X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

ইয়াবা পরিবহনকারী এক রোহিঙ্গার ভাষ্য

বিদেশ ডেস্ক
২০ আগস্ট ২০১৮, ১৮:২৪আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৮, ০১:৪৬
image

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশ অব্যাহতভাবে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে। রোহিঙ্গারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেছে, বেঁচে থাকার অন্য কোনও অবলম্বন না পেয়েই তারা ইয়াবা পরিবহনের মতো কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কুতুপালং আশ্রয় শিবিরের থাকা ইয়াবা পরিবহনে জড়িত একজন রোহিঙ্গা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে জানিয়েছে, অর্থের অভাবে ইয়াবা পরিবহন করলেও সে এই কাজ করতে চায় না। সে মিয়ানমারে ফিরতে চায়, যেখানে তার জমি আছে, সম্পদ আছে। সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা ইয়াবা পরিবহনকারীর ভাষ্যে উঠে এসেছে কুতুপালং থেকে কক্সবাজারে ইয়াবা পরিবহনের তথ্য: সে কীভাবে ইয়াবা জুতায় ভরে পাহাড়ি পথ ধরে কক্সবাজার যায়, কোথায় চালান হস্তান্তর করে, কীভাবে আশ্রয় শিবিরের নিরাপত্তা কর্মীদের ফাঁকি দিতে কৌশল অবলম্বন করে ইত্যাদি। রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির

যেসব মাদকের ব্যবহার বাংলাদেশে মহামারির আকার ধারণ করেছে তাদের মধ্যে এখন প্রধান আন্তর্জাতিকভাবে ‘মেথ পিল’ নামে  পরিচিত ইয়াবা। থাইল্যান্ডে ‘ক্রেজি মেডিসিন’ আখ্যা পাওয়া ইয়াবা প্রবল আসক্তিমূলক একটি দ্রব্য যা মেথাফেটামিন এবং ক্যাফেইনের সমন্বয়ে বানানো হয়। ট্যাবলেটগুলোতে চকলেটের মতো রঙ ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিয়ানমারে উৎপাদিত হওয়া এই মাদকের পাচার রুখতে হিমশিম খাচ্ছে। এদিকে মাদক ব্যবসায়ীরা  ইয়াবা পরিবহনে  বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে।

বাংলাদেশ মনে করে, মিয়ানমারে অন্তত ৫০টি ইয়াবা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে। কক্সবাজার জেলায় কর্মরত সহকারী পুলিশ কমিশনার সাইফুল হাসান আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা যখন পালিয়ে আসা শুরু করেছিল তখন আমরা তাদের খুব একটা চেক করতাম না। প্রথম দিকে ওই সুবিধা পাওয়ার কারণে বেশ কিছু দিন ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকেছে।’ ইয়াবা পাচারের বিষয়ে কিছু এনজিওর পুলিশকে তথ্য দেওয়ার উদাহরণ থাকলেও সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, ইয়াবা ব্যবসায়ীরা কতিপয় এনজিওর নাম ব্যবহার করেও অপতৎপরতা চালায়। ইয়াবা পাচারের সূত্রে ৬০০ রোহিঙ্গাকে এ পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০ থেকে ৫০ পিস ইয়াবার জন্য তাদের দেওয়া হয়েছে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড। ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ইয়াবা আসক্তের সংখ্যা ৪৬ লাখ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর জানিয়েছে, ছয় বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৭ গুণ।

কিন্তু কেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে জড়িত হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন ইয়াবা পাচারকারী আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমি বেঁচে থাকার অন্য কোনও পথ না পেয়ে ইয়াবা পাচার করি। আমাকে আমার পরিবারের ভরণপোষণের জন্য এ কাজ করতে হয়। অর্থের অভাবে আমার পক্ষে সৎভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব হচ্ছে না।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ইয়াবা পাচারকারী রোহিঙ্গার পূর্ণ নাম প্রকাশ না করে আল জাজিরা তাকে ‘এ’ হিসেবে সম্বোধন করেছে। এই প্রতিবেদনে তাকে ‘আলতাফ’ ছদ্মনামে সম্বোধন করা হবে।

গত বছর বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ ইয়াবা পাচারের দায়ে ৬৪৯ জনকে গ্রেফতার করেছে যার মধ্যে ১৫ জন মিয়ানমারের নাগরিক। কিন্তু আলতাফ এখন পর্যন্ত ধরা পড়েনি। ৩৬ বছর বয়সী আলতাফ এক হাজার পিস ইয়াবা কুতুপালং আশ্রয় শিবির থেকে কক্সবাজারে পরিবহনের জন্য পাঁচ হাজার টাকা পায়। ইয়াবা প্পরিবহনের কাজে কীভাবে জড়িয়ে পড়েছিল আলতাফ? মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে সে কুতুপালং শিবিরে আশ্রয় নিতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন সেখানে ঠাঁই হয়নি তার ও তার পরিবারের; তখন বাধ্য হয়ে স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়। পরে যখন সে কুতুপালং আশ্রয় শিবিরে পরিবারসমেত গিয়ে ওঠে, তখন দেখে সেখানে পানি ও থাকার মতো ঘরের প্রচণ্ড সংকট। খাবার অপ্রতুল; দিনে একবেলা খাওয়ার মতো। হাতে কোন অর্থও ছিল না, ছিল না বিক্রি করে অর্থ পাওয়ার মতো কিছু।

প্রথমে আলতাফ একটি ছোট দোকান খুলতে চেয়েছিল। কিন্তু কেউ তাকে ঋণ দিতে রাজি না হওয়ায় সে দোকান দিতে পারেনি। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে শিবিরে থাকা ইয়াবা চক্রের সঙ্গে দেখা করে সে। সেখানেই আলতাফ জানতে পারে কীভাবে ইয়াবা তৈরি হয়, পাচার হয়, খাওয়া হয় এবং বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ইয়াবার উৎপাদন খরচ খুব কম কিন্তু বিক্রি করে লাভ বেশি।

আলতাফ নিশ্চিত করেছেন, মিয়ানমারের কিছু নাগরিক বিশেষ করে বাংলাভাষী নাগরিক টেকনাফ দিয়ে মিয়ানমারে প্রবেশ করে এবং মিয়ানমার থেকে ইয়াবা নিয়ে আবার বাংলাদেশে ঢোকে। তারপর সেগুলো দেওয়া হয় মাদক পরিবহনকারীদের হাতে। তাদের মাধ্যমে ইয়াবা ছড়িয়ে পড়ে পুরো বাংলাদেশ জুড়ে। বিষয়টি কেমনভাবে হয় তা দেখার জন্য আলতাফ এ বছরের শুরুতে পাচারকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়। তার সঙ্গে ২০ জনেরও বেশি পাচারকারী ছিল। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমরা জানতাম কোন কোন চৌকিতে পুলিশ তল্লাশি করে। সুতরাং আমরা এক সঙ্গে না গিয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে রওনা হয়েছিলাম। কেউ হেঁটে,, কেউ মোটরসাইকেলে, কেউ বা বাইসাইকেলে চড়ে মিয়ানমার সীমান্তের দিকে গিয়েছিলাম আমরা। মাইক্রোবাস বা অটোরিকশায় গেলে নিশ্চিতভাবে তল্লাশি চালানো হতো।’

আলতাফের ভাষ্য, ইয়াবা পরিবহনের যে কাজে সে জড়িত, তা কোনও নিয়মিত কাজ নয়। কখনও সপ্তাহে এক বার কখনও ১৫ দিনে একবার বা কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি সময় পর পর সে চালান নিয়ে যায়। ব্যবসা চাঙ্গা থাকলে মাসে আট থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। এসব টাকা খরচ হয়ে যায় ঋণ পরিশোধ, মুদি দোকানের বাকি পরিশোধ এবং চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহে।

