X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দুই ফিলিস্তিনি নারীর অহিংস ইন্তিফাদা

বিদেশ ডেস্ক
০৮ মার্চ ২০১৮, ২০:১৪আপডেট : ০৯ মার্চ ২০১৮, ১৪:১৪
image

২০১২ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বছরের পর বছর ধরে নারী নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনগুলো তুলনামূলকভাবে লক্ষ্য অর্জনে বেশি সফল হয়েছে। এর কারণ, অসহিংস কৌশল। সহিংস প্রচারণার চেয়ে অহিংস প্রচারণায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শত ভাগ। ১৯০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ৩২৩টি বড় ধরনের রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নতুন করে সেই প্রতিবেদনের তথ্যকে সামনে এনেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। দুই ফিলিস্তিনি নারী যোদ্ধার সফলতার গল্প হাজির করেছে। ওই দুই ফিলিস্তিনি নারী আল জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। জানিয়েছেন, প্রথম ও দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় তারা কিভাবে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সফল অহিংস বিক্ষোভ চালিয়েছিলেন, সেই কথা।






নাইলা আয়াশ
প্রথম ইন্তিফাদা ১৯৮৭-১৯৯৩

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দখলদারিত্বের দুই দশক পার হওয়ার পর শুরু হয়েছিল প্রথম ইন্তিফাদা। গাজায় একটি বেসামরিক যানের সঙ্গে একটি ইসরায়েলি ট্রাকের সংঘর্ষে চার ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর দীর্ঘদিনের ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠেছিল। পশ্চিম তীরজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লো। সেসময় ফিলিস্তিনি নারী নাইলা আয়াশের বয়স ছিল ২৫-২৬ এর কৌটায়। তিনি দেখলেন, রামাল্লায় ফিলিস্তিনি দাবি ও নির্দেশনাসংক্রান্ত লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। আয়াশ এবং তার স্বামী লিফলেটগুলো প্রিন্ট করালেন এবং তা বিতরণ করতে গাজায় গেলেন।
আল জাজিরাকে আয়াশ বলেন, ‘এ ইন্তিফাদার জন্য কিছু প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে, বিশেষ করে গাজায় দিনে দিনে এ প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিলো। সবগুলো রাজনৈতিক দল ইন্তিফাদার জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে রাজি হলো। সেসময় সবগুলো রাজনৈতিক দল খুব শক্তিশালী ছিল, বিশেষ করে দলগুলোর ভেতরে নারীদের মুভমেন্ট ছিল।’
আয়াশ জানান, প্রত্যেকটি বড় বড় ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক অংশ একটি নারী কমিটি গঠন করলো। গৃহবধূদের সংগঠন হিসেবে ছদ্মবেশে আবির্ভূত হলো কমিটিগুলো। যেহেতু যেকোনও রাজনৈতিক দল এবং শিক্ষার্থী সংগঠনের সদস্য হওয়াটা অবৈধ ছিল, সেকারণে এ নারী কমিটিগুলো প্রকাশ্যে বুনন, সেলাই ও রান্নাবান্নার কথা বলতো; কিন্তু গোপনে চলতো তাদের বৈঠক। ইন্তিফাদার পরিকল্পনা করতো তারা।
লেবানন থেকে উৎখাত হয়ে অনেক সদস্য তিউনিসে নির্বাসিত হওয়ার পর প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) এর নেতৃত্বের পতন ঘটলো। অসংখ্য ফিলিস্তিনি পুরুষ হয় নির্বাসিত হয়েছে, নিহত হয়েছে কিংবা তাদেরকে কারান্তরীন করা হয়েছে। আয়াশ জানান, নারীরা এ শূন্যতা পূরণ করেছিল এবং অভ্যুত্থানের মেরুদণ্ড হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সেবারই প্রথম বিদেশ থেকে পিএলও’র দেওয়া নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়াই লোকজন ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছিল। অনেগগুলো বেসামরিক ধর্মঘটের আয়োজন করেছিল নারীরা। স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করেছিলেন তারা, দেখা করেছিলেন নিহতদের পরিবারের সঙ্গে। ইসরায়েলি বাহিনী কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে বিকল্প জায়গায় শিক্ষাদানের সুযোগ তৈরি করেছিলেন নারীরা। সেইসঙ্গে সফলভাবে ইসরায়েলি পণ্য বর্জন কর্মসূচি পরিচালনা করেছিলেন তারা। কিভাবে বাড়ির আঙিনায় খাদ্য উৎপাদন করতে হবে সেই শিক্ষাও দেওয়া হয়েছিল নারীদের। অথচ এর আগ পর্যন্ত ইসরায়েলি পন্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল ফিলিস্তিনি অর্থনীতি।
আয়াশ জানান, অস্থিরতা চলার সময় নারী হওয়ার কারণে খানিক সুবিধাও পেয়েছিলেন। কারফিউর সময় পুরুষদের চেয়ে নারীরা বেশি মুক্তভাবে চলাচল করতে পারতো। আর সেই সুযোগে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গেছেন এবং রুটির ঝুড়িতে লুকিয়ে রাখা লিফলেট বিতরণ করতেন। ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ কখনও তাদেরকে সন্দেহ করতো না। তার কারণ হিসেবে আয়াশ বলেন, ‘ইসরায়েলি মাথা এ ধারণা গেঁথে আছে যে কেবল পুরুষরাই ইন্তিফাদায় অংশ নেয়। তারা ভাবতে পারেনি যে নারীরাও এক্ষেত্রে সক্রিয় আছে।’
১৯৯১ সালে মাদ্রিদ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য কয়েকজন নারীকে নিয়ে একটি ফিলিস্তিনি প্রতিনিধি দল তৈরি করা হয়েছিল। মাদ্রিদ সম্মেলনে তারা আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে ইসরায়েলি বসতি বিলোপের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এই ফাঁকে তাদের অজান্তে নরওয়েতে ইসরায়েলের সঙ্গে একটি গোপন চুক্তিতে স্বাক্ষর করে পিএলও। ওই চুক্তি অনুযায়ী, দখলদারিত্ব চলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। অসলো চুক্তি ১৯৯৩ স্বাক্ষরের কারণে মাদ্রিদে ওই নারী প্রতিনিধি দলের আলোচনার ইতি ঘটেছিল। এ চুক্তির মধ্য দিয়ে সৃষ্টি হলো প্যালেস্টাইন অথরিটি-পিএ (ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ), যা পরে তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিরোধকে করায়ত্ত করেছিল। আয়াশ জানান, এর ফলে দখলদারিত্ব কেবল অব্যাহতই থাকেনি, বরং আরও বেশি বেশি চেকপয়েন্ট স্থাপিত হয়েছে এবং অবৈধভাবে ইসরায়েলিদের বসতবাড়ি গড়ার হার ১৪০ শতাংশ বেড়েছে। তাছাড়া নারীদের স্বাধীনতাও খর্ব হয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পাসপোর্ট পেতে ফিলিস্তিনি নারীদের এখন অভিভাবক প্রয়োজন হয়। আয়াশ মনে করেন, এমন পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা অর্জন অনিবার্য।
বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনি নারী
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ২০০০-২০০৫

এবার আরেক ফিলিস্তিনি নারীর সফলতার গল্পে আসা যাক। ২০০৩ সালে বয়স ১৫ বছর ছিল ফিলিস্তিনি নারী ইলতিজাম মোরার এর। বুদরুস গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি। ইলতিজাম শুনতে পেলেন, ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে দখলকৃত পশ্চিম তীরে একটি একটি বিভাজনকারী দেয়াল নির্মাণ করা হচ্ছে। এর বেশি কিছু জানতে পারেননি তিনি। সংবাদমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত খবর প্রচার করা হলো না। এ দেয়াল নির্মাণের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের বিক্ষোভ চলার কথাও শুনতে পেলেন না। শিগগিরই দেয়াল নির্মাণের কাজ জেনিন থেকে চলতে চলতে বদরুস অবধি পৌঁছালো। এ দেয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে তাদের গ্রামের প্রায় ৫ হাজার একর জমি জব্দ করা হলো, ৩ হাজার জলপাই গাছ উপড়ে ফেলা হলো। গ্রামের অর্থনীতি সংকটে পড়ে গেলো। গ্রামবাসী দ্রুত বুঝতে পারলেন, এ দেয়ালটি নিরাপত্তার ইস্যু নয়, বরং তাদের সম্পত্তি হরণের উদ্দেশ্যেই এ দেয়াল স্থাপন করা হচ্ছে।
এ দেয়াল নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য পপুলার রেজিস্ট্যান্স কমিটি গঠন করেন ইলতিজামের বাবা আয়েদ মোরার। শুরু হয় প্রতিরোধ। পরিবারের কাছে প্রথম ইন্তিফাদার গল্প শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা ইলতিজাম বুদরুসের প্রতিরোধ আন্দোলনে যোগ দিতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। তখন পর্যন্ত শুধু পুরুষদের নিয়ে গঠিত দলটিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ‘শুধু পুরুষদের নিয়ে গঠিত’ দলটিতে নারীরা যোগ দিতে দ্বিধা বোধ করছিল। তারপরও ইলতিজাম তার পাঁচজন নারী সহপাঠীকে এ দলে যোগ দিতে রাজি করিয়ে ফেললেন। এরপর আস্তে আস্তে আরও অনেক নারী যোগ দিলো। প্রথম বিক্ষোভ শেষ হওয়ার পর অনেক পুরুষ দল ছেড়ে চলে গেলো। কিন্তু নারীরা তাদের বিক্ষোভ ও স্লোগান চালিয়ে যেতে লাগলেন। তখনই ক্ষান্ত দিতে রাজি হননি তারা। এরপর থেকে যখনই বিক্ষোভের ঘোষণা দেওয়া হতো তখন বলা হতো, ‘নারী-পুরুষ সবাই আমন্ত্রিত’। নারীদের নেতৃত্বে ওই বিক্ষোভ দশ মাস ধরে চললো। এ সময়ে তাদেরকে কিছু বৈরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলেও শেষ পর্যন্ত ওই দেয়াল নির্মাণের কাজ বন্ধ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা। ইসরায়েলিদের হাত থেকে গ্রামকে সুরক্ষিত করতে পেরেছিলেন তারা।
ইলতিজাম বলেন, ‘এ ধরনের আন্দোলনে যত বেশি সংখ্যক লোক অংশ নেবে তত বেশি সাফল্য পাওয়া যাবে। নারীরা অংশ নেওয়ার পর আন্দোলনকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল। আন্দোলন আরও বড় আকার ধারণ করেছিল। আমরা অনেক সংগঠিত ছিলাম। আমাদের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা ছিল এবং আমরা তা অর্জন করেছি। বুদরুসে সংঘাত তৈরি করাটা আমাদের লক্ষ্য ছিল না। সৈন্যরা আমাদের লক্ষ্য ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের ভূমির সুরক্ষা নিশ্চিত করা।’
ইলতিজামের বাবা আয়েদের কাছে এ বিষয়টি স্পষ্ট হলো যে আন্দোলনে নারীদের যুক্ত করা হলে ভিন্ন ফলাফল আসতে পারে।

 

/এফইউ/
সম্পর্কিত
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলের আঘাতে প্রাণ গেলো বাবার
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!