X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

কাঠুয়ায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা: তোলপাড় কেন এত পরে?

বিদেশ ডেস্ক
১৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৬:১০আপডেট : ১৬ এপ্রিল ২০১৮, ০৯:১৬

কাশ্মিরের কাঠুয়ায় ৮ বছরের এক শিশুকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে একই ধরনের ঘটনার মতোই ভারতে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে, ক্ষমতাসীন দলের দুই শীর্ষ নেতা পদত্যাগ করেছেন, সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করেছেন এবং বিরোধীদল নরেন্দ্র মোদিকে কোণঠাসা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে।

ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভ হয় কাশ্মিরে

ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের শিকার এই শিশুটি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের কাঠুয়া অঞ্চলের যাযাবর মুসলিম বাকারওয়াল গোষ্ঠীর মেয়ে আসিফা বানু।  ১৭ জানুয়ারি একটি জঙ্গল থেকে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়। ফেব্রুয়ারিজুড়ে পুলিশ আট ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছেন একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, চার পুলিশ সদস্য ও এক তরুণ। তাদের আসিফাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তকারীদের মতে, অভিযুক্তরা গ্রেফতারের পর স্বীকার করে জানিয়েছে, যাযাবর সম্প্রদায়কে আতঙ্কিত ও বিতাড়িত করার জন্যই তারা এই মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে।

শুক্রবার (১৩ এপ্রিল) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘটনাটি নিয়ে শেষ পর্যন্ত মুখ খোলেন। বিরোধীরা তার নীরব থাকা নিয়ে সমালোচনা শুরু করার পরই মোদির এই অবস্থান প্রকাশ। তাও বক্তব্য ছিল একেবারে সংক্ষিপ্ত। কয়েকটি টুইটে তিনি বলেছেন, ধর্ষণের ঘটনায় দেশ লজ্জিত এবং আমাদের মেয়েরা অবশ্যই ন্যায়বিচার পাবে। ঘটনাটির বিস্তারিত প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভও বাড়তে থাকে। ভারতের অনেক বড় বড় চলচ্চিত্র তারকা তাদের ক্ষোভ জানাতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

বলিউড তারকারাও নেমেছেন বিক্ষোভে

জানুয়ারিতে যখন ঘটনাটি ঘটে তখন মেয়েটির মৃত্যু সংবাদ কাশ্মিরের স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ছাড়া কোথাও স্থান পায়নি। শ্রীনগরে বিক্ষোভ করে বিশেষ তদন্তের দাবি জানানো হয়। এই নৃশংস অপরাধটি জম্মু ও কাশ্মির উপত্যকায় হিন্দু-মুসলিম বিভাজনকে সামনে নিয়ে আসে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উপত্যকায় ঘটনাটি দ্রুততা ও পারদর্শিতার সঙ্গে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে আড়াল করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

ভারতের সিপিআই(এম)-্এর পলিটব্যুরো সদস্য ও রাজ্যসভার সাবেক এমপি ব্রিন্দা কারাত ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে এক কলামে লিখেছেন, ‘ওই শিশুর ওপর সংঘটিত বীভৎস নৃশংসতার যে ভয়াবহ বিবরণ চার্জশিটে উঠে এসেছে, তা জেনে কোনও সত্যিকারের মানুষের পক্ষে কি চুপ করে থাকা সম্ভব? দোষীরা যে চূড়ান্ত নগ্ন নিপীড়ন চালিয়েছে, তাতে এমন কে আছে যে রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়বে না? তারা তাকে (আসিফাকে) গুম করেছে, চৈতন্যহীন বানিয়ে ধর্ষণ করেছে, মিরাট থেকে একজন সহযোগীকে ডেকে এনেছে বিকৃত যৌন বাসনা চরিতার্থ করতে... তারা তাকে খুন করা থেকে সাময়িকভাবে বিরত থেকেছে কেবল এই কারণে, তাদের একজন তাকে পুনর্বার ধর্ষণ করতে চেয়েছিল।’

এই ঘটনার বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে ভারতজুড়ে

অথচ এই ঘটনাটিই ভারতের জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে স্থান পায় অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অনেক পরে, এপ্রিলের মাঝামাঝিতে। কেন ঘটনাটি বিলম্বিত ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দিলো? কেন অভিযুক্তদের (যারাও হিন্দু) গ্রেফতারের ঘটনায় হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রতিবাদের পরই এটা ঘটলো? কেন দিল্লিতে মধ্যরাতের মিছিলের মতো কর্মসূচি প্রধান বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে আয়োজিত হলো? কেনইবা ২০১২ সালে ২৩ বছরের নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত বিক্ষোভের তুলনায় অনেক বেশি শান্ত?

ঘটনাটি ভারত নিয়ন্ত্রিত ও মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরে সংঘটিত হওয়ার ফলে এতো দেরিতে সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় আসার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, এই কারণ অনুসন্ধানে যেসব জবাব পাওয়া গেছে তাতে আধুনিক ভারত সম্পর্কে নতুন কিছু বিষয় হাজির হয়েছে। অনেকেই মনে করেন, দিল্লির সংবাদমাধ্যম জাতীয় আখ্যান (ন্যাশনাল ন্যারেটিভ) গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অযাচিত প্রভাবের মুখোমুখি হয়। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সামরিকায়নকৃত অঞ্চল কাশ্মিরের খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে এসব সংবাদমাধ্যমের বড় অংশই পক্ষপাতমূলক ও বাছাই করে প্রকাশ করে।

কাঠুয়ায় শিশু ধর্ষণ ও হত্যা: তোলপাড় কেন এত পরে?

কাশ্মির নিয়ে ভারত ও পাকিস্তান দুটি যুদ্ধ করেছে। ১৯৮৯ থেকে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম জারি রয়েছে। ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও দ্য প্রিন্ট’র সম্পাদক শেখর গুপ্ত ২০১৫ সালে লিখেছিলেন, ‘সমস্যাটি সবসময় জাতীয় নিরাপত্তা ও সামরিক নিরাপত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই, প্রায়ই কাশ্মির সম্পর্কে সত্যকে জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী বলে মনে করা হয়।’

জাতীয় সংবাদমাধ্যম কাঠুয়ার ধর্ষণ-হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ না করে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকে ‘ধর্মকে শ্রদ্ধা’ করার বিষয় তুলে ধরছেন। অভিযুক্তদের প্রতি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ও ক্ষমতাসীন বিজেপির দুই মন্ত্রীর সমর্থন অনেককে অবাক করেছে।

জানুয়ারি থেকেই কাঠুয়ায় ঘটনাটির খবর সংগ্রহে নিয়োজিত এক সাংবাদিক জানান, দিল্লিভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোকে তিনি ঘটনাটি এবং এর ফলোআপ খবর প্রচারের কথা বলে আসছিলেন। শ্রীনগরভিত্তিক ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক সামির ইয়াসির বলেন, ‘দিল্লিতে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে যখন কয়েকজন রিপোর্টার এ বিষয়ে বলতে যান তখন তাদের অনুভূতি হয়েছিল, এক মেয়েকে ধর্ষণ ও হত্যার চাইতে উপত্যকায় একটি টিউলিপ বাগান উদ্বোধন খবরের গুরুত্বই বেশি।’

ইয়াসির মনে করেন, দিল্লির রিপোর্টারদের বেশিরভাগ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাই সত্য আড়াল করা চেষ্টা করেছেন। তারা বলেছেন, ‘জম্মুতে তাদের লোকবল যথেষ্ট নেই’ এবং ‘এটা কোনও বড় ঘটনা না’। মাত্র একটি ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ঘটনাটির খবর নিয়মিত প্রচার করেছে।

বিক্ষোভে নেমেছেন ভারতের বিরোধী নেতা রাহুল গান্ধী

দিল্লিভিত্তিক সমাজ বিজ্ঞানী ড. শিব বিশ্বনাথ বলেন, ‘আমার মনে হয় সংবাদমাধ্যম ভারতের সহিংসতার খবর প্রচার করে ক্লান্ত। ধর্ষণ, পিটিয়ে হত্যা, নির্যাতনের খবর সবসময় প্রচারিত হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে, আবহাওয়ার খবরের মতো নির্যাতনের খবরও প্রকাশ করতে হয়।’ এই পরিস্থিতিতে ভারতের ‘নৈতিক অবক্ষয়’ হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় ভারতের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী প্রতাপ ভানু মেহতাও এই বিষয়ে কাছাকাছি মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘কাশ্মিরের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে অতিরঞ্জিত করা ছাড়াই প্রমাণ হয় যে ভারতের নৈতিক মাপকাঠি লোপ পেয়েছে। আইন, নৈতিকতা ও উৎকর্ষের জন্য যারা জাতীয় গর্ব নিয়ে প্রতিদিন ধর্মোপদেশ দেন ও রক্ষায় নিয়োজিত তারাই এটাকে ধূলিসাৎ করেছে।’

বিবিসি লিখেছে, গভীরভাবে বিভাজিত একটি সমাজে সামষ্টিক পদক্ষেপ নেওয়া সবসময় কঠিন। যখন নির্যাতনের শিকার শিশুর ছবি ছড়িয়ে পড়ে তখন জন্ম নেয় ক্ষোভ। কাঠুয়ার ঘটনার ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে।

অনেকেই বলছেন, ২০১২ সালে দিল্লিতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের একই ধরনের ঘটনার ক্ষেত্রে যে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছিল সেটার কারণ ছিল নির্যাতনের শিকার নারীকে ‘নিজেদের একজন’ বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু কাঠুয়ার মেয়েটি ছিল সত্যিকারের ভবঘুরে এবং দরিদ্র যাযাবর সম্প্রদায়ের সদস্য।

জাতিসংঘও নিন্দা জানায় কাঠুয়ার ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে

ড. বিশ্বনাথ বলেন, ‘জনগণ, সংবাদমাধ্যম, রাজনীতিক- আমরা সবাই দায়ী। মানুষের অধিকারের কোনও কিছুই আর এখন অবশিষ্ট নেই। এখন আছে হিন্দুদের অধিকার ও মুসলিমদের অধিকার। আমাদের আনুগত্য এখন ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও ক্লাবের কাছে।’

এই অবস্থায় তাৎক্ষণিক ক্ষোভ ও পাল্টা অভিযোগ হচ্ছে দুটি চরম আবেগ, যা এ ধরনের সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। বিক্ষোভ হচ্ছে মোমের মতোই এবং দ্রুতই শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বনাথ বলেন, ‘আমাদের প্রতিক্রিয়া নীরবতা থেকে উদাসীনতা এবং উদাসীনতা থেকে হিস্টিরিয়াতে পরিবর্তিত হয়। এরপর আমরা ফিরে যাই এবং আবার জেগে উঠি সর্বশেষ ক্ষোভের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেখানোর জন্য।’ সূত্র: দ্য হিন্দু, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস।

/এএ/চেক-এমওএফ/
সম্পর্কিত
জলপাইগুড়িতে বিজেপির ইস্যু বাংলাদেশের তেঁতুলিয়া করিডর
ইডি হেফাজতে আরও ৪ দিন কেজরিওয়াল
সরকার ক্ষমতায় থাকতে ভোটের ওপর নির্ভর করে না: সাকি
সর্বশেষ খবর
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বাধিক পঠিত
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি