X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিশৃঙ্খলায় বাধাগ্রস্ত ভারতের সংসদীয় কার্যক্রম, সদস্যদের বেতন বৃদ্ধিতে সাধারণের ক্ষোভ

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
২৪ মার্চ ২০১৮, ০১:৩৯আপডেট : ২৪ মার্চ ২০১৮, ১০:৩৪

ভারতের সংসদের চলতি অধিবেশনের ১২ দিনে মাত্র দুটি বিল পাস করতে পেরেছে সরকার। এর মধ্যে একটি অতিপ্রয়োজনীয় ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট আর অন্যটি সংসদ সদস্যদের বেতন দ্বিগুন করার বিল। বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের চাপের মুখে থাকার কারণে এবারের অধিবেশনে তেমন কোনও সুবিধা করতে পারছে না সরকার। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত রয়েছে বিরোধীরা। এমনকি  ১২ দিন দুই কক্ষের একটিতেও অধিবেশন কার্যক্রম ঠিক মতো চলেনি। গড়ে  প্রতি ৬ মিনিটে কোনও না কোনও গোলমাল দেখা দিয়েছে। তবে এর মধ্যে সংসদ সদস্যদের বেতন দ্বিগুন করার বিল নিয়ে কেউ আপত্তি দেখায়নি। অভূতপূর্ব ঐক্যের মাধ্যমে বিলটি পাস হলেও এনিয়ে সমালোচনা শুরু করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো।  ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ জনগণও। 

বিশৃঙ্খলায় বাধাগ্রস্ত ভারতের সংসদীয় কার্যক্রম, সদস্যদের বেতন বৃদ্ধিতে সাধারণের ক্ষোভ

নির্বাচনের বছরখানেক আগে প্রস্তাবিত বাজেটকে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করছে ভারতের সব মহল। ২০১৯ সালের আগে অথবা ওই বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে মাথায় রেখে বাজেট পাসের সময় বিরোধী দল বিশেষ করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস মোদি সরকারের কঠোর বিরোধিতা করেছে। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বিরোধীদের বিলটি বিবেচনা ও সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে কংগ্রেস পুরো উল্টো আচরণ করছে। ২০১৪ সালের আগে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের সময়ও তখনকার বিরোধী দল বিজেপি একইভাবে সংসদে উত্তেজনা ছড়িয়েছিল। তাই কংগ্রেসের এখনকার আচরণেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।  

সম্প্রতি ‘গুজরাটি মাফিয়া’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নীরব মোদি, মেহুল চোখসেসহ কয়েকজনের ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় বিপদে পড়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। অভিযুক্তদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা থাকায় আরও অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি। এ কারণে অনেকটা সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় রয়েছেন তিনি।

এমন চাপের কারণে ইরাকে নিহত ৩৯ শ্রমিকের মৃত্যুর খবর ঘোষণা করতেও সময় নিয়েছে বিজেপি সরকার। চার বছর আগে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের হাতে অপহৃত এসব শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়ে আগেই নিশ্চিত হয়েছিল বিজেপি সরকার।

এই বাস্তবতার সঙ্গে যোগ হয়েছে উত্তর প্রদেশ ও বিহারের নির্বাচনে তিনটি আসনে পরাজয়ের কারণে দলের ওপর বাড়া চাপ। এছাড়া বেকারত্ব কমাতে ব্যর্থতা, শিল্প উৎপাদনের না বাড়াতে পারাসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিরোধীদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে বেশ টালমাটাল পরিস্থিতিতে আছে বিজেপি।

সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজেপি এমন টালমাটাল অবস্থার মধ্যে বিরোধিতার নতুন ক্ষেত্র পাচ্ছে কংগ্রেস। একই সঙ্গে পুর্নজাগরিত হচ্ছে আঞ্চলিক দলগুলোর তৃতীয় ফ্রন্টের ভাবনা। অন্ধ্রপ্রদেশের টিডিপি, তামিলনাড়ুর আম আদমি, পশ্চিমবঙ্গের টিএমসির পাশাপাশি কংগ্রেসও কেন সংসদের দুই কক্ষে অস্থিরতা ছড়াচ্ছে? এর কারণ তারা বিজেপিকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চায়।

ব্যাখ্যা হিসেবে বলা যায়, সব দলই নিজেদের কথা বলছে। আঞ্চলিক সমন্বয় সাধন করতে না পারায় সব দলই সরব। আম আদমির জন্য কর্নাটকের সঙ্গে কাবেরি নদীর পানি ভাগাভাগি গুরুত্বপূর্ণ, অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য বিশেষ মর্যাদা পাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। জাতীয় কংগ্রেসের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ব্যাংক জালিয়াতির তদন্ত। সব দলই প্রত্যেকটি ইস্যুর তাৎক্ষণিক সমাধান চায় সবাই। তাই সবার দাবির মুখে বেশ বেকায়দায় রয়েছে বিজেপি সরকার।

এদিকে বিরোধীদের তোপের মুখে বেকায়দায় থাকলেও একটি বিল খুব সহজেই পাস করিয়েছে সরকার। আর তা হলো সংসদের উভয় কক্ষের সদস্যদের বেতন দ্বিগুন করার বিল। একই সঙ্গে পাঁচ বছর পরপর সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা পুনর্মূল্যায়ন করার বিষয়েও আইনে বলা হয়েছে। এর মাধ্যমে এ খাতে সরকারকে আরও বাড়তি ১২১ কোটি রুপি খরচ করতে হবে। যে সময় ও যেভাবে আইনটি পাস হয়েছে তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়, সংসদের উভয় কক্ষের ক্ষেত্রেই  পরিচালনা ব্যয় হিসেবে প্রতি মিনিটে ২ লাখ ৬০ হাজার রুপি খরচ হয়। প্রতিদিন অন্তত ছয় ঘণ্টা অধিবেশন চলে। টিভি বিশেষজ্ঞরা হিসেব করে দেখিয়েছেন, গত দুই সপ্তাহে সংসদ পরিচালনায় খরচ হয়েছে ১৩১ কোটি রুপি। আর এ সময়ে মাত্র দুটি বিল পাস করানো গেছে। এর মধ্যে একটি হলো ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট। তবে সেটি পাসের সময়ও বিরোধী সাংসদদের শ্লোগান মুখরিত বিক্ষোভ করেন। কিন্তু লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন বিলটি পাসের জন্য কন্ঠভোট নেন। চিৎকার চেচাঁমেচির মধ্যেই কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়েছে বলে ঘোষণা দেন স্পিকার।

তবে দ্বিতীয় বিলটি পাস করতে সরকারকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিলটিতে সাংসদদের বেতন ভাতা একশ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব ছিল। বিলটি পাশের ক্ষেত্রে ভারতীয় আইনপ্রণেতাদের মধ্যে অভূতপূর্ব মিল দেখা গেছে। জনগণের করের টাকায় নিজেদের পকেট ভরতে ঐক্য গড়েছেন তারা। ওই প্রস্তাবের বিরোধিতায় কেউ কিছুই বলেননি।

সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, বর্তমান অধিবেশন চলাকালে ১২ দিন দুই কক্ষের কোনও একটি কক্ষেও অধিবেশন ঠিক মতো কাজ চালাতে পারেনি। এমনকি অধিবেশন এক নাগাড়ে ৬ মিনিট চালানোও সম্ভব হয়নি। দুই কক্ষেই প্রতি ৬ মিনিটের মধ্যে কোনও না কোনও গোলমাল ও গোলযোগে সংসদের কার্যক্রম ব্যহত হয়েছে। এদিকে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাংসদদের বেতন ভাতা পুর্নমূল্যায়নের জন্যও ওই আইনের বলা হয়েছে।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে ভারতের সাধারণ মানুষ সাংসদদের নতুন বরাদ্দ নিয়ে আলোচনা করছে। বেশিরভাগ মানুষই নিজেদের কষ্টার্জিত টাকা সাংসদদের পেছনে ব্যয়ের সমালোচনা করছেন।

মানুষের এই ক্ষোভের কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। ১৫ বছর আগে অর্জুন সেনগুপ্তের কমিটির হিসাবে দেখা গিয়েছিল, বেশিরভাগ ভারতীয় দরিদ্র নাগরিক দৈনিক ২০ রুপির কম আয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। ২০১৫ সালে লোকসভার একজন সংসদ সদস্য বেতন ও ভাতা বাবদ দুই লাখ ৭০ হাজার রুপিরও বেশি পেতেন। ২০১৮ সালে এই হিসাব দাঁড়ায়, প্রতিমাসে পাঁচ লাখেরও বেশি। এর মধ্যে মৌলিক ভাতা, ফার্নিচার, স্টাফ, চিকিৎসা খরচ ও ভ্রমণ ব্যয় রয়েছে।

পুনের এক  নাগরিক বলেন, ‘কেন এই ডাকাতি… প্রতিদিন কয়েক মিনিটের চিল্লাচিল্লি আর স্লোগান আওড়ানোর জন্য পাঁচ লাখ রুপি? এই জন্যেই কি আমরা ভোট দেই?

অ্যাসোসিয়েশন অব ডেমোক্রাটিক রিফর্মের এক গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ ভারতীয় সাংসদ ধনী। শুধু তাই নয় অনেকেই রীতিমত বেশি ধনী। ২০১৪ সালে ভারতের ৮২ শতাংশ সাংসদের এক কোটি বা তার বেশি পরিমাণের সম্পদ ছিল। সবচেয়ে ধনী এক টিডিপি নেতার ৬৮৩ কোটি রুপিরও বেশি সম্পদ ছিল। কোটিপতি এসব ধনী সাংসদদের সংখ্যা বছরে বছরে বেড়েছে। ২০০৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ, ২০০৯ সালে ছিল ৫৮ শতাংশ। আর এসব সংসদ সদস্যরা এখনও কর মওকুফ সুবিধা পায়।  

এমনকি এসব নেতারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে অপরাধের প্রবণতা থেকেও বের হয়ে আসতে পারেননি। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ভারতের রাজনীতিতে সক্রিয় ৪ হাজার ৮৯৬ জন এমপি ও এমএলএ’র মধ্যে এক হাজার ৫৮১ জনের বিরুদ্ধেই অপরাধ মামলা চলছে। তাদের মধ্যে অনেকেই নারীদের বিরুদ্ধে হওয়া অপরাধের সঙ্গে জড়িত। কলকাতাভিত্তিক বিশ্লেষক চারুবার্তা রায় বলেছেন, ‘বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার জন্য প্রার্থীদের অপরাধসহ অন্যান্য রেকর্ডের চেয়ে আর্থিক অবস্থাটিকে বেশি মূল্যায়ন করে।’

এই অবস্থায় সংসদ সদস্যদের বেতন বৃদ্ধিতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

 

/জেজে/এএমএ/আরএ/
সম্পর্কিত
ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি কেমন?
ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট কাল
‘দিদির শপথ’ নামে তৃণমূল কংগ্রেসের ইশতেহার প্রকাশ
সর্বশেষ খবর
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জোরদার করলো ইইউ
মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়দের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ আ.লীগের, আছে শাস্তির বার্তাও
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
সিংড়া উপজেলার চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ, ইসিতে এসে জবাব দেওয়ার নির্দেশ
ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি কেমন?
ভোটারদের কাছে পৌঁছাতে ভারতীয় নির্বাচনি কর্মকর্তাদের প্রস্তুতি কেমন?
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট