X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মাত্রা দিলো তুর্কি অভিযান

আলী রমজান
২২ জানুয়ারি ২০১৮, ২০:০০আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:৫২

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দি নিয়ন্ত্রিত আফরিন ছিটমহলে তুরস্কের অভিযানে নতুন মাত্রা পেয়েছে দেশটিতে চলমান সাত বছরের গৃহযুদ্ধ। সেখানে ইতোমধ্যে ১৫৩টি লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালিয়েছে তুর্কি বাহিনী। বিপরীতে পাল্টা লড়াইয়ের ঘোষণা ‍দিয়েছে সশস্ত্র কুর্দি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ওয়াইপিজি। এই হামলা সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণকে আরও বেশি জটিল করে তুলেছে। এমনটাই উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর বিশ্লেষণে।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে নতুন মাত্রা দিলো তুর্কি অভিযান ১৯ জানুয়ারি ২০১৮ শুক্রবার সিরিয়া সীমান্তবর্তী আফরিন ছিটমহলে কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর হামলা শুরু করে তুরস্ক। দেশটি বলছে, তারা শহরটিকে সন্ত্রাসীদের করিডোর হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবে না। আর তা নিশ্চিত করতেই হামলা চালানো হয়েছে।

এর আগে সিরিয়ার তুরস্ক সীমান্তবর্তী এলাকায় কুর্দি বিদ্রোহীদের নিয়ে শক্তিশালী সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনার কথা জানায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী জোটের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, কুর্দি সমর্থিত এসডিএফের ৩০ হাজার সদস্য নিয়ে ওই বাহিনী গঠন করা হবে।

তুরস্কে নিষিদ্ধ ঘোষিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে)-এর নেতৃত্বে সিরিয়ায় বাহিনী গড়ে তোলার মার্কিন পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। রাজধানী আঙ্কারায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, কুর্দিদের দখলে থাকা সিরিয়ার আফরিন ও মানবিজ এলাকায় তুর্কি সামরিক বাহিনী যত দ্রুত সম্ভব সমাধানে পৌঁছাবে।

তুর্কি বাহিনীর এই অভিযানে সিরিয়ার জটিল রাজনৈতিক ও সামরিক সমীকরণ আরও বেশি জটিল হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র কুর্দি ওয়াইপিজি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে এই হামলা ট্রাম্প প্রশাসনকে ন্যাটোভুক্ত তুরস্কের  মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। গত অক্টোবরে আইএসের কাছ থেকে রাক্কা শহর দখলমুক্ত করতে ওয়াইপিজি যু্ক্তরাষ্ট্রের বিমান বাহিনীকে সহায়তা করেছে। বিপরীতে সিরিয়ায় কুর্দিদের উত্থানকে আইএসের মতোই ভয়ঙ্কর হিসেবে বিবেচনা করে আসছে তুরস্ক। দেশটির আশঙ্কা, বিদ্রোহীদের এমন উত্থানে তুরস্ক, সিরিয়া ও ইরাকের কিছু ভূখণ্ড নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।

সিরীয় কুর্দিদের বেশিরভাগই দেশটির উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির (পিকেকে) সশস্ত্র শাখা ওয়াইপিজি ২০১২ সালে ইউফ্রেটিস নদীর পূর্ব পাড়ের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই আঙ্কারা অস্বস্তিতে রয়েছে। কেননা পিকেকে ১৯৮৪ সাল থেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানও সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসী হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার হুমকি ‍দিয়েছেন।

আইএসের হামলা থেকে কুর্দি শহর কোবানিকে রক্ষার জন্য ২০১৪ সালে সিরিয়ায় প্রথম অভিযান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। আঞ্চলিক নেতারা আশঙ্কা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কুর্দিদের সঙ্গে মিত্রতা রাখলে আইএস নিধনের পর তা তুরস্কের জন্য ঝুঁকি হয়ে উঠবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের সামরিক সদস্যদের সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে ওয়াইপিজিকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।

তুর্কি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র বলছে, আফরিনে কখনো তাদের কোনও বাহিনী ছিল না। সেখানে যা হচ্ছে তার জন্য দায়ী রাশিয়া। কারণ সেখানে রাশিয়ান সামরিক পর্যবেক্ষকরা কাজ করছে। তবে আফরিনের পতন প্রমাণ করবে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের রক্ষা করতে চায় না বা তাদের রক্ষায় ওয়াশিংটন অক্ষম। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের পরিস্থিতি মূল্যায়নে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতাই বর্তমান সংকট তৈরি করেছে।

