যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফামের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যৌনকর্মীদের ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। ক্যারিবিয়ান দেশ হাইতিতে অসহায় নারীদের যৌন কাজে ব্যবহার করার অভিযোগের পর আফ্রিকার দেশ শাদেও একই অভিযোগ উঠেছে। ফলে সংস্থাটি বেশ চাপের মুখে রয়েছে। এদিকে দাতাগোষ্ঠীগুলোও বিষয়টি নিয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে সংস্থাটির উপর চাপ দিচ্ছে। আর সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ তদন্তের নির্দেশ ও অনুদান বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে অক্সফামের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা রোল্যান্ড ভ্যান হুওয়ারমেরিনের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ প্রকাশ করে। অক্সফামেরই একটি গোপন তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই খবরটি প্রকাশ করা হয়। রোল্যান্ড শুধু যে হাইতির ভূমিকম্প পীড়িত নারীদের যৌন কাজে ব্যবহার করেছেন তাই নয়, অভিযোগ রয়েছে তিনি অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের দিয়েও একই কাজ করিয়ে নিয়েছেন।
টাইমসের খবরে অক্সফামের বিরুদ্ধে কর্মীদের এমন অপরাধের পরও দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়। এমনকি ওই কর্মকর্তা অন্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়ার সময়ও তার সম্পর্কে এসব তথ্য গোপন করেছিল অক্সফাম। রোল্যান্ড ভ্যান হুওয়ারমেরিনকে ২০১১ সালে অক্সফাম থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। পরে তিনি বাংলাদেশে অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গারের মিশন প্রধান হিসেবে কাজে যোগ দেন। দ্য টাইমসের খবরে বলা হয়, অ্যাকশন অ্যাগেইনস্ট হাঙ্গারের পক্ষ থেকে অক্সফামের কাছে হুওয়ারমেরিনের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলেও কোনও সতর্কতা দেয়নি তারা। যদিও একই সময়ে তার বিরুদ্ধে অক্সফাম নিজস্ব তদন্ত চালাচ্ছিল। পরে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ছেড়ে যান হুওয়ারমেরিন।
সর্বশেষ অভিযোগ উঠেছে, শাদে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার সময় যৌন কর্মীদের সংস্থার অফিসে ভাড়া করে আনা হত। এ কারণে ২০০৬ সালে সেখানকার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার চাকরি চলে যায়।
হাইতিতে যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় জড়িত ছিলেন অক্সফাম কর্মকর্তা রোল্যান্ড ভ্যান হুওয়ারমেরিন। শাদে ঘটনার সময়ও তিনিই সেখানকার প্রধান ছিলেন। তিনি ২০১১ সালে অক্সফামের চাকরি ছাড়েন। তার আগে হাইতিতে নিজের বাসায় যৌন কর্মীদের নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেন। আর শাদে সংস্থাটির সাবেক এক কর্মচারী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্য দ্য অবজারভারকে বলেন, ‘তারা পার্টি করার জন্য নারীদের আমন্ত্রণ জানাতেন। আমরা জানি, এসব নারী শুধু বন্ধু ছিল না, বরং অন্যকিছু ছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি অক্সফামকে অনেক শ্রদ্ধা করতাম। তারা অনেক ভাল কাজ করেছে। কিন্তু এটা অনেক বিস্তৃত সমস্যা।’
এদিকে এমন কেলেঙ্কারি ফাঁসের ঘটনায় অক্সফামের কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এসব অভিযোগের কারণে সংস্থার তহবিল কমে গেলে তারা কাজ করতে পারবে না। ইতোমধ্যে সংস্থাটি তহবিল নিয়ে চাপের মধ্যে রয়েছে। তারা বলছেন, ‘অন্যকোনও উপায়ে সাহায্যের বিষয়টি দেখতে হবে। এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।’
অক্সফাম ২০০৬ সালে শাদে চাকরিচ্যুত কোনও কর্মচারীর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। শাদে সংস্থাটির কর্মচারীদের নিরাপত্তার কারণে কঠোর কারফিউয়ের মধ্যে থাকতে হয়। তারা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারে না। সন্ধ্যা নামলেই তাদের ঘরে ঢুকতে হয়। তবে কয়েকজন কর্মচারী ভ্যান হুয়ারমেরিনের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগ তোলেন।
শনিবার অক্সফামের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১১ সালে তদন্তের পর ঘটনাটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করা হয়েছে। তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা দল তারপর বেশ কয়েকটি সুপারিশ করে। এর মাধ্যমে কর্মীদের সুরক্ষার পাশাপাশি যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ ও আগে ঘটনার পুনারাবৃত্তি ঠেকাতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া যেকোনও অভিযোগের বিষয়েও করণীয় নির্ধারণ করা হয়।’
২০১১ সালের পর অক্সফামের কর্মীদের শৃঙ্খলাবিধিতে নতুন বিষয় যোগ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আমি অর্থ, চাকরি, পন্য বা অন্যকোনও সেবার বিনিময়ে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করা বা সুবিধা নেওয়া থেকে বিরত থাকব।’ আগে সেখানে শুধু কোনও সুবিধাভোগীর বা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক না করার বিষয়টি নিষিদ্ধ করা ছিল।
অক্সফামের প্রধান নির্বাহী মার্ক গোল্ডরিং ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেন, ‘ঘটনার পর আমি যৌন কেলেঙ্কারির বিষয়টি নিয়ে কথা বলা পছন্দ করতাম। কিন্তু আমার মনে হয় না ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করার মধ্যে কারও আগ্রহ থাকা উচিত। এর মাধ্যমে ঘটনাটিতে সবার মনযোগ কাড়ার চেষ্টা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ঘটনায় জড়িত কোনও কর্মচারী সম্পর্কে কোনও তথ্য প্রদানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষেধ করা হয়নি।
জনগণের কাছ থেকে প্রকাশ্যে অনুদান নিয়ে চলা সংস্থার জন্য এমন ঘটনা খুবই লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেন গোল্ডরিং।
অক্সফাম বিবৃতিতে জানিয়েছে, শুধু হাইতিতে ২০১১ সালে প্রায় ১০ হাজার এনজিও কাজ করেছে। তাই লাখ লাখ কর্মীদের মধ্যে যৌন কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পায়নি এমনটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অক্সফামের এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় পূর্ণ ও জরুরি তদন্ত করার জন্য দাতব্য সংস্থাগুলোকে নজরদারিকারী চ্যারিটিজ ওয়াচডগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে’র একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমরা চাই এসব মারাত্মক অভিযোগের ব্যাপারে চ্যারিটি কমিশনের পূর্ণ ও জরুরি তদন্তে অক্সফাম সব ধরনের তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করবে।’