পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনা গত কয়েকদিন ধরে চরমে পৌঁছেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও শর্তারোপের বিপরীতে ইরান জানিয়ে আসছে তারা কোনও চাপে নত হবে না। কথার যুদ্ধ চলছে উভয় দেশের নেতা ও কর্মকর্তাদের মধ্যে। যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তুতি নিলেও তেহরান হুমকি দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার। এই ব্যস্ততম সমুদ্রপথ বন্ধ হলে প্রভাব পড়বে সারাবিশ্বের তেলের বাজারে। প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ২৫০ ডলার পর্যন্ত ছুঁয়ে যেতে পারে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অতীতেও ইরান এমন হুমকি দিয়েছে। এবারও তা বাস্তবায়ন করার সম্ভাবনা কম। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় ইরান বিকল্প বেছে নিতে পারে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।
গত ৩ জুলাই নিজস্ব ওয়েবসাইটে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি আঞ্চলিক তেল রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার প্রচ্ছন্ন হুমকি দেন। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বলছে তারা ইরানের তেল রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবে। তারা এই বক্তব্যের মানেই বুঝতে পারছে না। কারণ পুরো অঞ্চলের তেল রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে শুরু ইরানি তেল রফতানি বন্ধের কোনও মানেই থাকবে না।’ এরপর ৪ ও ৫ জুলাই ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি গার্ডের সেনা-আইআরজিসি’র কয়েকজন কর্মকর্তাও প্রেসিডেন্টের এই প্রচ্ছন্ন হুমকি বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। যেমন আইআরজিসি’র কমান্ডার মোহাম্মাদ আলী জাফারি বলেছেন, ‘দরকার পড়লে প্রেসিডেন্টের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে আমরা আশাবাদী। আমরা শত্রুদের বুঝিয়ে দেব হয় সবাই এই প্রণালী ব্যবহার করবে নয়তো কেউই করবে না’।
মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণী সংস্থা স্টার্টফর জানিয়েছে, আগামী নভেম্বর মাসের শুরুতেই ইরানের তেল রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের সঙ্গে ৬ বিশ্ব শক্তির পরমাণু চুক্তির পরও এসব নিষেধাজ্ঞা স্থগিত রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত মে মাসে ট্রাম্প প্রশাসন ওই চুক্তি থেকে বের হয়ে এসেছে। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের ইরানি তেল আমদানি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে উপসাগরীয় দেশগুলোকে তেল উত্তোলন বাড়ানোর জন্য প্রলুব্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইরানের তেল সরবরাহ বন্ধই শুধু নয়, লিবিয়া ও ভেনেজুয়েলার মতো প্রধান তেল উত্তোলনকারী দেশে অস্থিতিশীলতার কারণে তেল উৎপাদন কমে যাওয়ায় সৃষ্ট ঘাটতি পূরণের জন্যই এই চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।
সংস্থাটি আরও জানায়, এখন যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে মিত্রদেশগুলো আমদানি বন্ধ করে দিলে ইরানের তেল রফতানি প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল কমে যাবে। দেশটি এখন প্রতিদিন ২২ লাখ ৮০ হাজার ব্যারেল তেল রফতানি করে থাকে। তেল রফতানি কমে গেলে ইরানের আয়ও অনেক কমে যাবে। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার পাল্টা পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছে ইরান। এরই ধারাবাহিকতায় ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার পুরোনো হুমকি আবার দিলো। এই নৌপথটি বন্ধ করে দেওয়া হলে বাজার অস্থিতিশীল হয়ে তেলের দাম বেড়ে যাবে। এতে ইরানের আর্থিক ক্ষতিও কমে আসবে।
ইরান ও ওমানে মধ্য দিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার সরু পথ হরমুজ প্রণালী দিয়েই বিশ্বের সামুদ্রিক তেল বাণিজ্যের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়ে থাকে। প্রতিদিন এই পথ দিয়ে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ ব্যারেল তেল রফতানি করা হয়। এছাড়া পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের যেকোনও ধরনের সামুদ্রিক যোগাযোগের জন্য পথটি অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে। পথটির ওপর ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন ও কাতারের সব বন্দর, আরব আমিরাতের বেশিরভাগ বন্দরসহ সৌদি আরবের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর পুরোপুরি নির্ভরশীল।
বাস্তবসম্মত হোক আর না হোক হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হলে অবশ্যই তা বিশ্ববাজারে প্রভাব ফেলবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শীর্ষ তেল আমদানিকারক দেশগুলো এই পথের ওপরই বেশি নির্ভর করে থাকে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসি জানিয়েছে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এশিয়ার দেশগুলো। কারণ এই পথ দিয়ে সবচেয়ে বেশি অপরিশোধিত তেল আমদানি করে চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর। এশিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ তেলের যোগান দেয় এই নৌপথ। তাই পথটি বন্ধ করা হলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়ে যাবে। ফলে এসব দেশ আরও ভোগান্তিতে পড়বে।
