সৌদি আরবের নির্বাসিত সাংবাদিক জামাল খাশোগির অন্তর্ধানের রহস্য দুই সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও উন্মোচিত হয়নি। সৌদি আরব, তুরস্ক এবং সৌদি আরবের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে খাশোগির পরিণতি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কিছু বলা হয়নি। এতদিন পরও ঘটনাটি সম্পর্কে সত্য উন্মোচন না হওয়ায় আশঙ্কা জাগছে তিনটি দেশের সদিচ্ছা নিয়ে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তিন দেশের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে ধারণা হচ্ছে, কোনও দেশই খাশোগির সম্পর্কে সত্য প্রকাশে আগ্রহী নয়।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র এক বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সৌদি আরবের নাগরিক খাশোগির পরিণতি যাই ঘটেছে কিংবা অলৌকিকভাবে যদি দুবাইয়ের কোনও হোটেলে দৃশ্যমান হয়ে ওঠলেও তিনি যে বড় ধরনের দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে গেছেন তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর সবচেয়ে খারাপ যা হতে পারে তা হচ্ছে সৌদি আরবের প্রভাবশালী যুবরাজের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কূটনৈতিক দায়মুক্তিকে ব্যবহার করে এই সাংবাদিককে বিদেশের মাটিতে কেটে টুকরো টুকরো ফেলেছে।
সিএনএন বলছে, যদি তাকে এভাবে হত্যা করার অভিযোগ সঠিক হয়ে থাকে তাহলে তা প্রভাবশালী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ডি ফ্যাক্টো সৌদি প্রশাসনের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। তারা এটাকে ছোট ঘটনা হিসেবে তুলে ধরে পার পেয়ে গেলেও আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
সৌদি আরব বিশ্বকে এমন ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে যে খাশোগির মতো গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ দুর্বৃত্তদের ধাক্কায় বাস চাপায় নিহত হতে পারেন। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ নিজেদেরকে খাশোগির নিখোঁজের ঘটনা থেকে মুক্ত করতে পারছে না। প্রতিদিন পরিস্থিতি তাদের জন্য আরও খারাপ হচ্ছে। রিয়াদের এখনকার কৌশল হচ্ছে বিশ্বে বড় কোনও ঘটনার অপেক্ষায় থাকা। যাতে সংবাদমাধ্যম ও মানুষের নজর অন্য দিকে চলে যায়। ফলে সময় যতো গড়াবে খাশোগি ইস্যু তাদের জন্য আরও বড় হয়ে দেখা দেবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও খাশোগি ইস্যুতে সৌদি আরব সফর শেষে তুরস্ক যাওয়ার আগে তুরস্কের সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমে একটি রেকর্ড করা কথোপকথনের কথা প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, এর মধ্য দিয়ে খাশোগির পরিণতির বিষয়ে স্পষ্ট করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে আঙ্কারা। ট্রাম্প প্রশাসন ও সৌদি কর্মকর্তারা খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় তদন্তের বিষয়ে একমত হওয়ার একদিন পরেই ওই কথোপকথন ফাঁস হলো।
এমন সময় এই অডিও ফাঁস হলো যখন সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চাচ্ছিলো। কিন্তু ফাঁস হওয়া কথোপকথনে ঘটনাটির নৃশংস বর্ণনায় আন্তর্জাতিক সমালোচনা বেড়েছে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে। অগণিত হত্যা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যে সমালোচনা ছিল সেগুলো তীব্রতর হয়েছে এবারের ঘটনার পর।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের ফাঁস করা কথোপকথন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, হয়তো তুর্কি কর্তৃপক্ষের কাছে থাকতে পারে। আমি নিশ্চিত নই যে এটা আছে, হয়তো আছে, সম্ভবত আছে। পম্পেও ফিরলে বিস্তারিত জানতে পারব।
আর সৌদি আরব থেকে তুরস্কের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে পম্পেও বলেছেন, তিনি এসব ফ্যাক্ট নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। তিনি সৌদি ও তুর্কি তদন্তের প্রতি আস্থা রাখার কথা জানিয়েছেন। বারবার দাবি করেছেন, ট্রাম্প প্রশাসন তদন্ত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না।
ট্রাম্প ও পম্পেও উভয়ই সৌদি আরবের হয়ে ঘটনাটি আড়াল করার চেষ্টার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
সিএনএন লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উন্নত প্রযুক্তি ও ন্যাটো মিত্র তুরস্কের সহযোগিতায় ঘটনাটি সম্পর্কে মার্কিন প্রশাসন একেবারে কিছুই জানে না তা বিশ্বাস করা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন সৌদি আরবের অস্বীকৃতির পুনরাবৃত্তি করছে তখন সৌদি রাজ পরিবারের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের মিত্রতার বিষয়টি নেতিবাচক হিসেবে সামনে আসছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের পৃথক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, খাশোগি নিখোঁজের ঘটনায় সৌদি যুবরাজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সন্দেহ জোরদার হচ্ছে। যদিও তারা এখনও নিশ্চিত প্রমাণ পাননি।
আর বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিককে কারাগারে পাঠানো তুরস্ক খাশোগির নিখোঁজের ঘটনায় সবচেয়ে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু তারা সৎ বিচারকের ভূমিকা নেইনি, তারা যে কৌশল অবলম্বন করছে তা রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানীর।
ধীরগতির তদন্ত এবং সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রমাণ ফাঁসের ঘটনাগুলো সৌদি যুবরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ জোরালো করেছে। তুর্কি কর্মকর্তারা তাদের কাছে থাকা তথ্য-প্রমাণ ব্যবহার করে সৌদি আরবের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাখ্যা দাবি করছেন।
তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা এমআইটি অত্যন্ত দক্ষ বলে পরিচিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাশোগি নিখোঁজের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাসপোর্ট, সিসিটিভি ফুটেজ ও কথোপকথন হাতে পেয়েছে তুর্কি গোয়েন্দারা। কিন্তু তারা শুরুতেই সব কিছু প্রকাশ করেনি এবং চুপ থেকেছে। সরকারি দলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা এক ব্যক্তি তাদের মাটিতেই নিখোঁজ হলেও তারা মামলাটির তদন্ত এগিয়েছে ধীর গতিতে।
তুর্কি কর্মকর্তারা নিজেরা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে না জানালেও বিভিন্ন তথ্য ও প্রমাণ ফাঁস করছেন সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যমে। এতে করে তারা প্রশ্নের মুখে পড়ছেন না এবং খাশোগি ইস্যুটি বিশ্বের নজর থেকে হারিয়ে যাচ্ছে না।
তুরস্ক যে কৌশল নিয়েছে তাতে করে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে তারা একা যেতে চাইছে না। তারা চাইছে যুক্তরাষ্ট্রই চাপ প্রয়োগ করুক সৌদি আরবের ওপর। একই সঙ্গে সৌদি আরবের বিরোধিতা করাও ছাড়ছে না আঙ্কারা। কিন্তু তা আবার যেন বিরোধে রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখছে।
সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, দেশীয় তথ্য সংগ্রহে তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থাকে তারা দক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেন। তারা জানান, সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে যদি তুর্কি গোয়েন্দারা আড়ি পেতে নজরদারি চালায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নাই। কিন্তু তুর্কি সংবাদমাধ্যমকে আস্থার জায়গায় নিতে রাজি নন তারা। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম হয় সরকার পরিচালিত নতুবা সরকার সমর্থক ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন। ফলে সংবাদ প্রকাশে কড়া সেন্সরশিপ রয়েছে। সাংবাদিক ও রিপোর্টাররা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের নির্দেশনা নিয়মিত পান ও তা মেনে চলেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, সরকার সমর্থক সংবাদমাধ্যম অনেক সময় ভুল তথ্য প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর এই ইস্যুতে সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনও কিছু প্রকাশ করার সম্ভাবনা নেই। ফলে তুর্কি সংবাদমাধ্যমে তদন্তের যেসব তথ্য ফাঁস হচ্ছে সেগুলোর নেপথ্যে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান বা প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের ভূমিকা রয়েছে।
৬ অক্টোবর খাশোগির নিখোঁজ নিয়ে তথ্য-প্রমাণ এরদোয়ানকে অবহিত করা হয় বলে জানিয়েছেন তুর্কি কর্মকর্তারা। কিন্তু যখন ইস্যুটি নিয়ে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরালো হয় তখনি সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন প্রমাণ ফাঁস শুরু হয়। এর মধ্যেই সৌদি বাদশাহ কথা বলেছেন এরদোয়ানের সঙ্গে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইঙ্গিত দিয়েছেন বিষয়টি তিনি গুরত্ব সহকারে নিচ্ছেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সৌদি আরব পাঠিয়েছেন। এছাড়া রাজ কার্যে নিয়োজিত কর্মকর্তা-যারা সৌদি পরিকল্পনার বিষয়ে জানেন, তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন খাশোগিকে হত্যার কথা স্বীকার করতে পারে সৌদি আরব। কিন্তু বুধবারের (১৭ অক্টোবর) ফাঁসের ঘটনায় সৌদি আরবের প্রতি তুরস্কের হতাশা প্রকাশ পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তুরস্ক মনে করছে, সৌদি আরব এখনও প্রকাশ্যে কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্রও এ বিষয়ে ত্বরিৎ কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
খাশোগির নিখোঁজ রহস্য বা হত্যা নিয়ে তিন দেশের এই রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কৌশলের মুখে ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ঘটনাটির সত্য উদঘাটন হওয়ার পর কারা সবচেয়ে বেশি কপট আচরণ করেছে? খাশোগির খুনিরা? নিজেদের সুবিধায় যারা তদন্তকে কাজে লাগিয়েছে তারা? অথবা তথ্য-প্রমাণ নিয়ে কথা বলতে নারাজ খুনিদের সেই সহযোগী, যারা মিত্রের বিরুদ্ধে যেতে চায় না?