জামাল খাশোগির অন্তর্ধান ও সম্ভাব্য হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে তুরস্কের সংবাদমাধ্যম মোট ১৫ জনের ছবি প্রকাশ করেছে। খাশোগি ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেটে ঢোকার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তারা সৌদি আরব থেকে তুরস্কে পৌঁছান। আর তুরস্ক ত্যাগ করেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই। আসা-যাওয়ার জন্য তারা বাণিজ্যিক বিমান ছাড়াও ব্যবহার করেন দুইটি ব্যক্তিগত বিমান। সংশ্লিষ্ট সন্দেহভাজনদের মধ্যে রয়েছেন সৌদি আরবের লেফটেন্যান্ট, মেজর থেকে শুরু করে কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তারা। এরা মূলত সৌদি যুবরাজের নিরাপত্তা বাহিনী ও দেশটির গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মরত। তবে বিমান বাহিনীর স্কোয়াড্রন লিডার ও ফরেনসিক প্যাথোলজিস্টও রয়েছেন সন্দেহভাজনদের তালিকায়। বিবিসি জানিয়েছে, নিজস্ব অনুসন্ধান ছাড়াও সংবাদপত্রগুলো এসব সন্দেহভাজনের পরিচয় জানতে সহায়তা নিয়েছে মেনোএমথ্রিএ নামের একটি অ্যাপের। আরবিভাষীদের কাছে জনপ্রিয় এই অ্যাপে ফোন নম্বর, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম ও ছবি দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
জামাল আহমেদ খাশোগি সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রবল সমালোচক। রাজনৈতিক এ ভাষ্যকার মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা নিবন্ধে সৌদি জোটের কাতারবিরোধী অবরোধের কঠোর সমালোচনা করেন। মানবাধিকার প্রসঙ্গে সমালোচনা করা কানাডার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ায় সৌদি আরবের সমালোচনায় কলম ধরেছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যম ডেইলি সাবাহ জানিয়েছে, তিনি মোহাম্মদ খালেদ খাশোগির দৌহিত্র। খালেদ খাশোগি দেশটির সাবেক বাদশাহ আব্দুল আজিজ আল সৌদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। গত ২ অক্টোবর দুপুরে তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন খাশোগি। এরপর থেকে আর তাকে দেখা যায়নি। তুরস্কের তদন্তকারীরা বলছেন, সৌদি আরবের ১৫ জন এজেন্ট কনস্যুলেটের ভেতরেই খাশোগিকে হত্যা করেছে । তুর্কি-আরব মিডিয়া এসোসিয়েশনের প্রধান তুরান কিসলাকসি একটি সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেছেন, খাশোগিকে হত্যা করে তার লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলা হয়েছে। সন্দেহভাজনদের নাম-পরিচয়:
সালাহ মুহাম্মেদ এ তুবাইগি (৪৭): ড. তুবাইগি একজন ফরেনসিক প্যাথোলজিস্ট। তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ২০১৫ সালে তিন মাসের জন্য অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ান ইন্সটিটিউট অব ফরেনসিক মেডিসিনে ছিলেন। টুইটারে তিনি ‘ফরেনসিক মেডিসিনের প্রফেসর’ এবং সৌদি আরবের ‘সাইন্টিফিক কাউন্সিল অব ফরেনসিকের’ প্রধান হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন । তার অ্যাকাউন্টে লিংক রয়েছে সৌদি আরবের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। ২০১৪ সালে লন্ডনভিত্তিক আরবি সংবাদমাধ্যম আশরাক আল আওসাত লিখেছিল, ড. তুবাইগি সৌদি সেনাবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট। তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘জেনারেল ডিরেক্টরেট অব পাবলিক সিকিউরিটি’ বিভাগের অধীনে ন্যস্ত ফরেনসিক সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে কর্মরত ছিলেন। ড. তুবাইগি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি এমন একটি মোবাইল ল্যাবরেটরি আবিষ্কার করেছেন যা ব্যবহার করে মাত্র সাত মিনিটে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা যায়। এতে করে হজ্জের সময় মৃত্যুবরণ করা হাজিদের ময়নাতদন্ত দ্রুত সম্পন্ন করা যাবে।
তুবাইগি তুরস্কে যাওয়ার সময় নিজের সঙ্গে একটি হাড় কাটার করাত নিয়ে বিমানে উঠেছিলেন। তুর্কি কর্মকর্তাদের ধারণা, খাশোগির অ্যাপেল ওয়াচের মাধ্যমে রেকর্ড হয়ে যাওয়া কথাবার্তায় তুবাগির কণ্ঠস্বর রয়েছে।। দূতাবাসে ওই রেকর্ডিং চলার সময় খাশোগিকে নির্যাতন করা হচ্ছিল। রেকর্ডিংয়ের এক স্থানে ‘ডক্টরকে’ বাকিদের বলতে শোনা গেছে, যতক্ষণে শরীর পিস পিস করা হবে ততক্ষণ বাকিরা হেডফোনে গান শুনতে পারে।
মাহের আব্দুল আজিজ এম মুতরেব (৪৭): মুতরেব লন্ডনে অবস্থিত সৌদি দূতাবাসে দুই বছর নিযুক্ত ছিলেন। ২০০৭ সালে প্রকাশিত একটি ব্রিটিশ নথিতেও সৌদি দূতাবাসের ‘ফার্স্ট সেক্রেটারি’ হিসেবে রয়েছে তার নাম। সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে লন্ডনের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, মুতরেব সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্নেল। এদিকে মোবাইলফোনের নম্বর ও নামের সঙ্গে কোন ছবি যুক্ত করা রয়েছে তা দেখতে দেওয়া অ্যাপ মেনোএমথ্রিএতে দেখা গেছে মুতরেবের নাম ‘রয়েল কোর্টের’ কর্নেল হিসেবে সেভ করা হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত মুতরেব দেহরক্ষী হিসেবে অন্তত তিনবার সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে সফর করেছেন। তুরস্কের সরকার সমর্থিত সংবাদপত্র সাবাহর প্রকাশিত সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, মুতরেব ইস্তানবুল অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে গত ২ অক্টোবর ৯টা ৫৫ মিনিটে প্রবেশ করেছে। এর তিন ঘণ্টা পরে জামাল খাশোগি সেখানে প্রবেশ করেন।
আব্দুলআজিজ মোহাম্মেদ এম আলহাওয়াস্বী (৩১): নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, আলহাওয়াস্বী ফরাসি ‘পেশাদার ব্যক্তি।’ সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে কাজ করার রেকর্ড আছে তার। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দেহরক্ষীর দায়িত্বও পালন করতে দেখা গেছে তাকে। মেনোএমথ্রিএতেও একই নামের একজনের ছবি সেভ করা রয়েছে যিনি ‘সৌদি রয়্যাল গার্ড রেজিমেন্টের’ সদস্য।
থার গালিব টি আলহারবি (৩৯): গত অক্টোবর মাসে সৌদি আরবের রয়্যাল গার্ডে কর্মরত একই নামের একজন ব্যক্তিকে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। ওই ব্যক্তি জেদ্দায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের প্রাণ রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখার পুরষ্কার হিসেবে পদন্নোতি লাভ করেন। হামলার ঘটনায় একজন বন্দুকধারী সৌদি রয়্যাল গার্ডের দুই জন সদস্যকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় আহত হয় তিন জন।
মোহাম্মেদ সাদ এইচ আলজাহরানি (৩০): মেনোএমথ্রিএ অ্যাপে এই নামের একজন ব্যক্তির ফোন নম্বর সৌদি রয়্যাল গার্ডের সদস্যের নম্বর হিসেবে সেভ করা রয়েছে। অধিকারকর্মী লিয়াদ এল বাগদাদি জানিয়েছেন, ২০০৭ সালের একটি অনুষ্ঠানে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দেহরক্ষী হিসেবে তাকে দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। সেসময় তার পরনে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাজও যুক্ত ছিল। যুবরাজের সঙ্গে তার ছবিও রয়েছে। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন করার পর যে ব্যক্তি ফোন ধরেছিলেন, তিনি খাশোগির অন্তর্ধানের সময়ে তুরস্কে থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।
খালিদ আয়েদ জি আলওতাইবি (৩০): ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, এই নামের একজন সৌদি পাসপোর্টধারী সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের অন্তত তিনটি সফরের সময় যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছে।
নাইফ হাসান এস আলআরিফি (৩২): ফেসবুকে এই নামে থাকা একটি অ্যাকাউন্টে ইউনিফরম পরা একজন ব্যক্তির ছবি রয়েছে। তার পোশাকে সৌদি বিশেষ বাহিনীর মনোগ্রাম যুক্ত রয়েছে। খাশোগির সহযোগী হিসেবে পরিচয় দেওয়া সৌদি বংশোদ্ভূত সিরীয় উদ্যোক্তা কাতাইবি ইদলিবি জানিয়েছেন, আলআরিফির নামও সংশ্লিষ্ট অ্যাপটিতে যুবরাজের কার্যালয়ের কর্মরত ব্যক্তির হিসেবে তালিকাভুক্ত রয়েছে।
মুস্তাফা মোহাম্মেদ এম আলমাদানি (৫৭): মোবাইল অ্যাপ মেনোএমথ্রিএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী আলমাদানি সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থায় কর্মকর্তা।
মেশাল সাদ এম আলবোস্তানি (৩১): সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এই নামে অ্যাকাউন্ট থাকা এক ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের বিমান বাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ইদিলিবি জানিয়েছন, মেনোএমথ্রিএ অ্যাপে মেশাল সাদ এম আলবোস্তানি সৌদি র্যায়ল গার্ডের একজন সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত। ১৮ অক্টোবর সরকার সমর্থক তুর্কি সংবাদপত্র ইয়েনি সাফাক এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আলবোস্তানি সৌদি আরবের রিয়াদে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন।
ওয়ালিদ আব্দুল্লাহ এম আলশেরি (৩৮): এই নামের একজন ব্যক্তি সৌদি আরবের বিমান বাহিনীতে কর্মরত। গত বছর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান তাকে স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছিলেন।
মনসুর উসমান এম আবাহুসেইন (৪৬): ইদলিবি জানিয়েছেন, মেনোএমথ্রিএ অ্যাপে এই নামের একজন ব্যক্তির তথ্য আছে যিনি সৌদি গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করেন। ২০১৪ সালে সৌদি আরবের স্থানীয় একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ওই নামের একজন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, তিনি ‘জেনারেল ডিরেক্টরেট অব সিভিল ডিফেন্সের’ কর্নেল।
ফাহাদ শাবিব এ আলবালাদি (৩৩): মেনোএমথ্রিএ অ্যাপে এই নামের একজন ব্যক্তির তথ্য রয়েছে যিনি সৌদি আরবের রয়্যাল গার্ডের সদস্য।
বদর লাফি এম আলওতাইবি (৪৫): মেনোএমথ্রিএ অ্যাপে আলো তাইবিকে সৌদি আরবের গোয়েন্দা সংস্থার একজন মেজর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সাইফ সাদ কিউ আলকাতানি (৪৫): ওয়াশিংটন পোস্ট জানিয়েছে, এই নামের একজন ব্যক্তি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কার্যালয়ে কাজ করেন।
তুর্কি মুসেররেফ এম আলসেহরি (৩৬): এই ব্যক্তি এইচজেডএসকেটু বিমানে ইস্তানবুল পৌঁছান। মুভ এন পিকে অবস্থান করেছেন। ফিরে গেছেন এইচজেডএসকেওয়ান বিমানে।
সন্দেহভাজনরা মূলত দুটি হোটেলে উঠেছিলেন। এদের একই ইস্তানবুলের মুভ এন পিক এবং অপরটি উইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ড ইস্তানবুল লেভান্ট হোটেল। মুভ এন পিক সৌদি কনস্যুলেটের পশ্চিম দিকে অবস্থিত। আর উইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ড ইস্তানবুল লেভান্ট হোটেল সৌদি কনস্যুলেট থেকে ১ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। মুভ এন পিকে ছিলেন তুবাইগি, আলমাদানি, আলশেহরি, আলবালাদি ও বদর লাফি এম আলওতাইবি । উইন্ডহ্যাম গ্র্যান্ড ইস্তানবুল লেভান্ট হোটেলে ছিলেন আলহাওয়াস্বী, আলজাহরানি, আলআরিফি, খালিদ আয়েদ জি আলওতাইবি, আলবোস্তানি ও আবাহুসেইন।
কে কীভাবে তুরস্কে ঢুকেছিলেন এবং কীভাবে ফেরত গিয়েছেন সে বিষয়ে লিখতে গিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, বাণিজ্যিক বিমান ছাড়াও সন্দেহভাজনরা দুইটি ব্যক্তিগত বিমান ব্যবহার করেছেন। এগুলোর নম্বর এইচজেডএসকে ওয়ান এবং এইচজেডএসকে টু। এই বিমান দুইটি গত বছর সৌদি আরবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে জব্দ করা ‘স্কাই প্রাইম এভিয়েশন’ নামক প্রতিষ্ঠানের।