ইরান যদি এক বা দুই মাস হরমুজ প্রণালী বন্ধ রাখে তাহলে অপরিশোধিত তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ২৫০ ডলারে পৌঁছাতে বলে রাশিয়া টুডে কে জানিয়েছেন গ্লোবাল এফএক্স’র বিনিয়োগ বিশ্লেষক ভ্লাদিমির রোজান্কোভস্কি। তবে তিনি মনে করেন, অঞ্চলটিতে বড় ধরনের সামরিক উপস্থিতি থাকায় ইরান এই পদক্ষেপ নাও নিতে পারে।
আগেও যুক্তরাষ্ট্র যখনই ইরানের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি দিয়েছে ইরান তখনই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর ইরান একই হুমকি দিয়েছিল। ইরানের প্রেসিডেন্ট আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এক ফোঁটা তেলও পার হতে না দেওয়ার হুমকি দেওয়ার পর নৌবাহিনীর প্রধান বলেছিলেন, এই প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া তাদের জন্য সহজ হবে। তবে ওই সময় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করেনি।
স্টার্টফর তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তবে তখনকার পরিস্থিতির সঙ্গে এখনকার একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। আর তা হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাব। ওই সময় পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য বারাক ওবামা প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করেছিল। কিন্তু বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে ইরানবিরোধী নীতিকে বাস্তবায়নে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। এ কারণে তারা ইরানের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইসরায়েল ও সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক জোরদার করছে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে বার বার বলে আসলেও হরমুজ প্রণালী বন্ধ করাই ইরানের সম্ভবত সবচেয়ে চরম বিকল্প। ওই প্রণালী বন্ধ করার চেষ্টা করা হলে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলোর ব্যাপক যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ দেশগুলো তাদের নৌ ও বাণিজ্য পথের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করবেই। এছাড়া ইরানের নিজের অর্থনীতি ও নৌ-কার্যক্রমের জন্যও পথটি গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের পণ্যবাহী সব জাহাজও এই পথ ব্যবহার করে। আর হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে ইরানের বর্তমান লক্ষ্যও ব্যাহত হবে। কারণ দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের আর কোনও কঠোর নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ চীন ও ভারতের মতো মিত্রদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা হলে এসব দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে ইরান তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জর করতে পারবে না। আর ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে উত্তোরণের জন্য বাণিজ্যের প্রতি ইরানকে বেশি মনযোগী হওয়া প্রয়োজন। তাই এখনই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া হলে তা তাদের জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রও হরমুজ প্রণালী বন্ধে ইরানের হুমকি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ডের মুখপাত্র নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন বিল আরবান বৃহস্পতিবার (৫ জুলাই) ব্রিটিশ বার্তা রয়টার্সকে পাঠানো এক ই-মেইলে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার অংশীদাররা মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে। তারা সবাই মিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী নৌ-চলাচলের স্বাধীনতা ও বাণিজ্য প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
স্ট্রার্টফর তাদের বিশ্লেষণে দাবি করেছে, আঞ্চলিক যুদ্ধ বেঁধে না যাওয়া পর্যন্ত ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করবে না। এমনকি আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর তেল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করলেও এমন পদক্ষেপ নেবে না ইরান। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা চাপ বাড়ালে বরং ইরান ভিন্ন পথে তাদের মোকাবিলার চেষ্টা করবে। দেশটি নিজস্ব সক্ষমতায় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ শুরু করবে। এছাড়া পারস্য সাগরে অন্যান্য দেশের নৌযানকে হয়রানির পথ বেছে নিতে পারে। বিশেষ করে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের অপরিশোধিত তেলবাহী মার্কিন বা অন্যান্য জাহাজ বা দেশগুলোর মাছ ধরার নৌকাগুলো এর শিকার হতে পারে।