X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানি পরমাণু চুক্তি রক্ষায় ইউরোপীয় প্রচেষ্টার নেপথ্যে

আশফাক মাহমুদ
১২ মে ২০১৮, ২৩:২৪আপডেট : ১৮ মে ২০১৮, ২১:৪২

ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে নিরস্ত করতে ২০১৫ সালে হওয়া চুক্তি রক্ষায় ইউরোপ মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রকে চুক্তিতে রাখতে না পারলে যেমন সমস্যা, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুর মেলালেও সমস্যা। যদি যুক্তরাষ্ট্রে মতো যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি চুক্তি পরিত্যাগ করে তাহলে ভবিষ্যতে তাদের আর কেউ কোনও সমঝোতায় বিশ্বাসযোগ্য পক্ষ হিসেবে গ্রহণ করবে না। তাছাড়া হোয়াইট হাউস যদি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে ইরানে যাওয়া ইউরোপীয় বিনিয়োগ সঙ্কটে পড়বে। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় দেশগুলোর মূল্যায়ন, ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে হওয়া ওই পরমাণু চুক্তি থেকে বের হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আরেকটি যুদ্ধের সূচনা হবে। এসব কারণে প্রথমত, ইরানের পরমাণু চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফেরানোর চেষ্টা করছে তারা। দ্বিতীয়ত ওয়াশিংটনকে ছাড়াও চুক্তিটি কার্যকর রাখার কথা ভাবতে হচ্ছে তাদের। কিন্তু যদি তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়াই চুক্তি কার্যকর রাখে, তাহলে মার্কিন শাস্তির মুখে পড়ার আশঙ্কায় থাকবে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গিয়ে  রাশিয়া ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। ওই চুক্তিতে রাশিয়া ও চীনও স্বাক্ষর করেছে। তারা চুক্তিটি কার্যকর রাখতে চায়। ইরানি পরমাণু চুক্তি রক্ষায় ইউরোপীয় প্রচেষ্টার নেপথ্যে

মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, চুক্তি রক্ষার পক্ষে কাজ করা ইউরোপীয়দের মূল ভাবনা হচ্ছে, ‘কোনও চুক্তি না থাকার চেয়ে একটি চুক্তি থাকা ভালো, এমনকি যদি তা ত্রুটিপূর্ণও হয়।’ ইরানের সঙ্গে হওয়া পরমাণু চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত। তেহরান চুক্তির কোনও শর্ত ভঙ্গ করেনি উল্লেখ করে জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘জেসিপিওএ শর্ত ভঙ্গের কোনও আলামত আমরা দেখিনি।’ একই সুর ধ্বনিত হয়েছে ফরাসি কর্মকর্তাদের কণ্ঠেও। জার্মানির সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য নর্থ রাইন ওয়েস্টফিলিয়ার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চুক্তির পর পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহে ইরানি উদ্যোগের সংখ্যা ১৪১ থেকে ৩২-এ নেমে এসেছে।

তেহরানের শর্ত মেনে চলার বিষটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দিকও রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর ইউরোপের প্রতিষ্ঠানগুলো ইরানে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। চুক্তি বাতিল হয়ে গেলে সেই বিনিয়োগ ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপের অর্থনীতি। ২০১৫ সালে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়া পর ইউরোপে ইরানের রফতানির পরিমাণ বেড়েছে ৩৭৫ শতাংশ। একই সঙ্গে ইউরোপীয় কর্পোরেশনগুলোও বিশাল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে দেশটিতে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাড়ার এই ঘটনা সম্ভব হয়েছে পশ্চিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ইরানের ব্যাংক ব্যবস্থার যোগাযোগ সাধিত হওয়ায়। ইউরোপের ক্রেডিট এজেন্সিগুলোও ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘এক্সপোর্ট গ্যারান্টি’ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এমন অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠার পর বেঁকে বসলেন ট্রাম্প।

এখন যদি সত্যিই আবার যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তাহলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য করা ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারবে হোয়াইট হাউস। যুক্তরাষ্ট্রের শাস্তির খড়গ যাতে ইউরোপীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর না পড়ে সেজন্য অঞ্চলটির নেতারা চুক্তিটিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনতে চায়। শেষ পর্যন্ত যদি তা না পারা যায়, তাহলে ইরানের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ দায়মুক্তি দিয়ে আইন পাস করবে ইইউ। কিন্তু তা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সমাধান নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বৃহৎ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠয় কর্মকর্তা দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, ‘অপরাপর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও আমাদের আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে হয়। যদি আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে ইরানের ভেতরে বা বাইরে কোথাও আমরা কাজ করতে পারব না। আমাদের তখন থেমে যেতে হবে। অনেকে নিষেধাজ্ঞা থেকে সুরক্ষা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রচেষ্টার কথা বলেছে। কিন্তু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এমন ইইউভিত্তিক আইনের ভরসায় ইরানে ব্যবসা করতে যাবে না।’

চুক্তি বাতিল হলে আরও অস্থিতিশীল হবে মধ্যপ্রাচ্য। এমনকি ইরানের ভেতরেও চরমপন্থীদের উত্থান ঘটতে পারে। আল জাজিরা রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছে পরমাণু চুক্তি রক্ষায় ইউরোপের মরিয়া প্রচেষ্টার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। সংবাদমাধ্যম এক্সিওসের প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সভায় নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা হয় জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের। সে সময় ম্যার্কেল নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ইরানের পরমাণু চুক্তি বাতিল হলে তা মধ্যপ্রাচ্যে নতুন আরেকটি যুদ্ধের সূচনা করবে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার পরপরই ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। তেল আবিবের দাবি, ইরানের রকেট হামলার জবাবে তারা ওই বিমান হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু তেহরান বলছে, রকেট হামলার অভিযোগ ‘বানোয়াট’ ও ‘ভিত্তিহীন।’ ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার কথা জানানোর পর থেকেই গোলান মালভূমিতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।

একজন জার্মান কর্মকর্তার বরাতে এক্সিওস লিখেছে, চ্যান্সেলর ম্যার্কেল একই বৈঠকে নেতানিয়াহুকে আরও বলেছেন, ইউরোপীয় শক্তিগুলো নিজেদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করতে চায় না। চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ালে পশ্চিমা বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়বে। যার ফলে ভবিষ্যতে সমস্যাজনক দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সুযোগ আর থাকবে না। কারণ তখন কেউ আর পশ্চিমা দুনিয়ার কথা বিশ্বাস করবে না।

এর সঙ্গে রয়েছে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা। পরমাণু চুক্তি রক্ষার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে যদি ইরানের শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করা না যায়, তাহলে দেশটির ভেতরেই চরমপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, সে আশঙ্কা ইতোমধ্যেই সত্য হতে শুরু করেছে। ইরানের জ্যেষ্ঠ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আহমাদ খাতামি শুক্রবার মন্তব্য করেছেন, ইউরোপীয় দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মতোই অবিশ্বস্ত। তাদের কারও ওপরই আস্থা রাখা যায় না। চুক্তি রক্ষার বিষয়ে অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ায় তিনি রুহানির সমালোচনা করেন। আল জাজিরার জেইন বাসরাভি মন্তব্য করেছেন, খাতামির ওই বক্তব্যই প্রমাণ করে ইরানে চরমপন্থীরা শক্তি অর্জন করেছে।

ইরান সরকারের বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতির কথা উল্লেখ করে আল জাজিরা জানিয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বের ওপর আস্থা হারানোর বিষয়টিও বাস্তব হতে শুরু করেছে। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যখন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে ছিল তখনও ইউরোপ সম্পূর্ণভাবে তাদের ভূমিকা পালন করেনি। আহ্বান জানানো বাদ দিয়ে তাদের উচিত অর্থপূর্ণ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা।’

/এমপি/
সম্পর্কিত
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা