X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আসামের অবৈধ অভিবাসী এবং ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদিতা

আশীষ বিশ্বাস, কলকাতা
০২ আগস্ট ২০১৮, ০৩:২২আপডেট : ০২ আগস্ট ২০১৮, ১১:০১
image

আসামে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়া বাঙালিদের খুঁজে বের করা ও তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে না হতেই তা ভারত ও বাংলাদেশে প্রবল নিন্দা ও বিতর্কে জন্ম দিয়েছে। দিল্লির সরকার ভাবতেও পারেনি, আসামে নাগরিকত্ব তালিকার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের পর ভারতের বাইরেও এমন তীব্র প্রতিক্রিয়ার ঢেউ দেখা দেবে। কলকাতাভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক চারুব্রত রায় বলেছেন, ‘এমন কি ৩০ জুলাই গোয়াহাটিতে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনসের (এনআরসি) দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার ও সেই অনুযায়ী কোনও ব্যবস্থা কার্যকর করার আগেই জাতিসংঘের সংস্থা ও অন্যান্য সংগঠনের তরফ থেকে ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। আর অব্যাহতভাবে বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে যেভাবে খবর প্রকাশ করা হয়েছে এ বিষয়ে তা না হয় বাদই থাকল।’ দক্ষিণ এশিয়ায় ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকটের মতো ভূ-রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপুল সংখ্যক (প্রায় ৪০ লাখ) অভিবাসীর বিষয়ে ভারত কী ব্যবস্থা নেয় তা দেখার জন্য বিশ্ববাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আসামের অবৈধ অভিবাসী এবং ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর সুবিধাবাদিতা

আসামে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে যে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে তাতে কার্যত ভারত মাঝখান থেকে দুই ভাগ হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’ (বিজেপি) দেখছে তার পাশে কেউ নেই। বিজেপির দীর্ঘদিনের মিত্র ও ‘ভারতে মুসলমান অনুপ্রবেশের’ বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করা শিবসেনা পর্যন্ত আসামের এনআরসি নিয়ে চলা বিতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে বিরত রয়েছে। তারপরও দলটি এনআরসির কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃনমূল কংগ্রেস ন্যাশনাল সিটিজেনশিপ রেজিস্টার ধারণাটিরই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে যা দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা! দলটি এ বিষয়ে কংগ্রেস এবং এসপি, বিএসপি ও আরজেডির মতো স্থানীয় দলসহ বামপন্থীদের কাছ থেকে যে সমর্থন পেয়েছে তা অবিশ্বাস্য। স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ কাল বিলম্ব না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কংগ্রেসকে ‘ভারতবিরোধী ও বাংলাদেশি মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের পক্ষাবলম্বী’ আখ্যা দিয়েছেন। এমন কথা বলায় বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রবল প্রতিবাদের মুখে অমিত শাহ রাজ্যসভায় তার ভাষণ শেষ করার সুযোগ পাননি। একই পরিস্থিতিতে পড়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।

বিজেপি বলার চেষ্টা করছে, আসামে নাগরিকত্ব তালিকা বহির্ভূত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া চালুর মধ্য দিয়ে তারা শুধু আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্পষ্টতই বিজেপি যে চরমপন্থী হিন্দুদের সমর্থন নিশ্চিতের চেষ্টায় রয়েছে তাও গোপন নয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে কতিপয় সংবাদমাধ্যম ও রাজনীতিবিদ যেমন বিজেপিকে রশির ওপর ঝুলন্ত হিসেবে দাবি করেছেন, বাস্তবতা তার সঙ্গে মেলে না। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, পরিস্থিতি অতটাও বিজেপির প্রতিকূলে নয়। পেশাগত সূত্রে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সফর করা একজন সংবাদমাধ্যম কর্মী জানিয়েছেন, ‘আমি ভারতের বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে দেখেছি, বিশেষ করে সেসব স্থান, যেসব স্থানে দাঙ্গা হয়েছে এবং ধর্মীয় উত্তেজনা রয়েছে। আমি দেখেছি, ওই সব এলাকায় হিন্দুদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য তৈরি হয়েছে। বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোতে সেক্যুলারিজম একটা ফ্যাশনের মতো করে রয়েছে। ফলে তারা এই খবর এড়িয়ে যাচ্ছে। এমন কি পশ্চিম বাংলাতে দ্বিগঙ্গা, ধূলাগড়িসহ বিভিন্ন এলাকাতে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। ওই এলাকাগুলোতে বিজেপির অবস্থান দুর্বল বলে তৃনমূল কংগ্রেস অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজেপির অবস্থানই এলাকাগুলোতে শক্তিশালী হয়েছে। একটা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ চলছে। আর তা সম্ভব হচ্ছে সশস্ত্র দলীয় সমর্থকদের খুশি রাখতে তৃনমূল কংগ্রেস কর্তৃক পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার মাধ্যমে।’