কুতুপালং আশ্রয় শিবির থেকে কক্সবাজারে কীভাবে ইয়াবা পরিবহন হয় তার বর্ণনা দিয়েছে আলতাফ: প্রথমে পাচারকারীদের কেউ একজন আমার ঘরে বা ক্যম্পের ভেতরের দিকের কোনও এলাকায় ইয়াবার চালান হস্তান্তর করে। কোনও কোনও চালানে ১০০/২০০ পিস ইয়াবা থাকে। কোন কোনও চালানে সর্বোচ্চ এক হাজার পিস ইয়াবাও থাকে। এক হাজার পিসের মতো বড় চালান হলে কখনও জুতার মধ্যে আর কখনও পলিথিনে মুড়িয়ে বেল্টের নিচে করে পরিবহন করি। আর চালান ছোট হলে কাগজে মুড়িয়ে হাতে করেই নিয়ে যাই। হাতে ইয়াবার প্যাকেটটি রেখে তার ওপর মোবাইল ফোন রাখলে কেউ টের পায় না যে অন্য কিছু নিয়ে যাচ্ছি।

ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার চেয়ে ফিরে আসা সহজ। কারণ সন্ধ্যার পরে শিবির থেকে বের হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সন্ধ্যার পর কাউকে শিবিরের বাইরে যেত দেখলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর ফলে আলতাফের জন্য কাজটি আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমি যখন ইয়াবা নিয়ে যাই, তখন মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ব্যবহার করি না; পাহাড়ি পথ ধরে যাই। এরপর কক্সবাজার পৌঁছানো খুব সহজ। আমি শুনেছি ইয়াবা পরিবহনকারীদের অনেকে ধরা পড়েছে। কারণ তারা ঠিক মতো বাংলা বলতে পারে না। কিন্তু আমি সবসময়ই বেঁচে গেছি। কক্সবাজার পৌঁছে পূর্বনির্ধারিত স্থানে ইয়াবা হস্তান্তর করি আমি। সাধারণত বিমানবন্দর এলাকার কাছে অবস্থিত বাহারছড়া ও ফিশারি ঘাটে চালানটি বুঝিয়ে দেই।

কাজ শেষে টেকনাফ থেকে বাসে করে সে ফেরত যায় কুতুপালংয়ে। শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের প্রশ্নের মুখে পড়লে যাতে জাবাব দিতে পারে সেজন্য অলআলতাফ তার সঙ্গে কিছু জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যায়। দেরিতে শিবিরে ফেরা সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আলতাফের ভাষ্য, ‘সঙ্গে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে গেলে আমি বলতে পারি, আমার কিছু জরুরি জিনিসপত্র কেনার দরকার ছিল।’

আল জাজিরা লিখেছে, আশ্রয় শিবিরে চারশ থেকে পাঁচশ ইয়াবা পরিবহনকারী আছে। কিন্তু তারা নিজেরাও নিজেদের সবাইকে চেনা না। নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে মাদক ব্যবসায়ীরা এই ব্যবস্থা করেছে। আলতাফের ভাষ্য, ‘আমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত নই। যদি হতাম, তাহলে পুলিশের নজর পড়ত আমাদের ওপর এবং তারা খুব সহজকেই চিহ্নিত করে আমাদের গ্রেফতার করতে পারত।’

নিরাপত্তা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানের বিষয়ে আলতাফের ভাষ্য, ‘আমি বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার বিষয়ে শুনেছি। জেলে যাওয়ার বিষয়েও আমি জানি। ভীতি আমাদের সবার মনেই আছে। কিন্তু আমি কি করতে পারি? আমার যদি টাকা থাকত তাহলে আমি এই কাজ করতাম না।’

মিয়ানমারের ফিরে যেতে ইচ্ছুক আলতাফ বলেছে, ‘প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা হলে আমি মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। এখানে আমরা আটকে পড়েছি। মিয়ানমারে আমাদের জমি আছে, সম্পদ আছে। আমরা সেখানে কৃষিকাজ করতে পারব। এখানে তো একটা মুরগিও পালন করা যায় না।’

/এএমএ/
সম্পর্কিত
মিয়ানমারের ২৮৫ জন সেনা ফেরত যাবে, ফিরবে ১৫০ জন বাংলাদেশি
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা
আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় চীন ও ইন্দোনেশিয়া
সর্বশেষ খবর
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
ভাগ্নিকে শায়েস্তা করতে নাতিকে হত্যা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
৫ বছর বন্ধ সুন্দরবন টেক্সটাইল, সংকটে শ্রমিকরা
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া