যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সময় তেলের সরবরাহ ঠিক রাখার জন্য চীনা ক্রেতারা তাদের কার্গোগুলো ন্যাশনাল ইরানিয়ান ট্যাংকার কোম্পানি-এনআইটিসি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেছে। এসব কার্গোতে করে তেল নিয়ে চীনে পৌঁছে দেবে ইরান। এই পদক্ষেপে বোঝা যাচ্ছে, নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের অপরিশোধিত তেল আমদানি অব্যাহত রাখতে চায় চীন। এজন্য নতুন চুক্তিও করেছে দেশ দুটি। চুক্তি অনুযায়ী, তেল পৌঁছানোর খরচসহ যেকোনও ঝুঁকির দায় নেবে ইরান। গত মে মাসে ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি থেকে বের হয়ে আসার পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে যাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তেল রফতানি অব্যাহত রাখতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে চীন ও ইরান।
বেইজিংয়ের সঙ্গে তেহরানের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। জ্বালানি খাতে এই সম্পর্ক বিশেষভাবে গভীর। পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন ইরানের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া কোম্পানিগুলোও যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হবে। ওই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় চলতি মাসের শুরুতে জেসিপিওএ-তে স্বাক্ষরকারী অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়ে দেয়, তেহরানের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক প্রকাশ্য, স্বচ্ছ ও বৈধ।
যুক্তরাষ্ট্র গত ৭ আগস্ট থেকে ইরানের ওপর প্রথম পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে। এতে ইরান ও দেশটির সঙ্গে ব্যবসা করা যেকোনও প্রতিষ্ঠান দেশকে মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বাদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আগামী নভেম্বর থেকে ইরানের তেল রফতানির উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে দেশটি। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপভিত্তিক বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো ইরান থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া শুরু করেছে। তবে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এশিয়ার সবচেয়ে তেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ঝুহাই ঝেনরং করপোরেশন ও সিনোপিক গ্রুপ তাদের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য এনআইটিসি’র সঙ্গে একটি দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি কার্যকর করেছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট চারটি সূত্র ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স’কে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
বাণিজ্যিক চুক্তি বিষয়ে জনসম্মুখে বলার দায়িত্ব না থাকায় তারা নাম প্রকাশ করতে চায়নি। সূত্রগুলো জানায়, দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির আওতায় তেলের দামও পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী অপরিশোধিত তেলের সরবরাহ খরচ ও সব ঝুঁকি বহন করবে ইরান। এর মধ্যে তেলের বীমার বিষয়টিও অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। সূত্রগুলোর একজন বেইজিংভিত্তিক তেল নির্বাহী । তিনি বলেন, ‘খুব সম্প্রতি এই পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আর দুইপক্ষ প্রায় একই সঙ্গে এই পদক্ষেপের বিষয়ে আহ্বান জানিয়েছে।’
রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে তেল বহনের জন্য ব্যবহৃত ১৭টি জাহাজ পরিচালনা করেছে ইরানের জাতীয় ট্যাংকার কোম্পানি। জুন মাসে ১৯টি জাহাজের মধ্যে ৮টি পরিচালনার দায়িত্ব ছিল চীনের। গত মাসে ওই ট্যাংকারগুলোতে ইরান থেকে প্রায় ২ কোটি ৩৮ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল নিয়ে চীনে রফতানি করা হয়। প্রতিদিন প্রায় ৭ লাখ ৬৭ হাজার ব্যারেল তেল পাঠানো হয় দেশটিতে। আর জুন মাসে পাঠানো হয় এক কোটি ৯৮ লাখ ব্যারেল তেল। ২০১৭ সালে চীন ইরান থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬ লাখ ২৩ হাজার ব্যারেল তেল আমদানি করেছে।
ট্যাংকার হস্তান্তরের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে নাকচ করে দিয়েছে চীনের তেল আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিনোপিক। এছাড়া ন্যাম কোয়ং গ্রুপের একজন মুখপাত্রও এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। এনআইটিসি’র কাছ জানতে চাইলে তারা ইরানের সংস্কৃতি ও ইসলামি নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়টার্সের অনুরোধ পৌঁছে দেবে বলে জানিয়েছে।
২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বীমা সুবিধা কার্যকর না থাকায় ইরান এই ব্যবস্থা চালু করেছিল। তবে চীনের তেল সরবরাহ বাবদ প্রায় দেড়শ কোটি মার্কিন ডলারের বীমা সুবিধা ইরান কিভাবে দেবে তা জানা যায়নি। বীমার মাধ্যমে সাধারণত তেলের কার্গোর নিরাপত্তা ও দূষণের বিষয়ে তৃতীয় পক্ষ দায়িত্ব নেয়। চীনের আরেকজন তেল নির্বাহী রয়টার্সকে বলেন, কোম্পানিগুলো এবারই প্রথম এই ব্যবস্থা নেয়নি। যখন দরকার পড়েছে ক্রেতারা তার ব্যবহার করতে পেরেছে।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের শুরুতে ট্রাম্প জেসিপিওএ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নেওয়ার ঘোষণা দেন। চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য বিশ্বশক্তিগুলো এই ঘোষণা থেকে সরে আসার আহ্বান জানালেও তাতে সায় দেননি ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ছাড়াও ইরানের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ওই চুক্তির অন্য স্বাক্ষরকারী দেশের মধ্যে রয়েছে ইউরোপে ওয়াশিংটনের প্রধান মিত্র যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং রাশিয়া। চুক্তি থেকে বের হওয়ার পর ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।