X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
১০ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৩২আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০১৮, ২৩:৪২

 

 

চলমান রোহিঙ্গা সংকটের মধ্যে মিয়ানমারে ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো বাধাগ্রস্ত করতে চীনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ দিল্লি ও ঢাকাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। মিয়ানমার ভারতের ‍উচ্চাকাঙ্ক্ষী এশিয়ান হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অংশ হিসেবে সড়ক সংযোগের কাজ স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে। এক লাখ ৪১ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্য মহাসড়কটি জাপানের টোকিও থেকে এশিয়ার হয়ে ইউরোপে গিয়ে মিলিত হওয়ার কথা। এশিয়ান মহাসড়কটি দক্ষিণ এশিয়াকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবে আর মিয়ানমারেই মহাসড়ক দুটি মিলিত হওয়ার কথা।

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ

২০০১ সালে ঘোষিত দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহায়তা (সাসেক) উদ্যোগও এই আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর ওই পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে (বিবিআইএন) মোটর যান চুক্তির কাজ এখন চলছে। এডিবি’র সহায়তায় এশিয়ান হাইওয়ে ডেপেলপমেন্ট প্রকল্পে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া দুটি বড় অংশীদার। জাপান সম্প্রতি এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত একটি যৌথ সড়ক যোগাযোগ প্রকল্প নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনাও করেছে।

এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সমুদ্র পথের প্রশ্নে চীনের বিপরীতে জাপান ও ভারতের এই জোটের কারণে বেইজিং ভয় পেয়েছে। দেশ দুটি চীন প্রস্তাবিত ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড (ওবিওআর) উদ্যোগকে ভেস্তে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে চীন।

এশিয়ান হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভারত মনিপুরের রাজধানী ইমফাল থেকে মিয়ানমারের মোরেহ সীমান্ত পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে সড়কে প্রশস্থতা বৃদ্ধি ও মানোন্নয়নের কাজ করা হবে। সড়কটির সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৩০ কোটি রুপি। মোরেহ থেকে সড়কটি মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত যাওয়ার কথা রয়েছে। তবে সর্বশেষ ঘোষণায় মিয়ানমার প্রকল্পটি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে।

মিয়ানমারের কর্মকর্তারা বলেছেন, সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে তারা প্রকল্পটির সুবিধা ও সম্ভাবনা খতিয়ে দেখবে। এই ঘোষণা ভারত সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে। 

চীনের চাপের মুখে মিয়ানমার এই পদক্ষেপটি নিয়েছে তা সবারই জানা। মিয়ানমারে চীনের ক্ষমতার এমন ব্যবহার আঞ্চলিক যোগাযোগ প্রকল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি পশ্চিম সীমান্তে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক কোরিডর (সিপিইসি) নিয়ে বিপাকে পড়েছে চীন। এজন্যই দেশটি ওবিওআর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। সিপিইসি প্রকল্পে ভারত অংশ নেয়নি। আর পাকিস্তানে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বড় ধরনের নিরাপত্তা হুমকির কারণে প্রকল্পটি ঝিমিয়ে পড়েছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও চীন ও ভারত হঠাৎ উদ্যোগী হয়ে পড়েছে। এশিয়া অঞ্চলে চীনের ক্ষমতা ও সম্পদের সঙ্গে ভারত পেরে উঠছে না। এরপরও প্রকল্প বাস্তবায়নের গতির মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ভারত। বর্তমানে মিয়ানমারে বিভিন্ন প্রকল্পে ভারত ৭৩ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আর চীন তার চারগুণ বা আরও বেশি অর্থ বিনিয়োগ করেছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন মিয়ানমারকে পুরোপুরি সমর্থন করেছে। এ কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ‍নিষ্ঠুর দমন নীতি ও গণহত্যা চালিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ওই কারণে বাংলাদেশে ধেয়ে এসেছে লাখ লাখ শরণার্থীর স্রোত। সারাবিশ্ব এর নিন্দা জানালেও চীন মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। 

কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষক সব্যসাচী বাগচি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত ২০১৮ সালে মিয়ানমার তার নিষেধাজ্ঞাপূর্ব অবস্থার ফিরে যেতে শুরু করেছে। সে সময় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন দেশটি শাসন করেছে। সব আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সত্বেও তখনও চীন দেশটিকে সাহায্য করে গেছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে দেশে ফিরিয়ে নিতে বেশিরভাগ দেশই মিয়ানরমারকে আহ্বান জানাচ্ছে। এমনকি অনেক দেশ তাদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা পুনরুজ্জীবিত করার দাবি করেছে। তারপরও চীন একে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে কোনও মন্তব্য করেনি।

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ

রাখাইন রাজ্য ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে তুলনামূলক শান্ত অবস্থা বজায় থাকলেও ভারতের আশঙ্কা যেকোনও সময় তা আরও খারাপ হতে পারে। একজন বিশ্লেষকের মতে, বর্তমান অবস্থা ও দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ধীরগতিতে মনে হচ্ছে, কয়েক বছর পর সামান্য সংখ্যক রোহিঙ্গাকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ই চায় নিপীড়িত মানুষগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া হোক। মিয়ানমার শর্ত দিয়েছে যেসব রোহিঙ্গা বার্মায় তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ ‍দিতে পারবে তাদেরই ফেরত নেওয়া হবে। ৮০’র দশকে নাগরিকত্ব হারানো রোহিঙ্গাদের পক্ষে এই শর্ত পূরণ করা অসম্ভব। 

বাংলাদেশের ঘটনা দেখে অবস্থায় ভারতও বিচলিত হয়ে পড়েছে। কারণ ভারতে থাকা প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গার বেলায়ও একই ধরনের শর্ত দিতে পারে মিয়ানমার। ভারত জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে এই সিদ্ধান্তের ব্যাপক সমালোচনা করেছে। তারা রোহিঙ্গাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে হবে বলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার সফরকালে বিষয়টি নিয়ে কোনও কথাই বলেননি। ভারত চেষ্টা করছে সড়ক উন্নয়নসহ অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করার। তবে মিয়ানমারের কাছে এসবেরও কোনও দাম নেই।

সন্দেহ নেই ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো আর্থিক সম্পদ অথবা কাজের গতির প্রশ্নে চীনের সাহায্যে চলা উদ্যোগের সঙ্গে পেরে উঠবে না। তাই ছোট-খাট কিছু সমস্যা বাদ দিলে এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের উপর কর্তৃত্ব দেখায় চীন। চীনের ওবিওআর প্রকল্প ভালভাবে চালানোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যোগাযোগ প্রকল্প স্থগিত করাই তার প্রমাণ।

চীন-ভারত দ্বন্দ্বে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশ

চীনের ইতিবাচক উদ্যোগ ছাড়া রোহিঙ্গা সংকটের কোনও সমাধান হবে না। নইলে বাংলাদেশ ও ভারতকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে তার ঠিক নেই। তবে বাংলাদেশের কাছে মুখ বাঁচাতে দুই দেশের মধ্যে সৎ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখার প্রস্তাব দিয়েছে। তারা ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রস্তাব করেছে। আর বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ই চীনকে প্রধান মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নিলে তা হবে পুরো এশিয়ায় দেশটিকে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে মেনে নেওয়ার শামিল। এজন্যই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নববর্ষের বাণীতে বলেছেন, ‘চীন বিশ্বের উন্নয়নের বড় ভূমিকা পালন করবে।’

/আরএ/
সম্পর্কিত
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় দফার ভোট কাল
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৬
সর্বশেষ খবর
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা