ফিলিস্তিনি চিকিৎসাকর্মী রাজান আল নাজ্জারকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যার প্রমাণ পেয়েছে ইসরায়েলের একটি মানবাধিকার গ্রুপ। ৩০ মার্চ শুরু হওয়া ফিলিস্তিনিদের গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন কর্মসূচির দশম শুক্রবারে (১ জুন) ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে এই ফিলিস্তিনির মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত শেষে ইসরায়েলের মানবাধিকার গ্রুপ বি’টেসেলেম এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের সেনা কর্তৃপক্ষ ওই মৃত্যুকে একটি দুর্ঘটনা বলে আখ্যা দিয়ে আসলেও তদন্ত শেষে মানবাধিকার গ্রুপটি বলছে ইসরায়েল রাষ্ট্রের গুলি শুরুর নীতির সরাসরি ফল হলো নাজ্জারের মৃত্যু।
১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে গঠিত হয় ইসরায়েল নামের রাষ্ট্র। ১৯৭৬ সালের ৩০ মার্চ ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে ইহুদি বসতি নির্মাণের প্রতিবাদ করায় ছয় ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। পরের বছর থেকেই ৩০ মার্চ থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পরবর্তী ছয় সপ্তাহকে ভূমি দিবস হিসেবে পালন করে আসছে ফিলিস্তিনিরা। এই বছরের কর্মসূচিতে চালানো ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে অন্তত ১৩৭জন ফিলিস্তিনি। আহত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার।
গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন কর্মসূচির দশম শুক্রবার (০১ জুন) ছিল সেদিন। ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর স্নাইপারের (দূর থেকে নিশানায় নিখুঁত লক্ষ্যভেদে পারদর্শী বন্দুকধারী) গুলিতে আহত বিক্ষোভকারীদের চিকিৎসা সহায়তা দিতে অন্য প্যারামেডিকদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করার সময়ে নিজেই নিহত হন ২১ বছর বয়সী রাজান আল নাজ্জার। তখন ইসরায়েলি বাহিনীর তরফে এই মৃত্যুর ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল।
During an initial examination of the incident that took place on June 1st, 2018, in which a 22-year-old Palestinian woman was killed, it was found that a small number of bullets were fired during the incident, and that no shots were deliberately or directly aimed towards her
— IDF (@IDFSpokesperson) June 5, 2018
নিজেদের প্রাথমিক তদন্তের বরাত দিয়ে ইসরায়েলি বাহিনীর মুখপাত্র গত ৫ জুন বলেন, আল নাজ্জারকে ইচ্ছাকৃতভাবে লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়নি। দেশটির সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েলের কাছে তার দাবি ছিল নাজ্জার হয়তো কোনও গুলির ভগ্নাংশ বা লক্ষ্যভ্রস্ট হওয়া কোনও গুলিতে নিহত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে থাকা সেনাদের সাক্ষাৎকারে ভিত্তিকে ওই তদন্ত হয়েছিল বলে তখন জানানো হয়েছিল। পরীক্ষার বরাত দিয়ে তারা জানিয়েছিল, ওই সেনা সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিল, নাজ্জারকে নয়।
তবে বি’টেসেলেম’র তদন্তে দেখা গেছে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য সীমান্ত বেড়ার ২৫ মিটার দূরে নাজ্জারকে তাক করে সরাসরি গুলি করে। মানবাধিকার গ্রুপটি বলছে, ‘নাজার ওই নিরাপত্তা সদস্য বা অন্য কারোও প্রতি নিরাপত্তা হুমকি তৈরি না করলেও মেডিকেল ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তাকে গুলি করা হয়।’
বি’টেসেলেম’র মুখপাত্র অমিত গিলাটজ বলেছেন, ‘ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই ঘটনার অনেকগুলো বর্ণনার সঙ্গে মিল না পেয়ে তারা এই একটি সিদ্ধান্তেই পৌঁছাতে পেরেছেন।’
বি’টেসেলেমকে দেওয়া স্বাক্ষ্যে আল নাজারের সহকর্মী ও খান ইউনিস এলাকার চিকিৎসা স্বেচ্ছাসেবী রামি আবু জাজার (২৯) বলেছেন, সেদিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সীমান্ত এলাকায় টিয়ার গ্যাসে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা দুই ব্যক্তিকে উদ্ধারে যায় প্যারামেডিকদের একটি গ্রুপ। মেডিকেল ইউনিফর্ম আর ভেস্ট পরিহিত এই গ্রুপটি তাদের মাথার ওপরে হাত উঁচু করে সেনা সদস্যদের জানিয়েছিল দেখো আমরা প্যারামেডিক।
তারা অজ্ঞান ওই দুই ব্যক্তিকে সরিয়ে আনা শুরু করলে ওই সেনা সদস্যটি তাদের দিকে প্রবল বেগে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে আল নাজ্জারের শ্বাসরোধ হতে শুরু করে আর ওই গ্রুপটি বেড়ার কাছ থেকে সরে যেতে থাকে।
আবু জাজার বলেন, ‘আমরা সরে এসে কিছুটা ভালো অনুভব করতেই বিক্ষোভকারীদের কাছাকাছি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।’ ‘আমরা তাদের থেকে দশ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম যা সীমান্ত বেড়া থেকে ২৫ মিটার দূরত্বে। আমাদের আশেপাশে কোনও বিক্ষোভকারী ছিলো না। প্রায় ৫.৪৫মিনিটের দিকে আমরা দেখলাম সামরিক বাহিনীর একটি জিপ থেকে দুই সৈন্য নামলো, হাঁটু গেড়ে বসলো আর আমাদের দিকে বন্দুক তাক করলো।’
‘রাজান আমার ডান দিকে দাঁড়িয়ে ছিল আর মেডিকেল দলের আরেক সদস্য রাশা আমার পিছনে ছিল। আমরা কথা বলছিলাম। হঠাৎ করে তারা আমাদের দিকে দুটি গুলি ছুঁড়লো। আমি নাজারের দিকে তাকালাম আর দেখলাম তার পিঠে গুলি লেগেছে আর পড়ে গেল,’ বলেন জাজার।
সেকেন্ডের ব্যবধানে আবু জাজার নিজের হাঁটুরে ওপরে গুলিবিদ্ধ হন। তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক প্যারামেডিকে ডান হাত ও পেটে গুলির ধারালো অংশ আঘাত করে।
বি’টেসেলেম’র এর মুখপাত্র বলছেন, আল নাজ্জারের মৃত্যুর পর প্রথমে সামরিক বাহিনীর তরফে দাবি করা হয়েছিল ওই ঘটনাস্থলে নাজার দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় সেনাসদস্যরা কোনও গুলি করেনি। এর মাধ্যমে ইসরায়েলি বাহিনী তার মৃত্যুর দায় থেকে সদস্যদের মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
বি’টেসেলেমের অনুসন্ধান মৃত্যুর আগে দেওয়া আল নাজ্জারের দেওয়া সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। গত এপ্রিলে আল জাজিরাকে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে নাজ্জার বলেছিলেন, তাকে লক্ষ্য করে একাধিকবার গুলি চালিয়েছে ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘আমি তথ্য পেয়েছি যে আমাকে মাঠ পর্যায়ে আমার সব কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা আমাকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। তবে আমি সেসব অগ্রাহ্য করেছি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে গ্রেট রিটার্ন অব মার্চ কর্মূসূচি চলাকালে ইসরায়েলের সেনা সদস্যদের গুলিতে অন্তত ১৩৭জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি।
নাজ্জার নিহত হওয়ার দুই সপ্তাহ আগে ১৪ মে আরেক চিকিৎসাকর্মী মুসা আবু হাসানাইনকেও গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত ৩০ মার্চ থেকে ১০ জুলাই পর্যন্ত ৩৫৭জন স্বাস্থ্য কর্মীর ওপর আক্রমাণ চালানো হয়েছে। এর মধ্যে তাজা গুলির আঘাত পেয়েছেন ২৬ জন, সরাসরি টিয়ারগ্যাসের ক্যানিস্টারের আঘাত পেয়েছেন ৩৭জন আর ১২ জন গুলির ভগ্নাংশের আঘাত পেয়েছেন। একই সময়ে ৫৮টি অ্যাম্বুলেন্সও আক্রান্ত হয়েছে।
বি’টেসেলেম বলছে বিক্ষোভ শুরুর পর ইসরায়েলের প্রণীত গুলি শুরুর নীতির (ওপেন ফায়ার পলিসি) সরাসরি ফল হলো নাজ্জারের মৃত্যু। গিলাটজ বলেন, আল নাজ্জারের মৃত্যুর দায় অস্বীকার হলো সেই প্রক্রিয়ার অংশ যার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ আসল ঘটনা গোপন করে ইসরায়েলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে আসছে।
তিনি বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের হত্যার বিষয়ে ইসরায়েল উদাসীন। না হলে অনেক আগেই তারা গুলি শুরুর নীতি বদলাতো আর সীমান্ত বেড়ার ওপাশে থাকা নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী যারা কোনও ধরণের হুমকি তৈরি করে না তাদের ওপর গুলি ছোঁড়া বন্ধ করতো।’
ইসরায়েলের মানবাধিকার সংগঠন ইয়েশ দিন ও আরও কয়েকটি গ্রুপ মিলে দেশটির উচ্চ আদালতে এক পিটিশন দাখিল করে। তাতে ফিলিস্তিনিদের গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন কর্মসূচীতে প্রণীত গুলি শুরুর নীতি অবৈধ। মে মাসে হাই কোর্ট বেঞ্চের বিচারকেরা সর্বসম্মতভাবে ওই পিটিশন খারিজ করে দেয়। বিচারকদের যুক্তি ছিল, এই বিক্ষোভ হচ্ছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গ্রুপ হামাসের সঙ্গে তাদের দেশের লড়াইয়ের অংশ।