গীকার রক্ষায় দরকার দক্ষ কূটনীতি।

রোহিঙ্গা হিসেবে রাখাইনের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আখ্যায়িত না করতে পোপের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে মিয়ানমার

এবিসি নিউজের ওই খবরে বলা হয়েছে, জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম দেশ মিয়ানমার। বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীই সেথানে কোনও না কোনোভাবে নিপীড়ন নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাসের এলাকাগুলো প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। তেল-গ্যাসসহ মূল্যবান পাথরের মতো খনিজ সম্পদে হানা দিতে মিয়ানমারে বৌদ্ধদের উগ্র জাতীয়তাবাদী তৎপরতাকে ব্যবহার করা হয়। চীনের মতো বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে এসব সম্পদ উত্তোলন ও তার ব্যবহারে চুক্তিও করেছে মিয়ানমার সরকার। 

সিএনএন-এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কেবলই আনুষ্ঠানিকতা নয় পোপের এই সফর। এটি মানবতা ধর্ম আর কূটনীতির মধ্যে সমন্বয়।  অস্ট্রেলিয়ার লোয়া ইন্সটিটিউটের রিসার্চ ফেলো আরন কোনেলি সিএনএনকে বলেছেন, নিশ্চয় এই সফর কেবলমাত্র একটা আনুষ্ঠানিকতা হবে না।  তিনি বলেন, ‘একটা বিষয় পরিষ্কার। পোপ অবশ্যই রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলবেন। এখন প্রশ্নটা হলো তিনি মিয়ানমারকে তা শক্তভাবে বলেন নাকি বন্ধুত্বপূর্ণ পথে বলেন সেটা।’

মিয়ানমারে পোপ ফ্রান্সিস

স্কাই নিউজের এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সফরে উগ্র বৌদ্ধদের নজর থাকবে পোপের দিকে। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ কথা বলেন কিনা তা কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখবে তারা। সে কারণে পোপ কোনও সংঘাত সৃষ্টি না করে সমন্বয়বাদী কূটনীতির পথ নিতে পারেন। স্কাই নিউজের আশঙ্কাকে সত্যি করে সোমবার (২৭ নভেম্বর) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়ানমারের উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংগঠন মা বা থা’র মুখপাত্র তপারকা বলেন, ‘পোপ যদি ইসলাম নিয়ে কথা বলেন সেক্ষেত্রে কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু তিনি যদি রোহিঙ্গা এবং চরমপন্থীদের নিয়ে কথা বলেন তবে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।’

মিয়ানমার সফরে পোপ ফ্রান্সিস তোপের মুখে থাকবেন বলে আশঙ্কা করছে ভ্যাটিক্যান। ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের মুখপত্র ক্রাক্স-এর ওয়েব ভার্সন ক্রাক্সনাউডটকম-এ প্রকাশিত ভ্যাটিকান এক প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে। মিয়ানমারের মাটিতে দাঁড়িয়ে পোপ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করবেন কিনা; জানতে চাইলে ভ্যাটিকানের মুখপাত্র গ্রেগ বুরকে জানান পোপকে যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে তা তিনি গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন। যে উপদেশটিকে পোপ ‘বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছেন’ বলে বুরকে জানিয়েছেন তা যদি পোপ মেনে চলেন তবে তাতে এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো ক্ষুব্ধ হবে। অবশ্য, এটি নজিরবিহীন ঘটনা হবে না: মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দিয়ে জাতিসংঘও দীর্ঘদিন ধরে এ শব্দটির ব্যবহার পরিহার করছে।

গত বছর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন পরোক্ষভাবে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। অবশ্য, রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ প্রশ্নে ভিন্ন অবস্থান দেখা গেছে। প্রতিশোধের কবলে পড়ার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করে এক রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় অ্যাক্টিভিস্ট বলেন, পোপ ফ্রান্সিস রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করলেন কি করলেন না তা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। ক্রাক্সকে তিনি বলেন, ‘তিনি এরইমধ্যে শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং আরও জরুরি বিষয় হলো তিনি আমাদেরকে তার ভাই ও বোন বলে ডেকেছেন। হোলি ফাদার ফ্রান্সিস তাই শব্দটি ব্যবহার করেন কিনা, সেটা জরুরি বিষয় নয়। সমস্যা সমাধানের উপায়ও না।’

মিয়ানমারে পোপকে স্বাগত জানিয়ে টানানো বিলবোর্ড বাংলাদেশ আর মিয়ানমার দুইটি দেশই এখন বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজরে রয়েছে। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার প্রত্যাবর্তনে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বৈধ প্রমাণপত্র হাজির করতে বলা হলেও বেশিরভাগ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছেন কেবল জীবন নিয়ে। তাছাড়া মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ায় কোনও কিছুই নেই তাদের কাছে। চুক্তির বিস্তারিত এখনও প্রকাশ করেনি কোনও দেশই।  মানবাধিকার সংগঠন  হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ওই চুক্তিকে ধোঁকাবাজি আখ্যা দিয়েছে।

বিশ্বব্যাপী খ্রিস্টান সংহতির পক্ষে কাজ করেন ব্রিটিশ মানবাধিকারকর্মী বেন রজার্স। তিনি মনে করেন, পোপ ফ্রান্সিস শান্তি, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়বিচার আর মানুষের মর্যাদার পক্ষে অবস্থান নেবেন। শেষ মুহূর্তে পোপ ফ্রান্সিস যে মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন এই মানবাধিকারকর্মী। ১৮ তারিখে রোমে মিয়ানমারের কার্ডিনাল চার্লস মং বোর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ রজার্স বলেন, আদতে সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে সংকট নিরসনের পক্ষে ভূমিকা রাখতেই বৌদ্ধসহ সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতা, সু চির পাশাপাশি সেনাপ্রধানের সঙ্গে দেখা করার এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস।

রিলিজিয়ন নিউজ সার্ভিসের কলামিস্ট ফাদার্ থমাস রেস। ক্রাক্স নিউজের কাছে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, রোহিঙ্গা প্রশ্নে পোপ সরব হলে চিন, কোচিন, নাগাতে থাকা খ্রিস্টানদের প্রতি উগ্র বৌদ্ধদের নিপীড়ন নেমে আসতে পারে। তবে কার্ডিনাল পোপকে নিষেধ করলেই তিনি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নীরব থাকবেন বলে মনে করেন না এই বিশ্লেষক। সমন্বয়ের পথ নিতে রোহিঙ্গাদের কথা বলার পাশাপাশি তাই অন্যান্য জনগোষ্ঠীর প্রতি নিপীড়নের কথা বলবেন পোপ; এমনটাই মনে করেন তিনি।

 

/টিএন/
সম্পর্কিত
সমলিঙ্গের বিয়ে অনুমোদনের পথে থাইল্যান্ড
মস্কোয় কনসার্টে হামলা: প্রশ্নের মুখে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা
সুপেয় পানির অপচয়, বেঙ্গালুরুতে ২২ পরিবারকে জরিমানা
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা