X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সংকটের মতো সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছে আসাম?

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০১:০৮আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১১:৩৬

আসামে শেষ হয়েছে প্রথম দফার নাগরিক নিবন্ধন ভারতের আসামে চলমান নাগরিক নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ মানুষ ‘রাষ্ট্রহীন’ হিসেবে চিহ্নিত হলে দেশটির সবচেয়ে স্পর্শকাতর রাজ্যটিতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। আসামভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক খবরে বলা হয়েছে, এই নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কারণ সেখানে অ-আসামীয় জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারিতে আসামে নাগরিক নিবন্ধন কার্যক্রমের আওতায় প্রথম খসড়া নাগরিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে তিন কোটি ২০ লাখ আবেদনকারীর মধ্যে এক কোটি ৯০ লাখ বাসিন্দার নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। এই ঘটনায় তালিকা থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। তবে কেন্দ্র ও রাজ্য কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে নাগরিকদের আশ্বস্ত করেছে, এই তালিকা কেবল প্রথম খসড়া তালিকা। নাগরিক নিবন্ধন কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এর আওতায় আবেদনকারীদের দাখিল করা দলিলাদি যাচাই-বাছাই চলছে। যথাযথ তদন্ত ছাড়া কারও বাদ পড়ার কোনও আশঙ্কা নেই। প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে। এমনকি তারপরও যারা বাদ পড়বে, তারা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবেদন করে নিজেদের অবস্থা জানতে পারবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই বছরের জুন মাসের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
নাগরিক নিবন্ধনের প্রকাশিত প্রথম তালিকায় কিছু বিষয়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বাংলাভাষী তিনটি প্রশাসনিক এলাকার বেশিরভাগ আবেদনকারী তালিকাভুক্ত হননি। এরপর সেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কিছু জনগোষ্ঠীকে বাদ দেওয়ার অভিযোগ তোলার পাশাপাশি প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। তালিকায় বাদ পড়াদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রীসহ কয়েকজন পরিচিত মুসলিম নেতা বাদ পড়েছেন। কয়েকজন হিন্দু নেতাও তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। তবে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, বাদ পড়াদের মধ্যে বেশিরভাগই বাংলা ভাষাভাষী। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বাইরে থাকা উলফাসহ কয়েকটি বিদ্রোহী সংগঠনের সদস্যরা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।

বিভিন্ন খবরে বলা হয়, আবেদনের সঙ্গে দাখিল করা দলিলাদির ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করে পুনঃগণনা করছে। নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য জমির মালিকানার দলিল, বাসা/বাড়ি, স্কুল-কলেজের সনদপত্র, স্থানীয় পঞ্চায়েতের দেওয়া দলিলগুলোকে গ্রহণ করা হয়েছে। কিছু আসামি নাগরিক নিজেদের ভারতীয় বংশধারা প্রমাণের জন্য অন্যান্য রাজ্যে বসবাসরত আত্মীয়দের ঠিকানাও জমা দিয়েছেন। এই বিষয়গুলো যাচাই করার জন্য অনেক বেশি সময় লাগছে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।

খবরে আরও বলা হয়, এসব আবেদনের মধ্যে ১৬ লাখ আবেদন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এই আবেদনকারীদের বেশিরভাগই আসামে তাদের বংশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্ম। তাদের পূর্ব-পুরুষরা দীর্ঘদিন আগে আসামে এসে বসবাস শুরু করেছেন। তবে তাদের বেশিরভাগের বাবা-মায়ের দলিলপত্রাদি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই ধরনের খবরে, আসামের বরাক ভ্যালির হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

২০১৪ সালের লোকসভা ও ২০১৬ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আসামে বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘তাদের (অবৈধ নাগরিক) প্রত্যাবাসন করা হবে না। তাদের নিজেদের ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতে হবে।’ তবে কোথায় যেতে হবে, তা পরিষ্কার করেননি তিনি। হিন্দুত্ববাদী অনুভূতি ও কট্টরপন্থী আসামি নাগরিকদের প্রতিরোধকে বাংলাদেশি অভিবাসনের বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে ঠিকই প্রথমবারের মতো উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজ্যটির ক্ষমতায় যেতে পেরেছেন মোদি। রাজ্যটির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোওয়াল বিজেপিতে যোগ দেওয়ার আগে কট্টরপন্থী অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। সংগঠনটি আসামে বাংলাদেশি অভিবাসনের বিরুদ্ধে কট্টর মনোভাব প্রকাশ করে থাকে। 

দলিলপত্রাদি যাচাই শেষে ভারতের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না মিললে তাদের ভাগ্যে কী ঘটবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্নে রয়েছেন অনেক বাসিন্দা। এসব নাগরিকের বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চিন্তার বাইরে। বাংলাদেশিরা আসামসহ বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে বাস করছে ভারতের এমন দাবি বাংলাদেশ কখনও মেনে নেয়নি। কেউ আসলেই বাংলাদেশের বাসিন্দা কিনা, তা যাচাই করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিচয়পত্র বা দলিলাদি সরবরাহ করাও সম্ভব নয়। তাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব নাগরিককে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হবে। তাই দলিলপত্রাদি না থাকায় সংখ্যায় যতই হোক, ‘নন-সিটিজেন’ ঘোষিত বাসিন্দাদের ভারতীয় ভূখণ্ডেই রাখতে হবে।

আসামের মুখ্যমন্ত্রী সোনোওয়াল ঘোষণা দিয়েছেন, অবৈধ নাগরিক চিহ্নিত হওয়া ব্যক্তিরা সাধারণ নাগরিকের মতো জমি কিনতে পারবে না। তাদের কর্মসংস্থান বা শিক্ষার নিশ্চয়তা থাকবে না। তবে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের খাবার, বাসস্থান ও নিরাপত্তা দেওয়া হবে।

তার এই কথায় বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কথা মনে করিয়ে দেয়। বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের জন্য এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তারা বাংলাদেশ ও কিছু আন্তর্জাতিক সহায়তার মাধ্যমে আলাদা বিশেষায়িত ক্যাম্পে বাস করছে।

আসামের এই নাগরিক নিবন্ধন ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মানবিক দিক বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে তিনি আসামের নাগরিক নিবন্ধন কার্যক্রমের বিরোধিতা করে বলেছেন, এটা বাঙালিদের বিতাড়িত করার একটি পুরনো কৌশল। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘বাংলা এমন কোনও সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না।’  তবে ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্য মমতা আসাম থেকে বিতাড়িত রাষ্ট্রহীন এসব মানুষকে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় দিতে পারেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি। এ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস কোনও উদ্যোগ নেওয়ার আগেই দলটি আসামের মতো পশ্চিমবঙ্গেও অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিত করার জন্য নাগরিক নিবন্ধন হালনাগাদ করার দাবি জানিয়েছে।

আসামে নাগরিক নিবন্ধন হালনাগাদ কার্যক্রম রোহিঙ্গাদের মতো শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। কলকাতাভিত্তিক বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে ইতোমধ্যে বিষয়টি ব্যাপক লেখালেখি হচ্ছে। এখন দেখার বিষয, এই বছরের জুনের পর আসাম সরকার বিষয়টি কীভাবে মোকাবিলা করে।

সব মিলিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে, আসামে নাগরিক নিবন্ধনের আদেশ দিয়ে কেন্দ্র সরকার কি সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ করতে যাচ্ছে বা এর মাধ্যমে তৈরি হতে যাওয়া আঞ্চলিক জটিলতা মোকাবিলা ও সমাধান করার জন্য সরকার প্রস্তুত? আর আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য রাখাইন রাজ্যেই তাদের জন্য স্বশাসিত অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য দাবি জানানো হচ্ছে। আসাম কি তার রাষ্ট্রহীন নাগরিকদের জন্য এমন উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে?

 

 

 

/আরএ/এপিএইচ/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হলো সেনাসহ ২৮৫ বিজিপি সদস্যকে
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে বাইডেনের সই
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা