X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনগণের প্রত্যাশার চাপে ইমরান খান

আলী রমজান
১৯ আগস্ট ২০১৮, ২৩:৪৮আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৮, ০৯:২৫

পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নানামুখী সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে সাবেক ক্রিকেট তারকা ইমরান খানকে। নির্বাচনি প্রচারকালে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশকে ইসলামিক কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা, বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করাসহ দেশকে দুর্নীতি ও দারিদ্র্যমুক্ত করার আকাশচুম্বী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করতে দেশের প্রধান প্রধান আইন পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু দেশটির পার্লামেন্টে ছোট দলগুলোর সমর্থন নিয়ে সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পেরেছে তার দল। এছাড়া দেশটির সিনেটও বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণে। তাই এসব আইন পাস করতে হয়ে বিরোধীদের সঙ্গে অনেক বিষয়েই তাকে ছাড় দিতে হতে পারে। আর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো দেশটির ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি। এছাড়া বিদেশ নীতিতে সামরিক প্রভাব বিস্তারের কারণে বিদেশি সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রেও অসুবিধায় পড়েবন ইমরান খান। তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে তাকে।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়, নির্বাচনের সময় উচ্চাভিলাষী বক্তব্যের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ইমরান খানই এমন প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছেন। একজন ক্রিকেট কিংবদন্তী ও কট্টর জাতীয়তাবাদী ইমরান খান তার সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়। নির্বাচনের আগে তিনি দেশে বিদ্যমান দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলাসহ জনগণকে দারিদ্র্যের হাত মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এমন একটি অস্থিতিশীল দেশ পেয়েছেন যা দেশের ভেতরে ও বাইরে দারুণ সমস্যার মুখে রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে দেশটির ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঐতিহাসিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে ভাঙন। এছাড়া প্রতিবেশি দেশ আফগানিস্তান ও পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রয়েছে দেশটির।

পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো ইমরান খানকে ‘পুতুল’ হিসেবে অভিহিত করে   অভিযোগ করেছে, ক্ষমতাধর সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ করে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, ধর্ম ও মানবাধিকারের ব্যাপারে ইমরান খান রক্ষণশীল অবস্থান নিয়ে আসছেন। তাই ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তার সরকার আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে পারবে বলে মনে হয় না। এছাড়া বিদেশ নীতির বিষয়েও তার জ্ঞান খুবই কম। তাই বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দেশটির সামরিক বাহিনী বিদেশ নীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। কারণ বাহিনীটি পাকিস্তানের বিদেশ নীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এই বিষয়ে সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সরকার অনেক সময় প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। দেশটির সামরিক বাহিনী এর আগে বিভিন্ন প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতও করেছে।

বিজয় ভাষণে ইমরান খান ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলেছেন। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পারিক লাভজনক সম্পর্কের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। বিশ্লেষকদের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করছে প্রভাবশালী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের ওপর। যদি ইমরানের বিদেশ নীতি তাদের থেকে আলাদা হয় তাহলে তাকেও দেশটির অন্যান্য প্রধানমন্ত্রীর মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে। তারা কেউই নিজেদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আমির আহমেদ খান বলেন, তাহলে তার ভবিষ্যতও অন্যদের মতোই হবে।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সরকারের সাবেক মন্ত্রী আহসান ইকবাল দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেন, ‘পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী যদি আপনার ভাইও হয়, তারা শেষে গিয়ে লড়াই শুরু করে দেবে। এখানকার ব্যবস্থাই এমন হয়ে আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যদি এই অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতা দূর করতে না পারি, পাকিস্তান তাহলে হামাগুড়ি দিয়েই চলতে থাকবে। পড়েও যাবে না, আবার সফলও হতে পারবে না। এই দেশের উন্নয়ন হবে না।’

পাকিস্তানের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক নুসরাত জাভেদ দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘আমি ইমরান খান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে এখনই কোনও দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছি না। তিনি সেনাবাহিনীর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী কাজ করবেন। তিনি বেসমারিক-সামরিক ভারসাম্য দূর করার মতো মানুষ নন।’

পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো পার্লামেন্টে সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। পার্লামেন্টে খুবই অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার জন্য ছোট দলগুলোর উপর নির্ভর করা ও সিনেটের নিয়ন্ত্রণ বিরোধীদের হাতে থাকায় বড় ধরনের ছাড় দেওয়া ছাড়া কোনও আইন সংসদে পাস করতে ব্যাপক ভুগতে হবে। আর ক্রমবর্ধমাণ প্রভাব বিস্তারকারী বিচার বিভাগও এসব আইন আটকে দিতে পারে।

পাকিস্তানের সংবাদপত্র ডনের সম্পাদক খুররাম হুসাইন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান’কে বলেন, ‘যদি পিটিআই গভীর থেকে পরিবর্তন আনতে আন্তরিক হয়, তাহলে তাদের কয়েকটি প্রধান আইন পরিবর্তন করতে হবে। অথবা বিশাল সংস্কার প্রচেষ্টার জন্য বৃহত্তর ঐক্য গঠন করতে হবে। তাই সবার সঙ্গে সম্পর্কের সেতুবন্ধন গড়ে তোলাই হবে প্রধান উপায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘নতুন সরকারকে অন্যান্য সংসদীয় দলের সঙ্গে কাজ করতে হবে। বর্তমান মেরুকরণের রাজনীতিতে তা অনেকটা কঠিন হবে।’

এতকিছুর পরও দেশটি এখন অনেক আশাবাদী। বিশেষ করে ইমরান খানে তরুণ সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, তিনি প্রায় ২১ কোটি জনগণের জন্য একটি দুর্নীতিমুক্ত ও সমৃদ্ধ ‘নতুন পাকিস্তান’ গড়ে তুলতে পারবেন। পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস পত্রিকার সম্পাদক রাজা আহমেদ রুমি রয়টার্সকে বলেন, তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তার অনুসারী ও ভোটারদের প্রত্যাশা পূরণ করা। কারণ তিনি প্রায় আকাশচুম্বী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

শপথ গ্রহণকালে ইমরান খান

এই বছরের স্বাধীনতা দিবসে পতাকা নিয়ে ইসলামাবাদের রাস্তায় মিছিল করার সময় অনেকেই বিশ্বাসী কণ্ঠে ইমরানকে সমর্থন করেন। তাদের মতে, ইমরান খান বিশ্বমানের হাসপাতাল গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন। একই সঙ্গে ৪০ শতাংশের উপরে নিরক্ষর জনসংখ্যার দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাবেন। নির্বাচনের সময় ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ বা পিটিআই’র স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করা শেখ ফারহাজ বলেন, ‘আমি আমার মেয়েকে একটি বেসরকারি স্কুল থেকে নিয়ে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি পাকিস্তানের পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।’

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ ও ভুট্টো পরিবারের পাকিস্তান পিপলস পার্টির কয়েক দশকের প্রভাব থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারায়ও অনেকে ইমরান খানের ওপর খুশি। রাস্তার পাশের পতাকা বিক্রেতা শাহ সুলতান বলেন, ইমরান খানের কাছে আমার অনেক প্রত্যাশা আছে। তিনি বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ আর রাজনীতিকদের কৃতকর্মের কারণেই আমি ইমরান খানকে ভোট দিয়েছি। তারা এখানে কিছুই রাখেনি।

তবে সমর্থক ও ভোটারদের এমন প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে ইমরান খানের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে তা হলো পাকিস্তানের ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি। বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইমরান খানের প্রতিশ্রুতিগুলোর বাস্তবতা নতুন করে যাচাই করা যেতে পারে। বিশেষ করে তিনি যখন একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। কারণ সম্পদের ঘাটতির কারণে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত চার বার মুদ্রার দাম কমিয়েছে। এরপরও ঘাটতির কারণে তা আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। দেশটির বর্তমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের কাছাকাছি হলেও এসব ঘাটতির কারণে এ বছর প্রবৃদ্ধিও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তাই ইমরান খানের সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা জরুরি ভিত্তিতে চীনের কাছ থেকে ঋণ নেবে নাকি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে সহায়তা নেবে। সংস্থাটি ১৯৮০ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে দেশটিকে ১৪ বার ঋণ দিয়েছে। দুই ঋণদাতাই দেশটিকে অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বলেছে। তার দেশটিকে খরচ কমানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছে।

ইমরান খানের নতুন সরকারের শিক্ষামন্ত্রী সাফকাত মাহমুদ বলেছেন, ‘অর্থনৈতিক দুর্দশা একটি বড় সমস্যা হলেও তার দল একটি মঙ্গলজনক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। এজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার খুবই জরুরি।’ মাহমুদ বলেন, ‘দলের সবাই বুঝতে পেরেছে, এই ব্যাপক প্রত্যাশা পূরণের জন্য আমাদের সবাইকে বাড়তি সময় কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একজন দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিক হিসেবে ইমরান খানের ভাবমূর্তি সরকারের ওপর আস্থা বাড়াবে। জনগণও তাদের কর ঠিকমতো আদায় করবে। দেশে এখন মাত্র ১ শতাংশ মানুষ আয়কর দিয়ে থাকে।’ 

সাফকাত মাহমুদ বলেন, ইমরান খান অর্থনীতি, প্রশাসন ও বিদেশ নীতিতে বিশাল সমস্যার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তিনি আত্মবিশ্বাসী। তিনি প্রস্তুতও। তার আন্তরিকতা রয়েছে।

 

/আরএ/
সম্পর্কিত
সমলিঙ্গের বিয়ে অনুমোদনের পথে থাইল্যান্ড
মস্কোয় কনসার্টে হামলা: প্রশ্নের মুখে রুশ গোয়েন্দা সংস্থা
সুপেয় পানির অপচয়, বেঙ্গালুরুতে ২২ পরিবারকে জরিমানা
সর্বশেষ খবর
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
বাস-সিএনজির সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৩ জন নিহত
বাস-সিএনজির সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীসহ ৩ জন নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে চারজন নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে ছুরিকাঘাতে চারজন নিহত
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
এবার চীনে আগ্রহ বিএনপির
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
কারাগারে যেভাবে সেহরি-ইফতার করেন কয়েদিরা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’
বিএনপির নেতাদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী‘বউদের ভারতীয় শাড়ি পোড়ালে বর্জনের কথা বিশ্বাস করবো’