যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইচআরডব্লিউ অভিযোগ করেছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ‘নিবিড় ও অনধিকারমূলক’ নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে। শুক্রবার সংস্থাটির এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক, রাজনীতি-ভাষ্যকার আর টেলিভিশনের বিরুদ্ধে নতুন নতুন দমনমূলক আইন ও নীতি ব্যবহার করছে সরকার। মানবাধিকার সংস্থাটির আশঙ্কা, এতে মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হতে পারে।
আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এইচআরডব্লিউ বলছে, নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সামাজিক মাধ্যমের গুজব শনাক্তকরণে গঠিত সেল গঠন করেছে। সরকার দাবি করছে, এসব চেষ্টার লক্ষ্য হলো ক্ষতিকর গুজব, ভুয়া তথ্য এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আপত্তিকর বিষয়বস্তুর প্রকাশ ঠেকানো। তবে এইচআরডব্লিউ-এর বিবৃতিতে বিরোধী দলগুলো ও নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলা হয়েছে, এইসব পদক্ষেপ গোপনীয়তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান দমনপীড়ন নির্বাচনকালে ভিন্নমত ও সরকারের সমালোচনা সীমিত করারই এক চেষ্টা। যদিও এইচআরডব্লিউর এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, ‘বিরোধী ও সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ। নির্বাচনের আগে সরকারের এমন নজরদারিতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।’
বিবৃতিতে বাংলাদেশের ২ কোটি ৮০ লাখ ফেসবুক ব্যবহারকারীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম যখন ভিন্নমত প্রকাশ ও প্রতিবাদ সংঘটিত করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে, তখন কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্ম ও ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় সরকারের সমালোচনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করায় এরই মধ্যে লোকজনকে গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটেছে। এইচআরডব্লিউ অভিযোগ তুলেছে, সরকার অনলাইন যোগাযোগের ওপর নজরদারি জোরদার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। এসব বাহিনীর মধ্যে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র্যাব) রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সরকার ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘গুজব শনাক্ত’ করতে ৯ সদস্যের একটি পর্যবেক্ষণ সেল গঠন করার ঘোষণা দিয়েছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলেছেন, যেসব বিষয়বস্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হুমকিতে ফেলবে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে বা রাষ্ট্রকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে, সেসব গুজব হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং তা শোধন বা বন্ধের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছে পাঠানো হবে। তারানা হালিম দাবি করেন, এর উদ্দেশ্য বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণ করা নয়; বরং মানুষের ‘শুধু সঠিক তথ্য’ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা।
এইচআরডব্লিউ অভিযোগ করেছে, টেলিভিশন নেটওয়ার্কগুলো এরই মধ্যে সরকারের চাপের মধ্যে আছে। প্রস্তাবিত ‘জাতীয় সম্প্রচার আইন ২০১৮ ’-এ তারা আরও বেশি বিধিনিষেধের সম্মুখীন হবে। ১৫ অক্টোবর মন্ত্রিসভা এ আইনের খসড়া অনুমোদন করেছে। এই আইনে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনাবিরোধী’ বা ‘বিভ্রান্তিকর বা ভুয়া’ তথ্য সম্প্রচারের শাস্তি হিসেবে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনের পদক্ষেপ হিসেবে সম্প্রতি জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করার ঘটনাও তুলে ধরে এইচআরডব্লিউ। খ্যাতনামা আলোকচিত্রী শহিদুল আলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহিদুল ইসলাম ও ডা. জাফরুল্লাহর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের প্রশ্নও উঠে এসেছে ওই বিবৃতিতে।
