মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের এক অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রে জানিয়েছে, ৬০-৭০ শতাংশ ক্রিকেট ম্যাচেই ফিক্সিং হয়। মুম্বাইভিত্তিক জুয়াড়িরা রানের সংখ্যাও নির্ধারণ করে দেয়। ‘ডি কোম্পানি’ নামে পরিচিত মাফিয়া চক্রটির সদস্য আনিল মুনাওয়ার আল জাজিরাকে দাবি করে বলেছিল, সে যা যা বলবে ক্রিকেট ম্যাচে তা-ই হবে। ওই ম্যাচ ফিক্সারের বলা দুটি বিষয়ই পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট ক্রিকেট ম্যাচ দুটিতে ঘটতে দেখা গেছে। মুনাওয়ার আরও দাবি করেছে, বিশ্বের সবগুলো জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের তারা ম্যাচ পাতানোর জন্য ঘুষ দিয়েছে। ভারতের গোয়েন্দা সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, মুনাওয়ার ‘ডি কোম্পানি’ নামে পরিচিত মাফিয়া চক্রের সদস্য। চক্রটি ভারতের বিশাল জুয়ার কারবার নিয়ন্ত্রণ করে, যার বার্ষিক মূল্যমান ৬ হাজার কোটি ডলার। আল জাজিরার কাছ থেকে এসব তথ্য পাওয়ার পর ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল’ (আইসিসি) বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করার কথা জানিয়েছে।
আল জাজিরা অনুসন্ধানের জন্য মুম্বাই মাফিয়ার জুয়াড়ি মুনাওয়ারের সঙ্গে হওয়া কথোপকথন গোপন ক্যামেরায় ধারণ করেছিল। সেখানে আল জাজিরার অনুসন্ধানী দলের উদ্দেশে আনিল মুনাওয়ারকে বলতে শোনা গেছে, তার দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বাজি ধরলে অনেক টাকা আয় করতে পারত আল জাজিরার সদস্যরা। একজন মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে মুম্বাইভিত্তিক ক্রিকেট জুয়াড়ি আনিল মুনাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। আনিল মুনাওয়ার আল জাজিরার কাছে দাবি করেছিল, দুটি টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচে তাদের পাতানো বিষয়গুলো ঘটানোর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ঘুষ নিয়েছে। ম্যাচের নির্দিষ্ট সময়ে কি হবে সে বিষয়ে আনিল মুনাওয়ারের বক্তব্যের সঙ্গে পরবর্তীতে হওয়া ক্রিকেট ম্যাচের হুবহু মিল পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচ দুটির একটি হচ্ছে চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত ২০১৬ সালের ভারত বনাম ইংল্যান্ডের খেলা এবং অন্যটি রাঁচিতে অনুষ্ঠিত ২০১৭ সালের ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়ার।
মুনাওয়ার বলেছিল, ‘৬০-৭০ শতাংশ ম্যাচই আমরা পাতাতে পারি।’ ৬ থেকে ৭ বছর ম্যাচ পাতানোতে জড়িত থাকার দাবি করা মুনাওয়ারের ভাষ্য, তাদের চক্রটি খেলার মূল ফলাফল নির্ধারণের পাশাপাশি আনুষঙ্গিক বিষয়েও জুয়ার ব্যবস্থা করে সেগুলো ঘটার বিষয়টি নিশ্চিত করে দেয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে যারা বাজি ধরেছে ম্যাচের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দলের মোট রানের সংখ্যা তাদের প্রত্যাশার নিচে রাখা। মুনাওয়ার জানিয়েছে, ম্যাচের ছোট ছোট বিষয়গুলো পাতানোর ব্যবস্থা করতে পারলে বেশি আয় করা যায়। যত বেশি বাজি ধরার মতো বিষয় থাকে, তত বেশি আয় করার সুযোগ বাড়ে। তার ভাষ্য, ‘সেশন বেশি ভালো, যেহেতু সেখানে বাজি ধরার অনেক সুযোগ পাওয়া যায়।’ ঘুষের বিষয়ে সে জানিয়েছে, ‘আমরা কোনও খেলোয়াড়ের জন্য কোনও ঘুষের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেই না। আমরা একজন খেলোয়াড়ের হাতে একটি থোকা টাকা তুলে দেই। তারপর সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে কাকে কত দেবে।’
মুনাওয়ার দাবি করেছে, তারা সবগুলো দেশের জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দিয়ে ম্যাচ পাতিয়েছে; বিশেষ করে টেস্ট ম্যাচ। ওয়ানডে এবং হালে জনপ্রিয় হওয়া টি টোয়েন্টি ম্যাচও পাতানো হয়েছে। তাদের ২০-২৫ জন বড় ‘ক্লায়েন্ট’ আছে যারা তার বলে দেওয়া বিষয়ের ওপর বাজি ধরে প্রতি ম্যাচে এমন কি ১৫ লাখ ডলার পর্যন্ত আয় করেছে।
চেন্নাই এবং রাঁচি দুই ম্যাচের সময়ই টস হওয়ার পর আনিল মুনাওয়ার আল জাজিরার সদস্যদের জানিয়েছিল সেশনের বিষয়ে জুয়াড়িদেড় ম্যাচ পাতানোর কথা। সেশন শুরুর ঠিক আগে ‘সেশন ফিক্সের’ বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য দিয়েছিল সে। দুই ম্যাচেই তার কথা মতো ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ওই দুই ম্যাচে অংশ নেওয়া অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের কয়েকজন ক্রিকেটারের নামও জানিয়েছিল মুনাওয়ার, যারা ম্যাচ পাতানোর জন্য ঘুষ নিয়েছে বলে তার দাবি। আল জাজিরা লিখেছে, আইনি বিষয়ের কারণে তারা ওই ক্রিকেটারদের নাম এখন প্রকাশ করছে না, তবে কর্তৃপক্ষের হাতে সব তথ্য দিয়ে দেওয়া হবে। এদিকে ইংল্যান্ডের ওই ক্রিকেট খেলোয়াড়রা অভিযোগ অস্বীকার করে তাদের আইনজীবীদের মাধ্যমে জানিয়েছেন, ‘অভিযোগগুলোই একজন স্বীকৃত অপরাধী উত্থাপন করেছে। যে মাত্রায় রানের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি করা হয়েছে অভিযোগে, তা যদি অসম্ভব নাও হয়ে থাকে তবুও বলতে হয়, বাস্তবে তা করে দেখাতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম।’ সংশ্লিষ্ট অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
তদন্তকারীদের বিষয়ে জানতে চাইলে সে বিষয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার কথা জানিয়েছে মুনাওয়ার। তার ভাষ্য, ‘কখনও কখনও ছোট ছোট সমস্যা দেখা দেয় কিন্তু আমরা সেগুলো সামলে নিতে পারি। আসলে টাকা থাকলে আপনি যেকোনও কিছু করতে পারবেন। কোম্পানির বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ আছে, ওসব বিষয় তারা সামালে নেয়।’ ১৮ মাস ধরে চালানো অনুসন্ধান শেষে আল জাজিরার মূল্যায়ন, ‘ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং যেকোনও সময়ের চেয়ে বেশি বেড়েছে এবং একই সঙ্গে ফিক্সিং প্রমাণ করাটা আরও বেশি দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।’