X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শি জিনপিং কি নিজেই নিজের কবর খুঁড়লেন?

বাধন অধিকারী
১১ মার্চ ২০১৮, ২০:৩৪আপডেট : ১১ মার্চ ২০১৮, ২১:৩৫

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং (ছবি: সংগৃহীত) সংবিধান সংশোধনীর মধ্য দিয়ে চীনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। চীনের পিপলস পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে প্রেসিডেন্টের জন্য নির্ধারিত ২ মেয়াদের অবসান ঘটানোর মধ্য দিয়ে তার আজীবন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সংশোধনীর কারণে তিনি একইসঙ্গে আজীবন পার্টি ও সামরিক বাহিনীর প্রধান থাকবেন। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলো শি-এর নেতৃত্বের প্রশংসা করলেও এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে দেখছে ভিন্ন দৃষ্টিতে। চীনের শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা, দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার পেছনে তার ভূমিকার কথা স্বীকার করলেও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, চীনে মাও সে তুং-এর পর প্রথমবারের মতো কেউ এমন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেন। বিশ্লেষকদের উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমগুলো বলছে, কেবল চীনা জনগণের জন্য নয়, শি-এর এই বিপুল ক্ষমতা তার নিজের রাজনৈতিক জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হবে। একজন চীনা ভিন্ন মতাবলম্বীকে উদ্ধৃত করে খবরে বলা হয়েছে, নিরঙ্কুশ এই ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে শি আসলে নিজের জন্যই কবর খুঁড়লেন।  

নব্বই-এর দশকে চীনে প্রেসিডেন্টের জন্য দুই মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল। সংবিধানে সংশোধনী এনে বলা হয়েছিল, একজন দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারবেন না। তবে রবিবার (১১ মার্চ) দেশটির নীতি-নির্ধারণের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী প্রতিষ্ঠান  পিপলস পার্টির বাৎসরিক সভায় এ বিধান প্রত্যাহার করে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন প্রতিনিধিরা। মোট দুই হাজার ৯৬৪জন প্রতিনিধির মধ্যে দুই হাজার ৯৫৯ প্রতিনিধিই  মেয়াদ অনির্দিষ্ট করে জীবনভর প্রেসিডেন্ট থাকার পক্ষে ভোট দেন। বাকি পাঁচ জনের দুই জন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। ভোটদানে বিরত ছিলেন তিনজন। পার্লামেন্টের অনুমোদনের পর বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। তবে সেখানে প্রত্যেকেই চীনা পিপলস পার্টির সদস্য হওয়ায় এটি অনুমোদিত না হওয়ার সুযোগ নেই। গত মাসে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ অনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব আনা হয়। সিএনবিসির প্রতিবেদন বলছে, চীনের পার্লামেন্টে সব এক দলীয় সদস্য হওয়ায় এই প্রস্তাব পাস সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র। এতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিপুল সমালোচনা হয়েছে বলে জানানো হয়। চীনা নেতৃত্ব বেশকিছু কনটেন্ট সেন্সর করেছে বলেও অভিযোগ করা হয়।

২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর তার বর্তমান মেয়াদ ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা। তবে সাংবিধানিকভাবে তিনি এবার আজীবন ক্ষমতার অধিকারী হলেন। বিবিসির চীন প্রতিবেদক স্টিফেন ম্যাকডোনেল মনে করছেন, এই সংশোধনীর কারণে শি জিনপিংকে চ্যালেঞ্জ জানানো এখন প্রায় দুঃসাধ্য একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। ম্যাকডোনেল বলছেন, ‘ক্ষমতার দিক থেকে তিনি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছালেন, যা মাও সে তুং-এর পর আর কেউ ভোগ করেননি।’

৫ বছর আগেও বেইজিং ছিল একটি সমন্বিত নেতৃত্বের অধীনে। পলিট ব্যুরোর নয় সদস্যকে নিয়ে মত-ভিন্নমতের সমন্বয়ে দেশ শাসন করেছেন হু জিনতাও। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন ধারা রয়েছে। এর সব ধারাকেই কমবেশি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল হু কে।  ম্যাকডোনেল বলছেন, ‘একটি শান্তিপূর্ণ রদবদলের সংস্কৃতি মেনে প্রতি ১০ বছর পর পর নিজস্ব অভিমতের পক্ষের মানুষকে নিয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য এটা জরুরি। সেই প্রক্রিয়ার আজ অবসান হলো। দুই মেয়াদের বেশি ক্ষমতায় না থাকার সাংবিধানিক ধারা বদলে শি জিনপিংকে এই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেওয়া হলো। এ নিয়ে কোনও জাতীয় বিতর্কের সুযোগ নেই।’

তবে ম্যাকডোনেল শি-এর নেতৃত্বের প্রশংসাও করেছেন। লিখেছেন, ‘শি তার দেশের শাসন ব্যবস্থাকে বদলে দিয়েছেন। খুবই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সেই বদলের সঙ্গে।’ অস্ট্রেলিয়ার এবিসি নিউজ-ও শি-এর আজীবন ক্ষমতাকে কেবল চিরায়ত স্বৈরতান্ত্রিক বাস্তবতা আকারে দেখছে না, গণমাধ্যমটি লিখেছে, শি-এর নেতৃত্বে অর্থনীতিকে আরও চাঙ্গা করে তুলতে সক্ষম হবে চীন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সমালোচনার প্রসঙ্গ তুলে এবিসি নিউজে বলা হয়েছে, চীনের বাস্তবতাকে উত্তর কোরিয়ার মতো করে দেখা হচ্ছে। কিংবা কেউ কেউ বলছেন, মাও সে তুং-এর ধারার ব্যক্তিত্বকে সামনে আনতে চাইছে চীন। ওল্ড ঘোস্ট ছদ্মনামের এক চীনা লেখককে উদ্ধৃত করে এবিসি বলছে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। তিনি এবিসিকে বলেছেন, চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন খবর লিখেছে, ‘শি জিন পিং-এর আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার পথ পরিষ্কার করলো চীন’ শিরোনামে খবর লিখেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৬৪ বছর বয়সী চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ইতোমধ্যেই মাও সে তুং-এর সমকক্ষতা অর্জন করেছেন। দল ও দেশের জনগণের যৌথ সম্মতির কথা বলে গত সপ্তাহে সংবিধান সংশোধনীর ডাক দেন তিনি।

রয়টার্সের বিশ্লেষণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ক্ষমতার নিরঙ্কুশ বাস্তবতা নিয়ে। চীনের প্রেসিডেন্ট কেবল প্রেসিডেন্টই নন, তিনি একইসঙ্গে দলীয় প্রধান ছাড়াও সামরিক বাহিনীরও প্রধান। সংশোধিত সংবিধান শি জিনপিংকে আজীবন প্রেসিডেন্ট বানিয়ে একইসঙ্গে সামরিক বাহিনী ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টিতেও পরিবর্তনকে অসম্ভব করে তুললো। সিএনএন-এর প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে, কেবল জনস্বার্থের প্রশ্ন নয়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা খোদ শি জিন পিং-এর নিজের রাজনীতিকেও ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে। চীনে যে অল্প ক’জন ভিন্ন মতাবলম্বী রয়েছেন, তাদের একজন লি দাতং। তরুণদের রাষ্ট্রীয় একটি সংবাদমাধ্যমের সাবেক এই সম্পাদক সিএনএনকে বলছেন, নিজের জন্য বড় একটি কবর খুঁড়ে রাখলেন চীনা প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, শীর্ষ নেতাদের জন্য নির্ধারিত মেয়াদ চীনা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি সাধারণ সত্য। এর অবসান দেশে রাজনৈতিক সংঘাত জোরালো করাবে।  তবে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের শীর্ষ এক নেতার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি তা নাকচ করে দেন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকেই শি দেশটির ইতিহাসে ধারাবাহিকভাবে আত্মপ্রত্যয়ী ও নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ববাদী একটি যুগের সূচনা করেন। একইসঙ্গে তার হাত ধরে চীন এক নতুন জাগরণ দেখতে পেয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। পরাক্রমশালী দেশ হিসেবে বিশ্বের কাছে চীনের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তিনিই এখন সামনে থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে সফলতার পাশাপাশি ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরপাকড়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

গত বছর অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের চিন্তাকে দলীয় গঠনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন করে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। আধুনিক চীনের রূপকার হিসেবে স্বীকৃত মাও সে তুংয়ের পর শি জিনপিং হলেন দ্বিতীয় ব্যক্তি, ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় যার চিন্তা দলীয় গঠনতন্ত্রে মতাদর্শের মর্যাদা পায়। মতাদর্শের মর্যাদা পাওয়ায় মাওয়ের মতবাদ যেমন মাওবাদ হিসেবে বিবেচিত হয়, শি’র চিন্তাধারাও বিবেচিত হচ্ছে শি-বাদ হিসেবে। এর বিরুদ্ধে যেকোনও চ্যালেঞ্জ এখন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধের অবস্থান বলে বিবেচিত হয়। 
আরও পড়ুন: আজীবন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং




/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
তাইওয়ানে সহায়তা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি যুক্তরাষ্ট্রের
বাংলাদেশের আম-কাঁঠাল-আলু নিতে চায় চীন
ট্রাম্প বা বাইডেন যে-ই জিতুন মার্কিন সমর্থন অপরিবর্তিত থাকবে, আশা তাইওয়ানের
সর্বশেষ খবর
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
সিরিয়ায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৩৮
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়