X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মনোবলের ওপরই নির্ভর করছে আটকে পড়া কিশোরদের ভবিষ্যৎ?

ফাহমিদা উর্ণি
০৮ জুলাই ২০১৮, ১৮:০২আপডেট : ০৮ জুলাই ২০১৮, ১৮:০৯
image

জোনাথন সিমস একজন সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা। থাইল্যান্ডের গুহায় কিশোর ফুটবলাররা যেমন করে আটকে আছে, তেমন করেই তিনি আটকে পড়েছিলেন মেক্সিকোর বন্যাকবলিত এক গুহায়। ২০০৪ সালে ৫ সহযোদ্ধার সঙ্গে ওই গুহায় ১০ দিন আটকে থাকার পর ব্রিটিশ ডুবুরি রিক স্টান্টন তাদের উদ্ধার করেন। এই রিক স্টান্টনই গত ২ জুলাই থাই গুহায় আটকে পড়া শিশুদের অবস্থান প্রথমবারের মতো শনাক্ত করতে সক্ষম হন। স্যাঁতস্যাঁতে, অন্ধকার গুহা আর ক্রমাগত বাড়তে থাকা পানির মধ্যে কয়েকদিন ধরে আটকে থাকা কতোটা ভয়াবহ, তা জানেন জোনাথন সিমস। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে নিজের সেই অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে সিমস বলেছেন, টিকে থাকার জন্য সবথেকে জরুরি হলো মনোবল। আতঙ্কিত হলেই বিপদ। একসঙ্গে আটকে থাকা ওই কিশোররা তাদের মনোবল ধরে রাখতে পারবে বলে বিশ্বাস সিমস-এর।গার্ডিয়ানের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে  একজন মনোবিজ্ঞানীও তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। আর স্কাই নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ কিশোরদের মনোবলের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেছেন, ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযান সফল হলে তা হবে এক ঐতিহাসিক ঘটনা।এদিকে  ভক্স নিউজ তাদের এক বিশ্লেষণে উদ্ধার অভিযানে সম্ভাব্য ৪টি ঝুঁকি শনাক্ত করেছে। 
মনোবলের ওপরই নির্ভর করছে আটকে পড়া কিশোরদের ভবিষ্যৎ?

গত ২৩ জুন ফুটবল অনুশীলন শেষে ২৫ বছর বয়সী কোচসহ ওই ১২ কিশোর ফুটবলার গুহাটির ভেতরে ঘুরতে গিয়েছিল। কিন্তু বৃষ্টিতে গুহার প্রবেশমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে তারা আর বাইরে বের হতে পারেনি। এরপর থেকে টানা ৯ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত ২ জুলাই গুহার ভেতরে জীবিত অবস্থায় তাদেরকে শনাক্ত করে ডুবুরিরা। রবিবার (৮ জুলাই) থাইল্যান্ড সরকার তাদের উদ্ধারে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে। এই ঘটনা সাবেক ব্রিটিশ কর্মকর্তা জোনাথন সিমসকে নিয়ে গেছে ১৪ বছর আগের স্মৃতিতে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বর্ণনা করেছেন তার গুহায় আটকে পড়ার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা। উদ্ধার হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার মনে আছে, রিক যখন কাছে পৌঁছালেন তখন তার মুখ দেখে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। এটা মহা স্বস্তিদায়ক ছিল।’

থাই গুহায় আটকে পড়া শিশুদের কেউই সাঁতার জানে না। তবে জোনাথন সিমস-এর অবস্থা তেমনটা ছিল না। তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ গুহা ডুবুরি। তার ওপর সেনা কর্মকর্তা হিসেবে কসোভো ও ফকল্যান্ডেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তবে তারপরও অন্ধকার ও পানিময় গুহায় আটকে পড়াকে দুঃসহ মনে হচ্ছিলো তার। সিমস নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন এক জটিল ও বিপজ্জনক পরিস্থিতির মধ্যে। তিনি বলেন, ‘প্রথম রাতটি কেটেছে নিদ্রাহীন, বন্যা কবলিত গুহার প্যাসেজগুলোতে ক্রমাগত পানি বাড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। রাতভর আমরা সে শব্দ; আরও জোরালো হতে শুনলাম। এতে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমরা।’

পানিচালিত বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গুহার ভেতরে কী আছে তা আবিষ্কার করতে গিয়েছিলেন তারা। তবে আটকা পড়ার পর তাদের সঙ্গে থাকা খাবারও শেষ হয়ে যায়, প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে না পেরে উলঙ্গ হয়ে দিন যাপন করেছেন তারা। সময় কাটাতে একটি কাগজ কেটে ৫২ টুকরো করেছিলেন, যেন তা দিয়ে কার্ড খেলা যায়। জোনাথন সিমস বলেন, ‘মূল বিষয় হলো মানসিক অবস্থা কেমন থাকচে তা। কারণ, আতঙ্কিত হয়ে পড়ার মানে হলো বিপর্যয় নেমে আসা।’ জোনাথন সিমস জানান, গুহায় আটকে থাকা অবস্থায় খাবারের অভাব বোধ করছিলেন তারা। বলেন, ‘আমরা খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। মনোবল ধরে রাখার জন্য উদ্ধার হওয়ার পর আমরা কী কী খাব তা নিয়ে গল্প করতাম। একে অপরকে যার যার জীবনের গল্প শুনাতাম।’

জোনাথন সিমস মনে করেন, থাই গুহায় আটকা পড়া শিশুরা একসঙ্গে আছে, এটা একটা বড় মনোবলের বিষয়। নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নটিংহামশায়ারের এনএইচএস ট্রমা সেন্টারের পরিচালক স্টিফেন রেজেলও তাই মনে করছেন। তিনি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘সামাজিকভাবে সমর্থন পেলে ট্রমা ও দুর্দশা কাটিয়ে ওঠা যাবে। শিশুরা সব একসঙ্গে এক জায়গায় আছে। ওরা একা নয়, বিচ্ছিন্ন নয় কিংবা আহতও নয়। তারা একটি ফুটবল দল, যাদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি আস্থা রয়েছে। তাদের উজ্জীবিত রাখা ও মনোবল ধরে রাখার জন্য সঙ্গে একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি রয়েছেন। সবকিছু মিলে এখানকার পরিস্থিতিতে ভিন্নতা থাকবে। এর মানে হলো, পরবর্তীতে এসব শিশুর মধ্যে মানসিক জটিলতা দেওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।’ রেজেলের আশা, প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে এ শিশুরা পরিস্থিতির সঙ্গে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পারবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শিশুদের মধ্যে জানার কৌতুহলটা বেশি। গুহার ভেতরে যাওয়াকে সম্ভবত তারা অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নিয়েছিল। আমার ধারণা, ডুবুরিরাও এ উদ্ধার অভিযানকে অ্যাডভেঞ্চারে পরিণত করবেন। ডুবুরি ও নেভি সিলের সদস্যদের দৃঢ় নেতৃত্বে শিশুরা নিঃসন্দেহে আস্থা পাবে।’

যুক্তরাজ্যের কেভ ডাইভিং গ্রুপের চেয়ারম্যান মার্টিন গ্রাস। গুহা থেকে উদ্ধারের অনেক অভিযানে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে তার। তিনি বলেন, ‘আশা করি অ্যাডভেঞ্চারের অংশ হিসেবে এ শিশুরা ডাইভিং প্রশিক্ষণ পাবে। তবে ডুবুরিরা চাপে থাকবেন। অক্সিজেন সরবরাহ অক্ষুণ্ন রাখা ও গুহায় সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে উদ্বেগে থাকবেন তারা।’ ভক্স নিউজের এক বিশ্লেষণেও অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইডজনিত ঝুঁকির কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। সঙ্গে বলা হয়েছে আরও ৩ ঝুঁকির কথা। সেগুলো হলো: সাঁতার না জানা কিশোরদের সাঁতারে পারদর্শী করা, গুহাতে খনন কাজ পরিচালনা এবং সেখান থেকে পানি নিষ্কাশন। 

জোনাথন সিমস-এর এখনও মনে আছে, গুহা থেকে বের হয়ে আসার সময়কার দৃশ্যের কথা। বাইরে দুই হাজার সাংবাদিক অপেক্ষা করছিলো। তবে সিমস মনে করেন, তারা যেভাবে আটকা পড়েছিলেন, সেখান থেকে বের করে আনাটা এতোটা কঠিন ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্ধার অভিযান তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। সবমিলে ৩০০ মিটারের মতো পথ সাঁতরাতে হয়েছে। থাই শিশুদের উদ্ধারের বিষয়টি কৌশলগতভাবে চ্যালেঞ্জিং। কারণ, এক্ষেত্রে সাঁতার, হাঁটা ও ডাইভিং-এর সংমিশ্রণ লাগবে। আমি আশা করি তারা রিককে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দেবে। কারণ সত্যিকার অর্থে রিক জানেন তিনি কী করছেন। কোনও কিছু নিয়ে তিনি আতঙ্কিত হন না। তিনি খুব ঠাণ্ডা মাথায়, শান্তভাবে ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করেন।’ সিমস মনে করছেন, প্রথমে এক-দুইজনকে বের করে আনার পর গুহায় গিয়ে সে গল্প শোনানো হলে বাকিদের মনোবল বেড়ে যাবে।

একটু এদিক সেদিক হলেই খারাপ কিছু হওয়ার ঝুঁকি তো থেকেই যাচ্ছে। গত সপ্তাহে থাই গুহায় উদ্ধার অভিযানের প্রস্তুতি চলার সময় অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মারা যান নেভি সিলের সাবেক ডুবুরি সামান কুনান। তবে নটিংহামশায়ারের এনএইচএস ট্রমা সেন্টারের পরিচালক স্টিফেন রেজেল আশা করেন, সব কিছু পরিকল্পনামাফিক হলে এ অভিজ্ঞতাকে ভালোভাবে সামলে নিতে পারবে আটকে পড়া শিশুরা। তিনি বলেন, ‘তাদের (আটকা পড়া শিশু) মধ্যে প্রফুল্লতা দেখা গেছে। আমি মনে করি, মানুষের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করবে তারা। চ্যালেঞ্জ হবে তখনই যখন তারা গুহা থেকে বের হয়ে আসবে এবং সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে ধরবে। তারা সেলিব্রেটি হতে যাচ্ছে-আর সেটাই উদ্বেগের। কারণ বের হওয়া মাত্রই তারা কী ঘটেছিল তা পরিবারের সঙ্গে বিনিময় করার সুযোগ পাবে না। যত দ্রুত তারা তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারবে, তত দ্রুত তারা জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পারবে।’

 

/বিএ/
সম্পর্কিত
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৯ মাওবাদী নিহত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে অতীত ফিরিয়ে আনলেন শান্ত-রানারা
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধে করণীয় ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ জেনে নিন
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
হাতিরঝিলে ভাসমান অবস্থায় যুবকের মরদেহ
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
ইউক্রেনীয় ড্রোন হামলায় রুশ সাংবাদিক নিহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি