X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ট্রাম্পের জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতির নেপথ্যে

আরশাদ আলী
০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ২২:২৩আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ২৩:০৪

জাতিসংঘসহ বিশ্বনেতাদের বিরোধিতার মুখেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ট্রাম্পের আগে কোনও মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন স্বীকৃতি দেননি। যে জেরুজালেমকে মক্কা-মদিনার পর ইসলামের তৃতীয় পবিত্র স্থান ও ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী বিবেচনা করা হয়, সেই পবিত্র শহরকে ইহুদিবাদী ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বজুড়ে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ ও এর পরিণাম নিয়ে চলছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নানা বিশ্লেষণ।

ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ট্রাম্প ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দিতে পারেন– এমন খবর প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয় বিরোধিতা। আরব ও ইউরোপিয়ান নেতারা সর্তক করেছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস থেকে শুরু করে এমনকি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরাও এর বিরোধিতা করেছেন। কারণ এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মধ্যপ্রাচ্য নীতি বদলে যাবে। এছাড়া সম্প্রতি ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের এক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। পক্ষে আছেন মাত্র ৩১ শতাংশ। এমন পরিস্থিতেও ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে বেশিরভাগ সংবাদমাধ্যম নেপথ্য কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে।

প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক, এটা কূটনৈতিক ব্যাপার নয়।’ ওই প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন তখন একজন মানুষ সম্ভবত হেসেছিলেন। তিনি হলেন রিপাবলিকান পার্টির একজন বড় দাতা ক্যাসিনো ব্যবসায়ী শেল্ডন অ্যাডেলসন।’ প্রতিবেদনটিতে ট্রাম্প প্রশাসনে কিভাবে শেল্ডন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছেন তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে।

দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের দশ দিন আগে শেল্ডন অ্যাডেলসন ট্রাম্প টাওয়ারে ট্রাম্পের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন। এরপর অ্যাডেলসন পুরনো বন্ধু মর্টন ক্লেইনকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে ট্রাম্পের প্রতি আহ্বান জানান।

যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিবাদী সংগঠনের সভাপতি ক্লেইন বলেন, তিনি (শেল্ডন) খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন, আমিও। এটিই ছিল তার মনেপ্রাণে।

এই ঘটনার এক বছরের মাথায় ট্রাম্প আনুষ্ঠানিকভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন। যে ভাষণে এই স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প; তাতে তিনি বলেন, আগের প্রেসিডেন্টরা নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু তা বাস্তবায়নে তারা ব্যর্থ হয়েছেন। আজ আমি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রাম্পের কাছে জেরুজালেমের গুরুত্ব সব সময় যতটা না কূটনৈতিক ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল রাজনৈতিক। ইসরায়েলপন্থী অ্যাডেলসনের মতো ব্যক্তিদের সমালোচনার মুখে নিজের শান্তি উদ্যোগকে জটিলতায় ফেলে এবং মিত্র আরব নেতাদের সমালোচনাকে এক পাশে সরিয়ে একান্ত সমর্থকদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

এই ঘোষণা দেওয়ার অনুষ্ঠানে ট্রাম্প সেসব বিদেশি কূটনীতিকদেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন যারা এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। তবে এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জিম ম্যাথিসের পরামর্শও কানে নেননি। এই দুই মন্ত্রীর আশঙ্কা, এতে করে দুনিয়াজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব বাড়বে, বিশেষ করে যেসব দেশে মার্কিন সেনারা দায়িত্ব পালন করছে।

অ্যাডেলসন ও ইসরায়েলপন্থী মধ্যস্থতাকারীরা ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম ছয় মাসে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে না নেওয়ায় বেশ হতাশ ছিলেন। অক্টোবরে একটি ব্যক্তিগত নৈশভোজে অ্যাডেলসন বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্পকে চাপ দেন।

অ্যাডেলসন দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলপন্থী হিসেবে পরিচিত। ইহুদিবাদী দেশটির স্বার্থ রক্ষায় তিনি নিয়মিতই অর্থ ঢেলে আসছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উভয়েই নিজেদের ক্যাসিনো ব্যবসার নগদ অর্থ রিপাবলিকান পার্টি ও নেতাদের খুশি করতে ব্যয় করেছেন।

নির্বাচনি প্রচারণার শুরুতে অ্যাডেলসনের কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ট্রাম্প বৈঠক করতে চেয়েছিলেন। যদিও প্রকাশ্যে তিনি ঘোষণা দেন কোনও বড় ধরনের দাতা তার প্রয়োজন নেই।

২০১৬ সালের মার্চে ট্রাম্প ইসরায়েলকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে বর্ণনা করেন। ইসরায়েলপন্থী প্রভাবশালী লবিং গোষ্ঠী আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটিকে তিনি বলেন, আমরা মার্কিন দূতাবাস ইহুদিদের রাজধানী জেরুজালেমে সরিয়ে নেব।

অ্যাডেলসন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি ট্রাম্পকে সমর্থন করছে এমন একটি রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটিকে দুই কোটি ডলার তহবিল দেন। এছাড়া রিপাবলিকান কনভেনশন আয়োজক কমিটিকে দেন ১৫ লাখ ডলার।

ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই অ্যাডেলসন তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন। ফোনে ও হোয়াইট হাউসে উপস্থিত হয়ে তিনি এ যোগাযোগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন। নিজের প্রভাব কাজে লাগিয়ে ট্রাম্পকে চাপ দিতে থাকেন। তবে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের পেছনে অ্যাডেলসনই একমাত্র প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন না।

বিভিন্ন খ্রিস্টান গোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও ট্রাম্পকে এই বিষয়ে চাপ দেওয়া হয়। তার কাছে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে।

ফ্যামিলি রিসার্চ কাউন্সিলের সভাপতি টনি পার্কিন্স বলেন, একটি বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। এটা স্পষ্ট ছিল যে, বাইবেলে অনুগত খ্রিস্টানরা ইসরায়েলের সঙ্গে একটি বিশেষ সম্পর্কের দিগন্ত দেখতে পাচ্ছিল।

ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বছরের দ্বিতীয়ার্ধের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছিল ডিসেম্বরেই। তিনি বিকল্প খুঁজছিলেন। ২৭ নভেম্বর জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রিন্সিপাল কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হন। সেখানে দূতাবাস সরানোর বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। কর্মকর্তারা জানান, ট্রাম্প তাদের জানিয়েছেন তিনি আরও সৃজনশীল সমাধান চান।

ট্রাম্পের উপদেষ্টারা পরামর্শ দেন দুটি বিকল্পের। এর একটি হচ্ছে দূতাবাস না সরানোর সিদ্ধান্তে স্বাক্ষর। অন্যটি বিকল্পটি হচ্ছে স্বাক্ষর করলেও জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এতে করে দূতাবাস সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। কর্মকর্তাদের মতে, ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ কিছুদিন সংশয়ে ছিলেন। বিদেশি নেতাদের ও ক্যাপিটল হিলের নেতাদের সঙ্গে তিনি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।

শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ইহুদি ধর্মের অনুসারী তার পরামর্শক ও জামাতা জ্যারেড কুশনার এবং জ্যাসন গ্রীনব্লাট। উভয়েই ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষ দূতের ভূমিকা পালন করছেন। প্রকাশ্যে টিলারসনও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তবে ম্যাথিস সরাসরি কোনও অবস্থান নেননি। টিলারসনের ঘনিষ্ট উপদেষ্টা আর. সি. হ্যামন্ড সাংবাদিকদের জানান, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেননি। তবে তিনি আরও সময় নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

সহিংসতা ও বিক্ষোভের আশঙ্কা এবং সতর্কতার মধ্যেই হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বেশকিছু ইতিবাচক দিকও দেখছেন। তাদের মতে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী স্বীকৃতি দিয়ে ট্রাম্প নেতানিয়াহু সরকারকে ভালো অবস্থানে নিয়ে গেছেন। এতে করে ইসরায়েলের জোট সরকার আরও শক্তিশালী হবে। দেশটির রাজনীতি স্থিতিশীল হবে।

/এমপি/
সম্পর্কিত
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বশেষ খবর
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
একসঙ্গে ইফতার করলেন ছাত্রলীগ-ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
সর্বাধিক পঠিত
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