X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতে পারবেন সৌদি যুবরাজ?

মাহাদী হাসান
৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:০০আপডেট : ৩০ অক্টোবর ২০১৮, ১৭:০৯

খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের টার্গেটে পরিণত হয়েছেন বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। জোরালো হচ্ছে তাকে জবাবদিহিতার আওতায় নেওয়ার দাবি। তবে যুবরাজ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন ক্ষমতাধর, তেমনি তার প্রতি রয়েছে ট্রাম্প প্রশাসনের নীরব সমর্থন। এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে, তার পতন আসন্ন কিনা, তিনি আদতে সিংহাসনে বসতে পারবেন কি না, তার ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরা হবে কিনা । আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিচ্ছেন। কেউ বলছেন, ক্ষমতা হারাতে পারেন যুবরাজ। কারও দাবি , আদতে কিছুই হবে না বিন সালমানের। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আবার বলছেন পরবর্তী রাজা থাকলও রাজ্যে আগের মতো একক কর্তৃত্ব থাকবে না তার।  কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের আশঙ্কাও দেখছেন।

খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতে পারবেন সৌদি যুবরাজ?

আধুনিক সৌদি আরবের ইতিহাসে মাত্র দুইবারই বাদশার পতন হয়েছে। ১৯৬৪ সালে সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতার ছেলে বাদশা সাউদকে শান্তিপূর্ণভাবে অপসারণের পর সিংহাসনে বসেন বাদশা ফয়সাল। তাকে সরিয়ে ১১ বছর পর ফয়সাল নিজের ভাইয়ের ছেলের দ্বারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এর তিনমাস পর শিরোশ্ছেদ করা হয় তাকেও। সৌদি আরবের বর্তমান অঘোষিত ক্ষমতাসীন নেতা যুবরাজ সালমানকে নিয়েও এমন শঙ্কা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। মূলত সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতার কারণে এমন পরিস্থিতির তৈরি।

২ অক্টোবর ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশের পর নিখোঁজ হন সৌদি অনুসন্ধানী সাংবাদিক জামাল খাশোগি। সৌদি আরব খাশোগির নিখোঁজে ভূমিকার কথা বারবার অস্বীকার করে। তুরস্ক দাবি করে, কনস্যুলেটের ভেতরেই তাকে হত্যার পর কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার (১৯ অক্টোবর) মধ্যরাতে প্রথমবারের মতো সৌদি আরব সাংবাদিক জামাল খাশোগি নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করে। তবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে দেশটি। তবে একাধিক মার্কিন সিনেটরের দাবি, যুবরাজ তার সমালোচক ওই সাংবাদিকের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সৌদি রাজদরবারের একজন প্রিন্সও একই অভিযোগ তুলেছেন। বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে অসমর্থিত সূত্রে বলা হয়েছে, ওই হত্যাকাণ্ডে তার সংশ্লিষ্টতা আছে।

খাশোগি হত্যার নির্দেশ যিনি দিয়েছেন, তাকেও জবাবদিহির আওতায় আসতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান। এছাড়া অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র সৌদি আরবের বিরুদ্ধে শুরুতে নমনীয় থাকলেও এরইমধ্যে কঠোর অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছেন ট্রাম্প। মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো এ হত্যাকাণ্ডকে ইতিহাসের জঘন্যতম গুম বলে আখ্যা দেন তিনি। একই দিনে সৌদি যুবরাজের সম্ভাব্য সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে একমত হয়েছেন ট্রাম্প। মার্কিন কংগ্রেসের সিনেট বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির প্রধান সিনেটর বব কর্কার বলেন,‘আমার মনে হয়, তিনিই কাজটি করেছেন। আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সৌদি যুবরাজ অবশ্য সতর্ক হয়ে গেছেন। দেশে এবং বিদেশে সতর্কাবস্থান করছেন তিনি।  বক্তব্যের ক্ষেত্রেও সাবধান বেশ।  কিন্তু তার এই বক্তব্য কিংবা ১৮ জন সৌদি নাগরিককে গ্রেফতার করেই এই পরিস্থিতি শান্ত করা যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খাশোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেভাবে নড়েচড়ে বসেছে। ইতোমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সৌদি আরবের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। সৌদি আরবের পরম মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এই ইস্যুতে তাদের পাশে নেই। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট উভয় পক্ষই সৌদি আরবে রফতানি বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন।

খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতে পারবেন সৌদি যুবরাজ?

মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্কারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে বাদশা ফয়সালের হত্যার পর সেসময় রাজপরিবারর একমাত্র সদস্য হিসেবে হত্যাকারীর বিচার সরাসরি দেখেছিলেন তরুণ প্রিন্স সালমান।  আর সেই সালমান এখন বাদশা এবং তার ছেলে মোহাম্মদ পরবর্তী রাজা।  সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক পরিচালক প্রিন্স তুর্কি আল ফয়সাল মনে করছেন, ‘যারা ভাবছেন যে পরবর্তী সৌদি বাদশা পরিবর্তন হবে, কিংবা যুবরাজ তার অবস্থান হারাবেন। তারা ভুল ভাবছেন।’ যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও জানান, ‘যুবরাজের বিরুদ্ধে যত সমালোচনা হবে রাজ্যে তিনি তত জনপ্রিয় হবেন।

তিন বছর আগে সালমান বাদশা হওয়ার পর এখন পর্যন্ত দুইবার যুবরাজ পরিবর্তন করেছেন। সৌদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার সর্বশেষ উত্তরসূরী প্রিন্স মুকরিনের যুবরাজ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ২০১৫ সাল তাকে সরিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স নায়েফকে যুবরাজ ঘোষণা করা হয়। পরে ২০১৭ সালে আবারও নায়েফকে বাদ দিয়ে বিন সালমানকে যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশা।  নায়েফ এখনও গৃহবন্দি রয়েছেন।  সাবেক মার্কিন গোয়েন্দা কর্মকতা ব্রুস রিডেল মনে করছেন, ‘অনেক সিনিয়র প্রিন্সরাই এখন বাদশাহ বলছেন যেন বিন সালমানকে সরিয়ে অন্য কোনও প্রিন্সকে ‍যুবরাজ করা হয়।’ তবে কাগজে কলমে যুবরাজের অপসারণ সম্ভব হলেও খুব একটা সম্ভাবনা নেই। এতে করে বাদশাহকে নিজের প্রিয় ছেলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।  সিনেটর কর্কার বলেন, ‘তিনি হয়তো এটা করবেন না।

বাদশার বয়স আশি বছরেরও বেশি। কিছুটা ডিমেনশিয়া বা ভুলে যাওয়ার রোগেও আক্রান্ত তিনি। এজন্য বিন সালমান তার সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শাখাগুলো নিজের ক্ষমতায় আওতায় সহজেই নিয়ে নিয়েছেন।  এছাড়া রাজপরিবারের মধ্য থেকেও বিন সালমানের বিরুদ্ধে কোনও জোট গড়ে উঠেনি। বুশ স্কুল অব গভর্নমেন্ট এর সৌদি বিশেষজ্ঞ জর্জ গজ যুবরাজকে অপ্রতিরোধ্যই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘আমি এখনও কোন আলামত পাইনি। পারিবারিক বিবাদ নিয়ে পূর্বে যেমন ঘটেছিলো তেমন কোনও লক্ষণ এখনও দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই হয়তো তাকে পছন্দ করেন না। কিন্তু তাকে থামানোর ক্ষমতা কারও নেই।’

  খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ধাক্কা সামলাতে পারবেন সৌদি যুবরাজ?

সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা ইবন সৌদের ৪০ জনেরও বেশি ছেলে ছিলো। মেয়ে ছিলো আরও বেশি। আর তার ছেলেদের ছেলের সংখ্যা ছিলো শতাধিক। তাই এই পরিবারের সদস্য সংখ্যা এখন হাজারের বেশি। বিশাল পরিধির কারণে ২০০৬ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ আব্দুল্লাহ অ্যালিজিয়েন্স কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব দেন। সেই কাউন্সিলে ৩৫ জন সিনিয়র প্রিন্স রয়েছে। আগে বাদশা একাই যুবরাজের নাম ঘোষণা করতেন। আর এখন এই পরিষদের ওপর সেই ক্সমতা ন্যস্ত। বিন সালমানকে মনোনিত করার সময় এই পরিষদের তেমন কেউ বিরোধিতা করেনি।  ক্ষমতা নেওয়ার পর যুবরাজের ধরপাকরে সবাই রুষ্ট হলেও তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই কারও।  প্রকাশে্য তার বিরোধিতা করার সাহসও নেই অনেকের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সৌদি শিক্ষাবিদ বলেন, যারা বিন সালমানকে নিয়ে খুশি ছিলেন না তারা এখনকার পরিস্থিতিতে খুশি কারণ বিদেশ থেকে চাপের মুখে রয়েছেন যুবরাজ।  তিনি বলেন, সরকারি অভিযানের বলি হতে চান না তারা। 

যুবরাজ হিসেবে বিন সালমানের কর্তৃত্ব কমে যেতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। তাদের  আশঙ্কা, তার এই টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে অন্যান্য প্রিন্সরা নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারে। জর্জ গজ বলেন, ‘আমরা হয়তো তার প্রসারিত শাখার শক্তি কমে যেতে দেখতে পারি। হয়তো সিনিয়র পদগুলোতে নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হতে পারে। তখন একক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে না তার। ’ সৌদি শিক্ষাবিদ বলেন, ‘বিন সালমানতে নত হতে হবে, ছাড় দিতে হবে। একমাস আগেও যেভাসে শাসন করেছেন সেটা আর পারবেন না।’ কারও কারও ধারণা  বাদশা ফয়সালের বিরুদ্ধে যা হয়েছিলো তেমনটাও হতে পারে। শারীরিকভাবে হামলার শিকার হতে পারেন যুবরাজ। তবে এর সম্ভাবনা খুবই কম। বিন সালমানের যাই হোক, তার পরিণতিও বহুমুখী হবে। সামনের বছরগুলোর জন্য সৌদ রাজতন্ত্রের কাঠামোই পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

তবে সৌদি আরবে থাকা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আদতে কিছুই হবে না যুবরাজের।  জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মার্কিন বিশেজ্ঞ আইনজীবী ব্র্যাডলি মস মনে করেন, বাস্তবিক অর্থে সৌদি আরবের কিছুই হবে না। যুক্তরাষ্ট্রও কোনও চাপ প্রয়োগ করবে না। মার্কিন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডারকে দেওয়া সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ‘এমন ভাবার কোনও কারণই নেই যে সৌদি সরকার বিন সালমানকে বিচারের মুখামুখি করবে। যুবরাজের মতো অবস্থানে থাকা কারও বিচার করতে হলে সেই দেশের অনুমতি লাগবে। আর সেটা স্বেচ্ছায় কখনোই করবে না সৌদি আরব।’ মস বলেন, যেটা হতে পারে তা হলো বৈশ্বিক গ্রেফতারি পরোয়ানা কিংবা ব্যক্তিগত নিষধাজ্ঞা আরোপ। দেশ হিসেবে হয়তো সৌদি আরবকে কিছুদিন রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক চাপে রাখা হতে পারে।

 

/বিএ/
সম্পর্কিত
ইসরায়েলের আকরে শহরে হামলার দাবি করলো হিজবুল্লাহ
গাজার হাসপাতালে গণকবর, আতঙ্কিত জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
সর্বশেষ খবর
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না