X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

শিয়া নেতা মুক্তাদা সদরের ইরাক জয়ের নেপথ্যে

বিদেশ ডেস্ক
১৮ মে ২০১৮, ১৯:১৬আপডেট : ১৯ মে ২০১৮, ১১:৫৩

ইরানপন্থী রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি তাকিয়েছেন নিজ দেশের মাটিতে। প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন শিয়া-সুন্নি রাজনৈতিক ঐক্য। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জোট করেছেন, প্রেরণা নিয়েছেন তাদের তৃণমূলের সাংগঠনিক দক্ষতা থেকে। মার্কিনবিরোধী সশস্ত্রপন্থা ছেড়ে  আগ্রাসনের ক্ষত আর দারিদ্র্য ও দুর্নীতি জর্জরিত ইরাকের বঞ্চিত জনতার পক্ষে লড়াইকেই করেছেন বৈদেশিক আগ্রাসন বিরোধিতার নতুন অস্ত্র। সঙ্গে ছিল তার ব্যক্তিগত সততা আর নির্বাচনে সুন্নীদের সীমিত অংশগ্রহণ। এইসব মিলে ইরাক জয় করে নিয়েছেন শিয়া নেতা মুক্তাদা আল সদর। তার জোট ইরাক জিতলেও নির্দিষ্ট কোন আসনে প্রার্থী না হওয়ায় সদরের সরকার প্রধান হওয়া অবশ্য অনিশ্চিত। ইরান সমর্থিতদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছেন বলে ইরানও সদরের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সদরের জয়ে ইরান ততোটা হতাশ নয়, যতোটা হতাশ যুক্তরাষ্ট্র।


মুক্তাদা আল সদর

নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিক মেনে নিয়েছেন সাইরুন জোট প্রায় ১৩ লাখ ভোট পেয়ে ৩২৯টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৫৪টিতে জয় পেয়েছে। সরাসরি সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় আল সদরের জোটকে সরকার গঠন করতে  অন্য ব্লকগুলোর সমর্থন পেতে হবে। তবে তার এই জয় বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।  

নতুন ধারার জাতীয়তাবাদী হিসেবে নিজের পরিচিতি দাঁড় করিয়েছেন মুক্তাদা আল সদর। শিয়া মুসলিমদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক প্রয়াত আয়াতুল্লাহ মোহাম্মদ সাদিক আল সদরের ছেলে তিনি। বিশ শতকের প্রথম দিকে ইরাকে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন মুক্তাদা। আস্তে আস্তে তার রাজনীতি ইরাকের দরিদ্র মানুষের প্রতি নিবিষ্ট হয়।

২০০৩ সাল থেকে তার অনুসারীরা ইরাকের অনেক দরিদ্র এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা, খাবার, ও পরিস্কার পানি সরবরাহ করে আসছে। বিশেষ করে বাগদাদের অন্যতম জেলা সদর সিটি এলাকায় এই কার্যক্রম চালিয়েছে তারা। আল সদরের বাবার নামে নামকরণ হওয়া শহরটিতে তার এক সময়ের সশস্ত্র সহযোদ্ধারা প্রায় অবাধে কার্যক্রম চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আর ইরাকি বাহিনীর বাধা সত্ত্বেও স্থানীয় কাউন্সিলেও প্রভাব রেখেছে তারা। একারণে তরুণ, দরিদ্র আর অধিকারবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।

সবচেয়ে দুর্নীতি গ্রস্থ দেশগুলোর কাছে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইরাক। সাথে রয়েছে উচ্চ বেকারত্ব, দারিদ্র এবং দুর্বল পাবলিক প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সাইরুন জোট তাদের নির্বাচনি প্রচারণায় দুর্নীতি-বিরোধী প্রচারণাকে সামনে আনে। ওই নির্বাচনি প্রচারণায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন কমিয়ে এনে হতাশাগ্রস্থ ইরাকিদের রাজনৈতিক দুর্নীতি ও নিকৃষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেন তিনি।

ব্রিটেনের এক্সাটার বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাটেজি ও সিকিউরিটি ইন্সটিটিউটের ইরাক বিশেষজ্ঞ তালহা আবদুলরাজাক মনে করেন, সরকারের দুর্নীতির মাত্রা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সরব থেকেছেন সদর। আর তা শিয়া জনগোষ্ঠী ও শ্রমজীবী মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।

গত ১২ মে’র নির্বাচনে ইরাকে শীর্ষ রাজনীতিবিদরা বাগদাদের গ্রীন জোনে নিজেদের ভোট দিলেও আল সদর দরিদ্র অধ্যুষিত জেলা নাজাফের একটি স্কুলে তার ভোট দেন। আবদুলরাজাক বলেন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আল সদরের জোটও তার পক্ষে কাজে এসেছে। তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিস্ট পার্টি অনেক সুসংগঠিত আর তা এই জোটকে সংহত করেছে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ফানার আল হাদাদ তার সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, সদর সবসময় শিয়া কর্মজীবীদের পছন্দ ছিলো আর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার ঐক্যবদ্ধ সুর ইতিবাচক ফলাফল এনেছে।

বাগদাদের ভোটারদের অভিযোগ নির্বাচনে বেশিরভাগ প্রার্থী একই অভিজাত শ্রেণীর। তারা আল জাজিরাকে বলেছেন, তারা নুতন মুখ আর পরিবর্তন চান। অন্য ব্লকগুলোর বিপরীতে সাইরুন জোট নতুন প্রার্থী দিয়েছে। এমনকি এই জোটের হয়ে প্রার্থী হয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে ২০০৮ সালে জুতা ছুঁড়ে মারা সাংবাদিক মুন্তাদার আল জায়দি।

এছাড়া বিগত ২০১৪ সালের নির্বাচনের থেকেও ১৫ শতাংশ কম ভোট পড়াটা নির্বাচনে মুক্তাদার পক্ষে গেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ফানার আল হাদাদ বলেন,  তৃণমূলে সদরের তীব্র জনপ্রিয়তা রয়েছে। তাদের সমর্থন অন্য দলের নেতাদের মতো নড়বড়ে নয়। কম ভোটার উপস্থিতি সত্ত্বেও সদরের সমর্থকরা তাকে ঠিকই ভোট দিয়েছেন বলেও মনে করেন হাদাদ।

দেশটির একটিভিস্টরা অনলাইনে নির্বাচন বয়কট আন্দোলনের ডাক দিলে তাতে সাড়া দিয়ে বেশিরভাগ সুন্নি মুসলিম ভোট দান থেকে বিরত থেকেছে। এছাড়া কয়েক বছরের মার্কিন আগ্রাসনের কারণে দেশটির সুন্নিপস্থি লাখ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে স্থানচ্যুত হয়েছে। তারা এই নির্বাচনে ভোট দিতেই পারেনি। এই অনুপস্থিতি সদরের পক্ষে গেছে বলে মনে করেন আবদুলরাজাক।

মুক্তদা সদর সুন্নি ও শিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছেন। সোমবার নিজের টুইটারে এক পোস্টে কয়েকটি দলের সঙ্গে কাজের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন মুক্তাদা আল সদর। এর মধ্যে কয়েকটি দলের নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে রয়েছে শিয়া সমর্থিত আল হিকমাত ব্লক, সুন্নিপন্থিদের দল আল-ওয়াতানিয়া ও নতুন প্রতিষ্ঠিত কুর্দিশ পার্টি। আগ্রাসনবিরোধী মনোভাব থেকে মার্কিন বিরোধিতার পাশাপাশি দূরে রাখতে চেয়েছেন ইরান সমর্থিতদেরও। ইরানও চাইছে না সদরের জোট সরকার গঠন করুক।

ইরাক সরকারে নিজেদের মিত্রদের থাকতে দেবে না বলে প্রকাশ্যে বলেছে ইরান। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, এর মাধ্যমে দেশটি আল সদরকে ক্ষমতাকে বিচ্ছিন্ন ও কমানোর চেষ্টা করছে। আবদুলরাজাক বলেন, আল সদরের জোটে কমিউনিস্টদের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। ইরান এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে মিত্রদের জোট থেকে বের করে আনার চেষ্টা করবে যাতে সদরের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে যায়। অন্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আল সদরের বিজয় বাগদাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব নিয়ে যতখানি দুশ্চিন্তা তৈরি করবে, ইরানের ব্যাপারে ততখানি হবে না।

ইরাকের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আল আবাদি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মিত্র হলেও আল সদর দুই দেশেরই প্রতিপক্ষ। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আগ্রাসনে সাদ্দাম হোসেনের উৎখাতের পর থেকে দেশ দুটি ইরাকের প্রভাব বিস্তার শুরু করে। পরে তারা সেখানে শিয়াপন্থী সরকারও গঠন করে।  

ইরানি রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মাহান আবেদিনের মতে, সবদিক বিবেচনা করলে এই ফলাফলে তেহরান অখুশি নয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ও আবাদিকে দুর্বল করতে চায় আর এই নির্বাচনে তাই হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এছাড়া এই ফলাফলে বর্তমানে নিজেকে গুটিয়ে রাখা ইরাকের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরী আল মালিকির পুনর্বাসন হবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে।

২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় নুরী আল মালিকি ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন। তার অধীনের বছর কয়েক বছর ধরে ইরাকি সেনাবাহিনী দেশটির সংখ্যালঘু সুন্নীদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বাহিনী হিসেবে কাজ করেছে।

মাহান আবেদিন বলেন, ইরানের আরেকটি লক্ষ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে পরাস্ত করা বা দুর্বল করে দেওয়া। আল সদর কিংবা নির্বাচনের দ্বিতীয় স্থানে থাকা হাদি আল আমেরির নেতৃত্বাধীন ইরানপন্থী ফাতেহ জোট এক্ষেত্রে কার্যকর হবে। তিনি বলেন, এসব নির্বাচনে ইরাকে শিয়া রাষ্ট্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে জোরদার করেছে। তাই প্রভাব বা কার্যকারিতার দিক থেকে ইরান এখানে সবসময় বড় প্রভাবক হিসেবে থাকবে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পরিস্থিতিটি একটু বেশি জটিল। কারণ আল সদর যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী। তিনি ইরাকের অনেকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন যাতে ২০০৩ সালের আগ্রাসনের জন্য মার্কিন সেনারা আক্রান্ত হয়েছেন। আল সদর মাহদি আর্মি নামে একটি বাহিনীও পরিচালনা করেছিলেন। এই বাহিনীর হুমকির কারণে মার্কিন বাহিনীকে আল সদরকে হত্যা বা আটক করার জন্য নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস মঙ্গলবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরাকি জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে। তবে দেশটি আশা করেছিল, আল আবাদি আরও এক মেয়াদে দায়িত্বে থাকবেন।

আল হাদাদের মতে, কোন ধরনের সরকার গঠন করা হবে তার ওপর বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণ করবে। তিনি বলেন, আল সদরের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভাল খবর নয়। তারা আল আবাদির প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য চাপ দেবে। আবাদি বা তার জোটমিত্র সাইরুন পরবর্তী সরকার প্রধান হলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুবিধা হবে।

/জেজে/আরএ/বিএ/
সম্পর্কিত
ইরানের ওপর কোনও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়নি: ইরানি কর্মকর্তা  
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
সর্বশেষ খবর
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