ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার ঢাকা ট্রিবিউন ও বাংলা ট্রিবিউনের সাংবাদিক হেদায়েৎ হোসেন মোল্যাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি, ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে বিশ্ববাসীর সামনে এ সংক্রান্ত খবর হাজির করেছে। ওইসব সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে বিতর্কিত আখ্যা দিয়ে এর সমালোচনা করা হয়েছে।
ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত নির্বাচনের ফলাফল সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন ‘সঠিক ও তথ্যভিত্তিক না হওয়া’র অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মো. হেদায়েৎ হোসেন মোল্যাকে মঙ্গলবার (১ জানুয়ারি) দুপুরে গ্রেফতার করে পুলিশ। খুলনার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বটিয়াঘাটা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা দেবাশীষ চৌধুরীর দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার (২ জানুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ৩-এর বিচারক নয়ন বিশ্বাস তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একই অভিযোগে দৈনিক মানবজমিনের খুলনা প্রতিনিধি রাশিদুল ইসলামের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে৷ তাকে খুঁজছে পুলিশ।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, নির্বাচনে অনিয়ম সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশের জেরে সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ের করা মামলায় একজন সাংবাদিক গ্রেফতার হয়েছেন, একজন পলাতক রয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সমালোচনা করা হয়েছে। সাংবাদিকদের বরাতে বলা হয়েছে, নতুন এই আইনকে ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, খুলনার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এক আসনে যে পরিমাণ নিবন্ধিত বৈধ ভোটার ভোট দিয়েছেন, গণনা করে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক ভোট পাওয়ার খবর প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিক হেদায়েৎ হোসেন মোল্যা ও রাশিদুল ইসলাম। তবে এক পুলিশ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ‘নির্বাচনি ফলাফলকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে এই অসত্য তথ্য ছড়ানো হয়েছে।’
বাংলাদেশি সাংবাদিক হেদায়েৎ হোসেন মোল্যাকে গ্রেফতারের খবর এসেছে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদনেও। নির্বাচন সংক্রান্ত খবর প্রকাশের পর সাংবাদিক গ্রেফতার শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাকে গ্রেফতারের কারণ হিসেবে ভোটগ্রহণে অনিয়ম নিয়ে ‘অসত্য তথ্য’ প্রকাশের কথা জানিয়েছে পুলিশ। হেদায়েৎকে ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদকর্মী হিসেবে পরিচিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। মঙ্গলবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার আটকের খবর দিতে গিয়ে এএফপি ওই আইনের সমালোচনা করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইনটির মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ভিন্নমত দমনের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা অর্জন করেছে।
স্থানীয় পুলিশ প্রধান মাহবুবুর রহমানকে উদ্ধৃত করে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে সংখ্যক ভোটার ভোট দিয়েছেন, তার থেকে গণনায় ২২, ৪১৯টি ব্যালট বেশি পাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশের পর হেদায়েৎ হোসেনকে খুলনার দক্ষিণাঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয়। ‘মোট ভোটারের মাত্র ৮০ শতাংশ ভোট পড়েছে’ উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান এএফপিকে বলেছেন, ‘নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে অসত্য তথ্য সরবরাহের’ অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
উল্লেখ্য তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বিলোপের ধারাবাহিকতায় গত বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সরকার। একে সংবাদমাধ্যমবিরোধী ভয়ঙ্কর (ড্রাকোনিয়ান) আইন আখ্যা দেওয়া হয়েছে এএফপির প্রতিবেদনে। এ আইন অনুযায়ী, দোষী সাব্যস্ত হলে হেদায়েতের ১৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। পুলিশকে উদ্ধৃত করে এএফপি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, বিতর্কিত এ আইনের আওতায় দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে স্থানীয় প্রশাসন। অপর সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খোঁজা হচ্ছে।
ডয়চে ভেলের বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মামলার এজাহার উদ্ধৃত হয়েছে। এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘‘ঢাকা ট্রিবিউন-এর বাংলা অনলাইনে এবং মানবজমিন পত্রিকায় ‘খুলনা-১ , মোট ভোটারের চেয়ে ২২,৪১৯ ভোট বেশি পড়েছে' শিরোনামে খবর প্রকাশ হয়৷ যা মিথ্যা এবং অসত্য৷ তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করার জন্য এই খবর পরিবেশন করেছেন৷ যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অপরাধ৷''
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে কথা বলার জন্য সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে কয়েকবার টেলিফোন করা হলেও তিনি তা ধরেননি৷ তবে খুলনার জেলা প্রশাসক এবং রিটার্নিং কর্মকর্তা হেলাল হোসেন ওই সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘ওই সাংবাদিকরা অসত্য খবর পরিবেশন করেছেন৷ আমাদেরকে সঠিকভাবে উদ্ধৃত করেননি৷ বিষয়টি নিয়ে নির্বাচন কমিশন পর্যালোচনা করে মামলার নির্দেশ দিয়েছে৷ সেই অনুযায়ী মামলা করা হয়েছে৷''
রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে প্রশ্ন করা হয়- এটাতো সংশোধনের সুযোগ ছিল এবং আরও দেশি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেও খবরটি প্রকাশ হয়েছে৷ তিনি উত্তরে বলেন, ‘‘তারা তো আমাদের সাথে কথাই বলেননি৷ আমাদের তো লিখিত প্রতিবাদ দেওয়ার সুযোগ নেই৷ আর ওই দু'টি সংবাদমাধ্যম থেকেই অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে খবরটি ছড়িয়েছে বলে নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত হয়েছে৷''
তবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহসচিব শাবান মাহমুদ ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘আমরা আগেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের যে আশঙ্কা করেছিলাম তাই সত্য হলো৷ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যে খবর প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ সব পক্ষের বক্তব্য আছে৷ যদি সেখানে কোনও ভুল থাকে, তাহলে তা সংশোধনের সুযোগ আছে৷ কিন্তু তা না করে দু'জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হলো, একজনকে গ্রেফতার করা হলো৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটা পেশাদার সাংবাদিকতার পথে বড় বাধা৷ আমরা মামলা প্রত্যাহার ও আটক সাংবাদিকের মুক্তির দাবি জানাই৷''
মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান ওই জার্মান সংবাদমাধ্যমকে বলেন,‘‘সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা এবং গ্রেফতারের এই ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি চরম হুমকি এবং মানবাধিকারের লংঘন ‘সামনে সাংবাদিকদের আরো বেশি দুর্দিন আসছে’৷ তাঁরা নির্বাচনের অনিয়মের খবর প্রকাশ করেছেন৷''
বাংলাভিশন-এর সাংবাদিক এবং প্রেসক্লাবের নেতা আতিয়ার পারভেজ তাদের জানিয়েছেন, ‘‘নির্বাচনি ফলাফলের যে তথ্যের কথা বলা হচ্ছে, তা রিটানিং অফিসারের কার্যালয় থেকে প্রকাশ করার পর তারা ভুল বুঝতে পেরে আবার কারেকশন দেয়৷ তারা অসাধনতাবশত ভুল করে বেশি ভোটের কথা বলেছিলেন৷ আমরাও তা আবার সংশোধন করেছি৷ ওই দু'টি সংবাদ মাধ্যমও আগের নিউজ প্রত্যাহার করেছে৷ তারপরও তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতারে আমরা ক্ষুব্ধ৷ আমরা এর বিরুদ্ধে কর্মসূচিতে যাচ্ছি৷'' তিনি আরও বলেন, ‘‘আটক সাংবাদিককে হাতকড়া পড়ানোর ঘটনা খুবই দু:খজনক৷ এটা পুরো সাংবাদিক সমাজকে অপমান করা৷''