চলতি মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র বলেছিল, তারা কুর্দি বাহিনীর নেতৃত্বে ৩০ হাজার সদস্যের একটি সীমান্তরক্ষী বাহিনী গড়ে তুলতে সহায়তা করবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দাবি, তুরস্ক তার প্রস্তাবের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। তবে কুর্দিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন মাখামাখি ভালোভাবে নেয়নি আঙ্কারা।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন তুরস্ক-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের এই টানাপড়েন ঠাণ্ডা মাথায় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। তবে বাস্তবে সেটা হিতে বিপরীত হয়ে দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় দুই হাজার সামরিক উপদেষ্টা ও অন্যান্য সহযোগিতা দীর্ঘমেয়াদে বহাল রাখতে চায়। আইএস মোকাবিলায় এর প্রয়োজন রয়েছে। টিলারসনের এই বক্তব্য আফরিনে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক হস্তক্ষেপে তুরস্ককে উল্টো উৎসাহিত করেছে।

টিলারসনের ওই বক্তব্যের পর বিশ্লেষকরা বলছেন, সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক উপস্থিতি আদতে দেশটির ইরান সমর্থিত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের অবস্থানকে দুর্বল করবে। অস্বস্তিতে ফেলবে তুরস্কের এরদোয়ান সরকারকে। ফলে সংগত কারণেই সিরিয়ায় মার্কিন সামরিক বাহিনীর এই স্থায়ী উপস্থিতি তুরস্ক ও তার মিত্র রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরানকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। দেশগুলো মনে করে, কুর্দি নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় নতুন নীতি গ্রহণ করেছে।

আগে কুর্দিরা রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ভারসাম্য মেনে চলতো। তারা আসাদ শাসিত ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হতে চায়নি। প্রায় ২০ লাখ অধিবাসীর আফরিনকে সুরক্ষা দিয়ে আসছিল মস্কো। তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কারণে তুরস্ক এতোদিন সেখানে হামলা চালাতে পারেনি। তবে কুর্দিরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে জড়ানোর পর কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর থেকে ছাতা সরিয়ে নেয় রাশিয়া। আফরিনে তুর্কি অভিযানে বাধা না দেওয়ার ঘোষণা দেয় দেশটি। তুরস্ক হামলা চালানোর আগে সেখান থেকে নিজেদের পর্যবেক্ষকদেরও সরিয়ে নিয়েছে মস্কো।

সিরিয়ান কুর্দিদের জন্য আরও একটি সমস্যা হলো তাদের বিস্তৃতি। তারা এখন কুর্দি অধ্যুষিত এলাকার বাইরেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় দেইর ইজোর প্রদেশের তেলক্ষেত্রগুলোও এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। আসাদ সরকার এসব তেলক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চায়। তাই সিরিয়ায় তুর্কি বাহিনীর হামলা পছন্দ না করলেও আফরিনে তুরস্কের জয় মানে আদতে আসাদ বাহিনীরই জয়। যদিও পুরো সমীকরণটি খুব সহজ নয়। কেননা সিরিয়ার মাটিতে তুর্কি সমর্থিত বিদ্রোহীরাও তৎপর রয়েছে।

কুর্দি বাহিনীর হাতে খুব বেশি বিকল্প নেই। তারা চারদিক থেকে শত্রুতে ঘেরা। এছাড়া আইএস পরাজিত হওয়ার পর তাদের দমনেও আর কুর্দিদের প্রয়োজন নেই। এরমধ্যেই তারা ইরাকে কুর্দিদের অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছে। সেখানেও তারাআইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তবে গত অক্টোবরে স্বাধীনতার এক দুর্বল ঘোষণার মাধ্যমে ইরাকি কুর্দিরা দৃশ্যত নিজেদের সব অর্জনকে বিসর্জন দিয়েছে।

ইরাকি পেশমার্গা যোদ্ধাদের চেয়ে কুর্দি ওয়াইপিজি অনেক বেশি শক্তিশালী। তারা তুর্কি সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় মিত্রদের ব্যাপক ক্ষতি করতে সক্ষম। যদিও বর্তমান বাস্তবতায় আফরিনের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা তাদের জন্য খুবই কঠিন। কিন্তু আফরিনের পতনই সিরিয়ান কুর্দিদের জন্য চূড়ান্ত পরাজয় নয়। তবে এর মাধ্যমে সামনের দিনে তাদের অবস্থান বা নতুন কৌশল নির্ধারিত হতে পারে।

/আরএ/এমপি/
সম্পর্কিত
সিরীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েলের হামলা
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সর্বশেষ খবর
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
বিএনপির বিরুদ্ধে কোনও রাজনৈতিক মামলা নেই: প্রধানমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা, হিট অ্যালার্ট জারি
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
জিমি নেই, তারপরও খেলতে নামছে মোহামেডান
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!