অবস্থাদৃষ্টে এটা স্পষ্ট, বিজেপি ভোটের রাজনীতিতে সুযোগ সন্ধানীর মতো আচরণ করছে। তার লক্ষ্য, হিন্দুদের খুশি রাখা। সেটা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দলটিকে এনআরসি হালনাগদ করার মতো প্রকল্পে সমর্থন দিতে হবে। আর সেটাই ঘটেছে আসামে।

এনআরসির বিরোধিতা করে এবং ‘মুসলমানদের পক্ষে দাঁড়িয়ে’ মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোও যে খুব একটা সমাদর দাবি করতে পারে তাও নয়। কারণ কংগ্রেস ও তৃনমূল কংগ্রেস আগেও বিজেপির বিরুদ্ধে শুধু বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা করে ধরা পড়েছে। তাদের সুযোগসন্ধানী আচরণ আগেও দেখেছে সবাই।

নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়া আসামের প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন বিশাল ঘোষণার কারণ হচ্ছে আর কয়েক মাস পরেই লোকসভার নির্বাচন। তিনি যে প্রধানমন্ত্রী হতে চান, সে বিষয়ে তিনি আর কোনও রাখ-ঢাক রাখছেন না।

কিন্তু ২০০৫ সালের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে লোকসভায় এই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই তাকে কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগে তোলপাড় করে ফেলেছিলেন। তিনি স্পিকারের দিকে কাগজপত্রও ছুঁড়ে মেরেছিলেন। তার এই আচরণের কারণ ছিল: পশ্চিমবঙ্গে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের’ প্রবেশ এবং তাদেরকে তখনকার সময়ে ক্ষমতাসীন বামপন্থি সরকার যে অবৈধভাবে ভারতীয় ভোটার বানাচ্ছিল সে বিষয়ে সংসদে প্রমাণ উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন তিনি।’ আজ তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন কিন্তু তিনি বিজেপির নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন দুইবার। একসময় তিনি আরএসএসকে ‘জাতীয়তাবাদী সংগঠনও’ হিসেবেও বর্ণনা করেছেন।

২০০৫ থেকে ২০১৮ সালে কী পাল্টেছে মমতার ক্ষেত্রে? তিনি বিরোধী দলের একজন নেতা থেকে থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতা পর্যন্ত গেছেন; প্রথমে বিজেপির সহায়তায় কেন্দ্রে আর তারপর রাজ্যে। কংগ্রেসের নেতা আব্দুল মান্নান মন্তব্য করেছেন, বামপন্থীরা আগে বাংলাদেশি অভিবাসী মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করত। এখন সে সুযোগ নেওয়ার পালা মমতার।’

সমস্যা হচ্ছে আসামের বেশিরভাগ দল কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ আনে, যে অভিযোগ কংগ্রেস বামপন্থীদের বিরুদ্ধে তুলছে। আসামে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তারা ‘বাংলাদেশি মুসলমান অভিবাসীদের’ ভোট ব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করত। ভোটারদের মধ্যে যারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, তারা সব সময়ই নিরাপত্তা ও আর্থিক সহায়তার জন্য ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই ভোট দিত।

কংগ্রেস, তৃনমূল কংগ্রেস বা বামপন্থীদের মধ্যে যে-ই করুক না কেন, অবৈধ অভিবাসীদের ভারতে ভোটার করা এবং তাদের স্থায়ী হতে সহায়তা করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে সবসময়ই সুবিধা পেয়ে এসেছে দলগুলো। অথচ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন আসামের নাগরিকত্ব তালিকার পক্ষে থাকা বিজেপির বিরুদ্ধেই শুধু সুবিধাবাদিতার অভিযোগ উঠছে।

ভারতের সব বড় দলের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে পার্থক্য শুধু এটাতেই যে সেক্যুলার দলগুলো নিজেদের সেক্যুলার আখ্যা দিয়ে যে বাগাড়ম্বর করে কার্যত তার কোনও বিশেষ অর্থ নেই!

/এএমএ/
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৬
মোদি ও রাহুলের বিরুদ্ধে নির্বাচনি আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ, ইসির নোটিশ
সর্বশেষ খবর
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ওরসে ঝগড়া, সেই শত্রুতায় ছুরিকাঘাতে যুবককে হত্যা
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
ন্যাপ বাস্তবায়নে উন্নত দেশগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তার আহ্বান
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
মীনা বাজার এখন মিরপুর-১২ নম্বরে
মীনা বাজার এখন মিরপুর-১২ নম্বরে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা