X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদিবিরোধী অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিক বিপাকে কানাডা

বিদেশ ডেস্ক
১২ আগস্ট ২০১৮, ১৫:১৭আপডেট : ১২ আগস্ট ২০১৮, ১৫:২৮
image

মানবাধিকার প্রশ্নে সৌদি আরবের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে কূটনৈতিকভাবে কাউকে পাশে পায়নি কানাডা। যুক্তরাষ্ট্র বলে দিয়েছে, সৌদি আরব ও কানাডার মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে সেখানে ওয়াশিংটন হস্তক্ষেপ করবে না। যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও সৌদি-বিরোধিতায় নারাজ। বিশ্লেষকদের মতে, সৌদি আরব কানাডাবিরোধী অবস্থান নিলে অটোয়ার ওপর খুব বেশি একটা প্রভাব পড়বে না। তবে ভবিষ্যতের কোনও রাজনৈতিক সংকটের বিবেচনায় এই একাকী হয়ে পড়া নিয়ে তাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। তেমন সংকটে পশ্চিমা দেশগুলোকে পাশে না পেলে কী হবে, তা নিয়ে ভাবছেন তারা। 

সৌদি আরব ও কানাডার পতাকা
১ আগস্ট ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ জানিয়েছিল, সৌদি আরব কয়েকজন অধিকারকর্মীকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে ছিলেন সৌদি আরবের নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রখ্যাত নেত্রী সামার বাদাউই। এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে অপরাপর অধিকারকর্মীদের পাশাপাশি সামার বাদুউইয়ের ‘অবিলম্বে মুক্তি’ দাবি করেছিল কানাডা। এর আগে জাতিসংঘও একইরকমের দাবি জানিয়েছিল। কানাডার এই দাবি ভালো লাগেনি সৌদি আরবের। প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব বলেছিল, ‘কানাডার বক্তব্য সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে খোলাখুলি হস্তক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও বিধির খেলাপ।’ ক্ষোভ জানিয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার ও কানাডায় নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। কানাডার সঙ্গে থাকা শিক্ষা বিষয়ক চুক্তি বাতিল করা হয়। সৌদি আরবের বৃত্তিতে কানাডায় পড়াশোনা করতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অন্য দেশে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় রিয়াদ। কানাডা–সৌদি আরবের মধ্যে হওয়া প্রতিরক্ষা সমঝোতা এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তিও স্থগিত করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় কানাডার সঙ্গে বিমান চলাচল।

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্বগ্রহণের পর পরই পরিষ্কার হয়ে যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশ কানাডার সম্পর্কটা বদলাতে যাচ্ছে। নাফটা চুক্তি পুনর্বিবেচনার প্রশ্নে জোরালো আলোচনা হয়, দুই দেশের সীমান্ত দিয়ে লাখো অভিবাসন প্রত্যাশীর আগমন নিয়ে কথা হয়েছে এবং কানাডার সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতিকে আক্রমণ করা হয়। তবে, সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে তাতে যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মধ্যকার সম্পর্ককে সবচেয়ে বাজে দিকে টেনে নিয়ে গেছে। ‘এর সমাধান করাটা সৌদি আরব সরকার ও কানাডীয়দের বিষয়। দুই পক্ষেরই কূটনৈতিকভাবে এর সমাধান করা প্রয়োজন। আমরা তাদেরকে এটা করে দিতে পারি না।’

এরইমধ্যে নিজেদের একা বোধ করতে শুরু করেছে কানাডা। সাবেক কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের অধীনে কাজ করা নীতিমালাবিষয়ক পরিচালক রাচেল কুরান টুইটারে লিখেছেন, ‘গোটা বিশ্বে আমাদের একটি বন্ধুও নেই।’ ফেডারেল লিবারেল পার্টির সাবেক নেতা ও স্বনামধন্য কূটনীতিক বব রে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো যুক্তরাজ্যও একইরকম করে নীরব হয়ে আছে। টুইটারে তিনি লিখেছেন:  “ব্রিটিশ ও ট্রাম্পীয়রা নিজেদের ভূমিকাকে আড়াল করতে চাইছে এবং বলছে ‘আমরা’ সৌদি ও কানাডীয় দুই পক্ষের মানুষেরই বন্ধু। মানবাধিকারের জন্য সমর্থন দেওয়ায় ধন্যবাদ। আমরা অবশ্যই এ কথা মনে রাখব।”

প্রিন্স সালমান ও ট্রুডো
সম্প্রতি রিয়াদে সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় কানাডাকে ‘এর বড় ভুল সংশোধন’ করার আহ্বান জানান সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কানাডার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে সৌদি আরব। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আঞ্চলিক কর্মকর্তারা মনে করছেন, চলমান এ বিবাদ দিয়ে কানাডার তেমন কিছু করা যাবে না বললেই চলে। তবে তারা মনে করছেন, রিয়াদ তাদের অবস্থানের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সরকারগুলোকে বার্তা দিতে চায় যে, তাদের অভ্যন্তরীণ নীতিমালার ব্যাপারে কথা বলাটা কত অবৈধ। মিসর ও রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ সৌদি আরবের জন্য সমর্থন ব্যক্ত করেছে। কিন্তু কানাডা এখনও একাই আছে। এমনকি সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে এক ব্যক্তিকে তার অপরাধের জন্য শিরশ্ছেদের পর জনসম্মুখে ঝুলিয়ে রাখার খবর প্রকাশ হওয়ার পরও কানাডা কাউকে তাদের পাশে পায়নি।

সম্প্রতি সাংবাদিকদের কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, তার দেশ কূটনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সৌদি আরবের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘বিশ্বে তাদের যে গুরুত্ব তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে আমরা স্বীকার করি, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দেশটির অগ্রগতি করেছে।’ তবে মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে সৌদি আরবের ওপর চাপ জোরালো রাখার কথা বলেন ট্রুডো। তিনি বলেন, ‘একইসময়ে আমরা দেশের ভেতরে ও বাইরে যেখানেই প্রয়োজন বোধ করি না কেন মানবাধিকার ইস্যুতে স্পষ্ট ও দৃঢ়ভাবে কথা বলে যাব।’

অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থমাস জুনিয়াও বলেন, নির্দিষ্ট করে এ বিবাদের ক্ষেত্রে কানাডার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, ‘সৌদি আরব-কানাডার মধ্যকার সম্পর্ক খুব সীমিত। সুতরাং এ মুহূর্তে কানাডার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তবে এটা খুব উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠবে। যখন আমাদের সামনে সত্যিকারের সংকট আসবে আর আমরা একা থাকব, তখন আমরা কী করব?’ যুক্তরাষ্ট্রের  ভূমিকার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি দেশটিকে, একতরফা, আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধের প্রতি নেতিবাচক আখ্যা দেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের বিগত ৭০ বছরের কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। বলেন, এইসব বিবেচনায় রেখেই তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক গোড়া থেকে পর্যালোচনা করতে চান। জুনিয়াও-এর দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই ধারার অবস্থান সৌদি আরবকে শক্তিশালী করেছে। ইয়েমেন, কাতার ও লেবাননে সৌদি আরবের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডকে আগ্রাসী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও বেপরোয়া আচরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি।

কানাডা ও সৌদি আরবের কূটনৈতিক বিবাদের প্রতীকী ছবি
কোনও পক্ষেরই খুব বেশি একটা ক্ষতি না হলেও সহসা এ বিবাদের অবসান হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না জুনিয়াও। তার মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেপরোয়া ও আবেগতাড়িত আচরণ থেকে পিছু হটার ইচ্ছে সৌদি আরব খুব একটা দেখায়নি বললেই চলে। আর কানাডার কেন্দ্রীয় সরকারকে ১৪ মাসের মধ্যে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে। রিয়াদের কাছে ৯০০রও বেশি সাঁজোয়া যান বিক্রির চুক্তিতে স্বাক্ষর করা নিয়ে এমনিতেই ক্ষোভের মুখে আছে দেশটির সরকার। এ অবস্থায় কানাডার সরকার সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থায় যাবে না বলেই মনে করা হচ্ছে।

কূটনৈতিক এ বিবাদ থেকে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেদেরকে সরিয়ে রাখায় কোনও কোনও কানাডীয়র মনে হতাশা তৈরি হয়েছে। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন জুনিয়াও। তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন সুইডেন ও জার্মানির সঙ্গে সৌদি আরব লড়াইয়ে মেতেছে, তখন কানাডা কি সুইডেন ও জার্মানির পাশে দাঁড়িয়েছিল? না, একেবারেই না। আমরা চুপচাপ থাকি কারণ এতে জড়িত হয়ে কিছু অর্জন করা যাবে না। সেকারণে ইউরোপীয় পক্ষেরও হিসাবটা একই।’

দ্য গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি আরবের নারীদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কূটনৈতিকভাবে একা হয়ে পড়া কানাডার পক্ষে ব্যক্তিগত বিশ্বের কারও কারও সমর্থন আছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রকে কানাডার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান ও নিউ ইয়র্ক টাইমস। এক্ষেত্রে আরেক ধাপ এগিয়ে রয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট। তারা আরবি ভাষায় সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে।

বার্নি স্যান্ডার্সসহ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে গোনা কয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তির কণ্ঠেও একইরকমের সমর্থন প্রতিধ্বনিত হতে দেখা গেছে। মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স টুইটারে লিখেছেন: ‘অগণতান্ত্রিক সরকারকে মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে ওপর জোর দেওয়াটা গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য পুরোপুরি বৈধ। দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বিশেষ করে আমাদের সমর্থনপুষ্ট সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে।’

 

/এফইউ/বিএ/
সম্পর্কিত
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, গ্রেফতার ১
স্থায়ী সংঘাতে পরিণত হচ্ছে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা: তুরস্ক
সর্বশেষ খবর
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া