X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুয়ান্ডা ব্যর্থতা বদলে দেয় কফি আনানের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি

বিদেশ ডেস্ক
১৯ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪০আপডেট : ১৯ আগস্ট ২০১৮, ১৬:৪৩

সদ্য প্রয়াত কফি আনান ছিলেন আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত হওয়া প্রথম জাতিসংঘ মহাসচিব। এক গোলমালপূর্ণ সময়ে তিনি এ বিশ্ব সংস্থার হাল ধরেছিলেন এবং এই সময়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও অর্জন করেছিলেন। তবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে আনানের অনেক অর্জনই কয়েকটি ব্যর্থতার নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল। এসব ব্যর্থতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো, ১৯৯৪ সালে ৮ লাখ রুয়ান্ডান নাগরিকের গণহত্যা বন্ধে নিষ্ক্রিয়তা। ওই সময় কফি আনান জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিলেন। এক বছর পর সার্বিয়া গণহত্যা সংঘটিত হয়। ওই ঘটনায় বসনিয়ান সার্ব বাহিনী আট হাজার বসনিয়ান মুসলিমকে হত্যা করেছিল। রুয়ান্ডার ব্যর্থতা পরবর্তীতে বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে কফি আনানের ভাবনাকেই পাল্টে দিয়েছিল। প্রাপ্তিগুলোকে ঢেকে ফেলা ব্যর্থতাগুলো আবারও সফলতার চাদরে ঢাকার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এভাবেই কফি আনানকে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

কফি আনান

জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন দূত সামান্থা পাওয়ার তার ‘চেজিং দ্য ফ্লেম’ বইতে লিখেছিলেন, ‘ইতিহাস বইয়ে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে সংঘটিত দুটি গণহত্যার ঘটনার বর্ণনার পাশাপাশি আনানের নামটিও যুক্ত থাকবে।’ ইরাকে নিহত জাতিসংঘের ব্রাজিলিয়ান কুটনীতিক সার্জিও ভিয়েইরা দে মেলোর জীবনী নিয়ে বইটি লিখেছিলেন সামান্থা।  

১৯৯৪ সালের ওই গণহত্যা নিয়ে ১৯৯৯ সালে একটি স্বাধীন তদন্ত হয়েছিল। সেখানে উঠে এসেছে, রুয়ান্ডার গণহত্যা ঠেকাতে জাতিসংঘ ব্যর্থ হয়েছে। আনান তখন জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘এ ঘটনা ঠেকানোর জন্য কার্যকর কিছু না করার জন্য আমাদের সবাইকে গভীরভাবে অনুতপ্ত হতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময় গণহত্যা ঠেকাতে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো সরঞ্জামাদি রুয়ান্ডায় নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাছে ছিল না এবং তাদেরকে এ ধরনের কোনও নির্দেশও দেওয়া হয়নি।’ তবে তখনই রুয়ান্ডায় জাতিসংঘের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করেছিলেন কফি আনান। তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আমি এ ব্যর্থতা স্বীকার করছি এবং এর জন্য আমি গভীরভাবে অনুতপ্ত।’

পাঁচ বছর পর রুয়ান্ডার গণহত্যার ১০ম বর্ষপূর্তিতে আবারও কফি আনান বলেন, ‘রুয়ান্ডায় কী হচ্ছে সে ব্যাপারে যদি জাতিসংঘ, বিভিন্ন দেশের সরকার ও মিডিয়া আরও মনযোগী হতো, তবে এ গণহত্যা হয়তো প্রতিরোধ করা যেত।’

আনান বলেন, ‘ইচ্ছাকৃত ও অবহেলাজনিত এ অপরাধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দোষী। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বিভাগের প্রধান হিসেবে আমি নিজেও ওই সময়ে বেশ কয়েকটি দেশের কাছ থেকে সেনা চেয়ে চাপ দিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস ওই সময়ে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার পর আমি উপলব্ধি করেছি, আমার আরও অনেক কিছু করার ছিল। আমার উচিত ছিল সতর্কবার্তা দেওয়া এবং সমর্থন জোগাড় করা। জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার পাশাপাশি এ কষ্টকর স্মৃতি আমার চিন্তার ওপর ও আমার কর্মকাণ্ডের ওপর অনেকখানি প্রভাব ফেলেছে।’

১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় ন্যাটোর বিমান হামলা চলার সময়ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী কার্যক্রমের নেতৃত্বে ছিলেন কফি আনান। এ বিমান হামলার প্রতি তার দৃঢ় সমর্থন ছিল। সমালোচকদের দাবি এর মধ্যদিয়ে তিনি ১৯৯৬ সালে মহাসচিব হওয়ার লড়াইয়ে বিদায়ী মহাসচিব বুট্রোস ঘালির স্থলাভিষিক্ত হতে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিশ্চিত করেছিলেন।

আনানের জীবনীভিত্তিক বই ‘ইন্টারভেনশন্স: অ্যা লাইফ ইন ওয়ার অ্যান্ড পিস’ নিয়ে কানাডীয় লেখক মাইকেল ইগনাটিয়েপ একটি রিভিউ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি আনানকে ‘অমায়িক ও দূরবর্তী’ বলে উল্লেখ করেন। তবে সঙ্গে তিনি এও বলেছিলেন যে ‘মানবসম্পদ ও অর্থ বরাদ্দকরণের মতো জাতিসংঘের যেসব আমলাতান্ত্রিক ক্ষেত্র স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত, সেখানে বিচরণের সময় তিনি (আনান) কিভাবে তার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছিলেন, তার বর্ণনা পাওয়া যায়নি। ’

ইগনাটিয়েপ লিখেছেন, ‘এই পরিস্থিতিতে এমন সমস্যা থেকে নিজেকে দূরে রাখার সামর্থ্যসহ নিজের ভাবমূর্তি রক্ষায় কোমল ও কঠোর হওয়ার প্রয়োজন ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্থাটির বুলি সর্বস্ব নৈতিকতার বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেন এবং কখনোই বাস্তবতাকে নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে দেননি।  ইগনাটিয়েপ আরও লিখেছেন, ‘২০০১ সালে যখন তাকে জাতিসংঘের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, তখন তাকে সংস্থাটির জীবিত মহাসচিবদের মধ্যে সবচেয়ে আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।’

ঘানার নাগরিক আনান জাতিসংঘে দায়িত্ব পালনকালে বৈশ্বিক দারিদ্র্য কমাতে একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এজেন্ডা তৈরি  এবং এইচআইভি/এইডস মোকাবিলায় একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠন করেছিলেন। তবে রুয়ান্ডা ও সার্বিয়ার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালে আনান বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছিলেন। আনান বলেছিলেন, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি, যখন স্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে তখন আমরা তা পাশ কাটিয়ে যেতে পারি না। আমরা এও বুঝতে পেরেছি বিশ্বের জনগণের কাছ থেকে দৃঢ় সমর্থন পেতে হলে বৈধ ও সার্বজনীন নীতিমালার ওপর ভর করেই মধ্যস্থতা করতে হবে।’

জাতিসংঘের মহাসচিব হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের একেবারে শেষ ভাগে ২০০৬ সালে, একটি ফাউন্ডেশন গঠনের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে থাকেন আনান। ২০১২ সালে  ‘দ্য এল্ডার্স’ নামক সংস্থায় যোগ দেন তিনি। বিশ্বের সংঘাত নিরসনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ওই সংস্থাটি গড়েছিলেন। এ সময়ে আনানের বড় অর্জন হলো, ২০০৮ সালে কেনিয়ার নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা অবসানে সফলভাবে মধ্যস্থতা করা।

কফি আনানের উদ্যোগে সমঝোতায় স্বাক্ষরকারী কেনিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা রাইলা ওডিঙ্গা শনিবার (১৮ আগস্ট) ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কেনিয়ার সহিংসতা ইস্যুতে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তার দেশকে ভেঙে পড়া থেকে বাঁচিয়েছিলেন’। গত বছর আনানও তার ওই মধ্যস্থতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। দাবি করেছিলেন, তিনি যতগুলো মধ্যস্থতা করেছেন, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে নিবিড় ও স্থায়ী।

অন্য প্রচেষ্টাগুলো সফল ছিল না। আনানকে সিরিয়ায় জাতিসংঘের দূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তবে ২০১২ সালে তিনি ওই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন। তার অভিযোগ ছিল, সিরীয় সংঘাত নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তখন আনান আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘যে সময়ে সিরিয়ার মানুষেরা পদক্ষেপের প্রত্যাশায় মরিয়া, তখন নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যরা এক অপরের দিকে আঙুল তুলে যাচ্ছে ও গালি দিচ্ছে।’

দ্য আটলান্টিকের প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে এবং ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় তাকেই প্রতীকী অর্থে ‘আঙুল তোলা ও গালাগাল’ বলে উল্লেখ করেছেন আনান। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়েও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে একইরকমের নিষ্ক্রিয়তা দেখা গেছে। রোহিঙ্গা নিপীড়নবিরোধী একটি স্বাধীন কমিশনের সভাপতিত্ব করেছেন আনান। তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘মিয়ানমার সরকার যদি অহিংসভাবে ইস্যুটির সমাধান না করে, তবে চরমপন্থা ছড়িয়ে পড়তে পারে’।

মহাসচিব হিসেবে শান্তিরক্ষায় আনানের ব্যর্থতার পরও, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সংঘাত ও দুর্ভোগের যে চিত্র দেখা যায় তা কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার চেয়েও খারাপ। গত এপ্রিলে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আনান বলেছিলেন, ‘তিনি আশাবাদী। আমার আশাবাদ অদম্য মাত্রার। আমি আশাবাদী মানুষ হিসেবে জন্মেছি এবং আশাবাদী হয়েই বেঁচে থাকব।’

 

/এফইউ/এএ/
সম্পর্কিত
নাইজেরিয়ায় বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার, পালালো শতাধিক বন্দি
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
আটলান্টিক মহাসাগরে পাওয়া ৯ মরদেহের পরিচয় নিয়ে যা বললো ব্রাজিল
সর্বশেষ খবর
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
সমবায় সমিতির নামে কোটি টাকার দুর্নীতি: দুদকের অনুসন্ধান শুরু
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
পার্বত্য অঞ্চলে অদৃশ্য শক্তি বলে কোনও কথা নেই: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নারী কর্মচারীর অকস্মাৎ মৃত্যু, অভিযোগ সচিবের দিকে!
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা