X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যাননের জনতোষণবাদী ইউরোপ গড়ার পরিকল্পনা

আশফাক মাহমুদ
০৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ২১:৩১আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮, ০৯:৪৪
image

যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপেও উগ্রজাতীয়তাবাদী ও জনতোষণবাদী (পপুলিস্ট) রাজনীতির বিজয় নিশ্চিত করতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী স্টিভ ব্যানন। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় নিশ্চিতে ব্রেইটবার্টের মাধ্যমে ব্যাননের জনতোষণবাদী প্রচারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। হোয়াইট হাউসের শীর্ষ উপদেষ্টা পদ থেকে অব্যাহতি পেলেও থেমে নেই তিনি। ২০১৯ সালে ইউরোপীয় ১৩টি দেশের নির্বাচনে উগ্রজাতীয়তাবাদী ও জনতোষণবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর বিজয় নিশ্চিত করে একটি ‘সুপারগ্রুপ’ গঠন করতে চান ব্যানন। এই সুপারগ্রুপ গঠনের জন্য তিনি সমমনা রাজনৈতিক নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করতে চাইছেন। দিতে চাইছেন নির্বাচনি সহায়তা। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দেশের আইন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ নির্বাচনে বিদেশি সহযোগিতা নিলে তা আইন ভঙ্গের কারণ হতে পারে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে পারে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর ওপরও। এমন পরিস্থিতিতে কী খানিকটা থমকেই গেল ব্যাননের জনতোষণবাদী ইউরোপ গড়ার পরিকল্পনা? স্টিভ ব্যানন

ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক প্রধান কৌশলপ্রণেতা, ফেসবুকে থাকা তথ্য হাতিয়ে নিয়ে মার্কিন ভোটারদের প্রভাবিত করার দায়ে অভিযুক্ত কেমব্রিজ অ্যানালাইটিকার সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও উগ্রজাতীয়তাবাদী সংবাদমাধ্যম ব্রেইট বার্টের প্রতিষ্ঠাতা ব্যানন। পেশায় তিনি একজন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার। তার মোট সম্পদের মূল্য প্রায় পাঁচ কোটি ডলার। ইউরোপে নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়নে গড়ে তুলেছেন ব্রাসেলসভিত্তিক সংগঠন ‘দ্য মুভমেন্ট’। গত অক্টোবর মাসে দ্য গার্ডিয়ানকে ব্যানন জানিয়েছেন, তিনি ইতোমধ্যে ১০ লাখ ডলার খরচ করেছেন সাতটি ইউরোপীয় দেশে। যে অর্থ তিনি ব্যয় করছেন তা রাজনৈতিক পরামর্শকদের অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনি তথ্য বিশ্লেষণে বরাদ্দ করা হয়েছে, যাতে ভোটারদের কাছে আরও সুনির্দিষ্টভাবে জাতীয়তবাদী রাজনৈতিক দলগুলো পৌঁছাতে পারে।

ব্যাননের দাবি, এই উদ্যোগে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও অনেক দাতা রয়েছেন। এসব দাতাদের মধ্যে কোনও রুশ নাগরিক আছেন কি না এমন প্রশ্ন করলে ব্যানন বলেছেন, ‘তারা সবাই ইউরোপীয় এবং তাদের সঙ্গে আছি শুধু আমি।’ কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যানন কাজ করতে চান ইউরোপের এমন ১৩টি দেশের ৯টি দেশেই সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে বিদেশিরা নির্বাচনি সহায়তা দিলে তা আইন ভঙ্গের কারণ হতে পারে। ব্যানন নিজেও স্বীকার করেছেন বিষয়টি। তার ভাষ্য, ‘আমি এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করছি না। তবে আমার মনে হয়, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা এতটা কঠোরও নয়। এটা নিশ্চিত যে, আমরা আইন ভঙ্গের মত কোন কাজ করব না।’

ইউরোপজুড়েই উগ্রজাতীয়তাবাদ ও জনতোষণবাদের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক গবেষণায় তুলে ধরা হয়েছে, গত ২০ বছরে জনতোষণবাদী দলগুলোর ভোট বেড়েই চলেছে। ইউরোপের প্রতি চার জনের একজন ভোটার জনতোষণবাদীদের ভোট দিচ্ছেন। ইউরোপে জনতোষণবাদী রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসলে কী হতে পারে সেটির একটি উদাহরণ ইতোমধ্যেই স্থাপন করে ফেলেছেন হাঙ্গেরির ভিক্তর ওরবান। অভিবাসীদের সহায়তা প্রদান করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন পাস করিয়েছেন তিনি। গত মে মাসে বুদাপেস্টে দেওয়া এক ভাষণে ব্যানন মন্তব্য করেছেন, ইউরোপের ‘জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ’ যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও আঠারো মাসে এগিয়ে। আর এই এগিয়ে থাকার জন্য ফারাজ, ওরবান, দ্য লিগ এবং ফাইভ স্টার মুভমেন্টকে কৃতিত্ব দিয়েছেন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলোকে এক টেবিলে বসানোর জন্য অবশ্য তিনি নিজে কৃতিত্ব দাবি করেছেন।

২০১৯ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিতব্য ইউরোপিয়ানভুক্ত দেশগুলোর নির্বাচনে জয় নিশ্চিতে ‘দ্য মুভমেন্ট’ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সহায়তা করতে চায়। ইউরোপীয় দেশগুলোর নির্বাচনে ডানপন্থী জনতোষণবাদীদের জিতিয়ে আনতে চাওয়া ব্যাননের লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট কিছু দল। ব্যানন চেষ্টা করছেন তাদেরকে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা থেকে বের করে আনতে। তিনি আশ্বস্ত করতে চাইছেন এই বলে যে, তার প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছে না। বরং তিনি এখন আরও নতুন দলকে প্রকল্পে যুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ভাষ্য, ‘এমন কিছু ব্যক্তি আছেন, নির্বাচন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা হয়তো স্বীকার করতে চাইবেন না যে আমার সঙ্গে তারা কাজ করেছেন। আমি সবগুলো দেশের নির্বাচনি প্রচারণায় কাজ করছি, সেসব দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও কার্যালয় থাকুক আর না থাকুক।’

‘দ্য মুভমেন্ট’ নামে পরিচিত সংগঠনটি আসলে কী করতে চায় তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ লিখেছে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সীমান্ত, অভিবাসী গ্রহণের ক্ষেত্রে কড়া বিধিমালা তৈরি এবং ইসলামি চরমপন্থাকে মোকাবিলার উল্লেখ করে প্রচারণা চালাতে চায় সংগঠনটি। তারা আশা করে, এতে ২০১৯ সালের মে মাসের নির্বাচনে দেশগুলোতে উগ্রজাতীয়তাবাদী দলগুলোর বিজয় নিশ্চিত করা যাবে।

নেদারল্যান্ডস ও ইতালি স্টিভ ব্যাননের জন্য অনুকূল। আপাতত ইতালিতে তার সক্ষমতার সবটুকু ঢেলে দিচ্ছেন তিনি। গত বছরেই সেখানে জনতোষণবাদীদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়েছে। ইতালিতে ‘ফাইভ স্টার মুভমেন্ট’ নামক দলটিকে নিজের প্রকল্পের অংশ করতে সমর্থ না হলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি ও রাজনৈতিক দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালির’ জর্জিয়া মেলোনি তার সঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। নেদারল্যান্ডসে ব্যাননের সঙ্গে সঙ্গে কাজ করছেন গ্রিট ওয়াইল্ডর্স।

নির্বাচনে ব্যাননের ভূমিকা নিয়ে আপত্তি রয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নির্বাচন বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা মনে করে, যে ধরনের সহায়তার আর্থিক মূল্য রয়েছে এবং বিদেশিদের কাছ থেকে আসছে তা ফ্রান্স, স্পেন, পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, হাঙ্গেরি এবং ফিনল্যান্ডে আইনত অবৈধ। জার্মানি ও অস্ট্রিয়াতে এ ধরনের ‘ইন কাইন্ড’ নামে পরিচিত সহায়তা দিতে হলে আগে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আর্থিক মূল্যমান নির্ধারণ করতে হয়। বিদেশি দাতাদের কাছ থেকে কতটুকু সহায়তা নেওয়া যাবে তার একটি মাত্রাও নির্ধারণ করে দেওয়া আছে।

দ্য গার্ডিয়ানের মূল্যায়ন, জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাননের মতো বিদেশির কাছ থেকে আইনের আওতার মধ্যে থেকে যেটুকু সহায়তা গ্রহণ করতে পারবে তার পরিমাণ অত্যন্ত কম। ব্যানন কাজ করতে পারবেন ডেনমার্ক ও সুইডেনে। কিন্তু সেই দুইটি দেশে যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি, তারা কাজ করতে রাজি হয়নি।
ব্যাননের সঙ্গে কাজ করা কঠিন হয়ে উঠছে জানিয়ে বেলজিয়ামে তাকে সহায়তাকারী মিখাইল মদ্রিকামেন বলেছেন, ব্যাননের কাছ থেকে সহায়তা নেওয়া বেলজিয়ামের আইন অনুযায়ী তার পক্ষে সম্ভব না। তিনিও স্বীকার করেছেন, জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সের নির্বাচনি আইনে এ ধরনের সহায়তার ব্যাপারে কী লেখা আছে তা ঠিক মতো জানা নেই। তিনি চিন্তিত সময় নিয়ে। কারণ এখনও আরও অনেক রাজনৈতিক দলকে যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। আর সে তুলনায় সময় খুবই অপ্রতুল।

জনতোষণবাদী রাজনৈতিক আদর্শকে সামনে এনে উগ্রজাতীয়তাবাদী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা তা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর নেতাদের মধ্যেও রয়েছে উৎকণ্ঠা। অস্ট্রিয়ার ডানপন্থী দল ফ্রিডম পার্টির হ্যারল্ড ভিলিমস্কি ব্যাননের কাছ থেকে কিছু মাত্রায় সহযোগিতা নেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। তবে সেই সঙ্গে তিনি বিবিসিকে একথাও বলেছেন, ‘যা করা দরকার তার জন্য বাইরের কোনও প্রভাবের প্রয়োজন নেই।’ জার্মানির ডানপন্থী দল এএফডির ইয়াগ মাইটেনের মন্তব্য, ‘ইউরোপের বাইরে থেকে কারও কোচিংয়ের দরকার নেই।’ 

 

/এএ/
সম্পর্কিত
ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত ৫ অভিবাসী নিহত
ইউরোপে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাপমাত্রা বাড়ছে
রুশ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ইউক্রেনের হামলা, ৫০টি ড্রোন ভূপাতিতের দাবি মস্কোর
সর্বশেষ খবর
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা